ঢাকা: বিচার না হওয়া পর্যন্ত কার্যক্রম নিষিদ্ধ ও নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন স্থগিত হওয়ায় আওয়ামী লীগেরই লাভ হয়েছে বলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর গত প্রায় ১০ মাস কার্যত নিষিদ্ধই রয়েছে আওয়ামী লীগ।
গত বছর ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটলে দলটির সভাপতি শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে বাধ্য হয়ে দেশ থেকে পালিয়ে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেন এবং সেখানেই অবস্থান করছেন। এ ঘটনার পর আওয়ামী লীগ ও এর সব সহযোগী সংগঠনের কেন্দ্র থেকে শুরু করে জেলা-উপজেলা, ইউনিয়ন, ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতা, সাবেক মন্ত্রী, এমপি সবাই আত্মগোপনে। কেন্দ্রীয় নেতা, সাবেক মন্ত্রী, এমপিদের বেশিরভাগই দেশ ছেড়েছেন। জেলা-উপজেলা পর্যায়েরও অনেক নেতা দেশের বাইরে চলে গেছেন। এদের অনেকেই সেদিন বা তার পরপরই দেশের বাইরে চলে যান। আবার কেউ কেউ পরিস্থিতি বুঝতে পেরে ৫ আগস্টের আগেই দেশ ছাড়েন। শীর্ষ পর্যায়ের অনেক নেতা, সাবেক মন্ত্রী, এমপিসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা ইতোমধ্যে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন। এদের মধ্যে ওয়ার্ড, ইউনিয়ন পর্যায়ের অনেক নেতাকর্মী রয়েছেন। হত্যাসহ বিভিন্ন মামলায় এদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এভাবেই নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে আওয়ামী লীগ। অর্থাৎ ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর কার্যত নিষিদ্ধই ছিল আওয়ামী লীগ।
এখন কার্যক্রম নিষিদ্ধ ও নিবন্ধন স্থগিত হওয়ার পরে দলটিকে আর বার্ষিক নিবন্ধন ফি দিতে হবে না। নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল হিসেবেও যে কোনো দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সম্মেলনের একটি বাধ্যবাধকতা থাকে। সে অনুযায়ী সম্মেলন করতে হয়। কিন্তু এই সিদ্ধান্তের পর আওয়ামী লীগের কাউন্সিল বা সম্মেলনও করতে হবে না। সম্মেলন করা হলে আওয়ামী লীগের বর্তমান কমিটি থেকে অনেক নেতাই বাদ পড়বেন। অনেকের রাজনীতি অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। আবার অনেকেরই রাজনীতি চিরতরে বন্ধ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ হিসেবে জানা যায়, দলের কর্মীরা অনেক নেতার ওপর মারাত্মক ক্ষুব্ধ। আওয়ামী লীগের এই দুরবস্থার জন্য তারা ওইসব সুবিধাবাদী নেতাদের দায়ী করছেন। এই নিষিদ্ধ পরিস্থিতিতে সম্মেলনের আপাতত সুযোগ থাকছে না বা প্রয়োজন হচ্ছে না। বরং নিষ্ক্রিয় দল ভেতরে ভেতরে কাজ করে দল গোছানোর চেষ্টা করতে পারবে। সময় নিয়ে নেতাকর্মীদের সংগঠিত করতে পারবে। নেতাকর্মীদেরকে সংগঠিত করে নিষ্ক্রিয় দলকে সক্রিয় ও ঐক্যবদ্ধ করার সুযোগ পাবে।
এদিকে বেশ কিছু দিন ধরে দলের বর্তমান নেতৃত্বকে বাদ দিয়ে একটি রিফাইন্ড বা পরিশুদ্ধ আওয়ামী লীগের একটি আলোচনা সামনে আসে। এটাকে দলের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বলে মনে করছিল আওয়ামী লীগ। বিশেষ করে দলের সভাপতি শেখ হাসিনাসহ দলের মূল নেতৃত্বকে মাইনাস করা বা বাদ দেওয়াই এর উদ্দেশ্য বলে মনে করা হচ্ছে।
রিফাইন্ড আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বিভিন্ন সময়ে যাদের নাম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন দিক থেকে আলোচনায় এসেছে বা শোনা গিয়েছে, তারা হলেন—সাবেক রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ, সাবেক মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী, সাবেক স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী, সাবেক প্রতিমন্ত্রী তানজিম আহমেদ সোহেল তাজ, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস, নারায়ণগঞ্জ কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র সেলিনা হায়াত আইভি।
তবে এরইমধ্যে সাবেক রাষ্ট্রপতি দেশ ছেড়েছেন। সোহেল তাজ বলে দিয়েছেন, ‘নির্দিষ্ট কিছু দায় আওয়ামী লীগ মেনে না নিলে এ দলের নেতৃত্বে আসার প্রশ্নই উঠে না। ’ সেলিনা হায়াত আইভি গ্রেপ্তার হয়েছেন।
এই বিষয়টিকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ওয়ান-ইলেভেন পরবর্তী পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনা করছেন। তাদের মতে, ওয়ান-ইলেভেনে শেখ হাসিনাকে মাইনাস করার জন্য এ ধরনের ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল। তবে তখন ছিল মাইনাস-টু ফর্মুলা। তখন বিএনপি চেয়ারসপারসন বেগম খালেদা জিয়াকেও রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র হয়েছিল। এবারের পরিস্থিতি আরও জটিল। এবার শুধু আওয়ামী লীগের উপরে এ ধরনের ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। তবে দলটি কার্যক্রম নিষিদ্ধ ও নিবন্ধন স্থগিত হওয়ায় এই ধরনের ঝুঁকি থেকে দলটি রক্ষা পাবে বলে তারা মনে করছেন।
মূলত জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দুই সম্ময়কারি সারজিস আলম (উত্তর অঞ্চল) এবং হাসনাত আব্দুল্লাহ (দক্ষিণ অঞ্চল) আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের আন্দোলন করেন। তারা এক সময় ছাত্রলীগের রাজনীতি করতেন। আওয়ামী লীগকে বাঁচাতে তারা এই কৌশল নিয়েছে কি না—সে ধরনের অভিযোগ ও প্রশ্ন উঠেছে। নিষিদ্ধ হওয়ায় পরে আওয়ামী লীগের আর রিফর্ম হওয়ার সুযোগ থাকলো না।
স্থগিতাদেশ উঠে গেলে কী হবে আ. লীগের নিবন্ধনের শর্ত?
সরকারের আদেশে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সকল কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়ার পর দলটির নিবন্ধনও স্থগিত করে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। অর্থাৎ কার্যক্রমের ওপর নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলে নিবন্ধনের ওপরও স্থগিতাদেশ তুলে দেবে সংস্থাটি। এক্ষেত্রে যেদিন নিষেধাজ্ঞা উঠবে, সে সময় দলটির সর্বশেষ কমিটি কার্যকর থাকবে কি না, কিংবা অন্যান্য শর্ত পূরণ কোন পন্থায় হবে—এসব নিয়ে মুখ খুলতে চাচ্ছেন না নির্বাচন কমিশনার কিংবা সংস্থাটির দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা।
তবে ইসির নির্বাচন সহায়তা শাখার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্মকর্তারা বলছেন, বর্তমানে দলটির কার্যক্রম নিষিদ্ধ। তাই কমিশনও দলটির নিবন্ধন স্থগিত করেছে। আওয়ামী লীগ নিয়ে যে কোনো ধরনের প্রচারের ওপরও নিষেধাজ্ঞা থাকায় দলটির সকল ধরনের কার্যক্রমই স্থগিত থাকবে। এতে নিবন্ধনের কোনো শর্ত আর প্রযোজ্য নেই। যদি কখনো নিবন্ধনের ওপর স্থগিতাদেশ উঠে যায়, যে সময় স্থগিতাদেশ উঠবে তখন থেকেই আবার নিবন্ধনের শর্ত আরোপ হবে।
রাজনৈতিক দল নিবন্ধন বিধিমালা–২০০৮ অনুযায়ী, প্রতিটি দলকে নিবন্ধনের শর্তাবলী প্রতিপালনের বিষয়ে সময় সময় ইসিকে অবহিত করতে হয়। কেননা, বিধিমালার ৯ (ক), (খ), (গ) ও (ঘ) বিধিতে দলের কেন্দ্রীয় পর্যায়ে নতুন কমিটির নির্বাচিত সদস্যদের তালিকা এবং সংশ্লিষ্ট দলের এ সংক্রান্ত সভার কার্যবিবরণীর অনুলিপি কমিশনে দাখিল; প্রতি বছর ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে পূর্বের পঞ্জিকা বছরের সংশ্লিষ্ট দলের আর্থিক লেনদেন একটি রেজিস্টার্ড চার্টার্ড অ্যাকাউন্টিং ফার্ম দ্বারা অডিট করিয়ে সেই রিপোর্টের কপি দাখিল; সময় সময় যেসব তথ্য বা কাগজপত্র কমিশন চাইবে তা দাখিল; ও সময় সময় যে সকল বিষয়ের ওপর কমিশন মন্তব্য বা ব্যাখ্যা চাইবে তা পরিপালনের কথা বলা হয়েছে।
ইসি কর্মকর্তারা বলছেন, নিবন্ধন স্থগিত থাকায় কমিশন এখন আর আওয়ামী লীগের কাছে কোনো তথ্যই চাইবে না। এক্ষেত্রে প্রতি বছর আয়-ব্যয়ের যে হিসাব দিতে হয়, সেটিও এখন দলটির দিতে হবে না। অন্যদিকে কমিটিরও কোনো তথ্য দিতে হবে না। তবে স্থগিতাদেশ উঠে গেলে সকল তথ্যই দিতে হবে। সে সময় দল যে অবস্থায় থাকবে তাই দিতে হবে।
দলটির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, মাঠপর্যায়ে কমিটি গঠনের পর কাউন্সিলরদের ভোটে প্রতি তিন বছর পরপর জাতীয় কাউন্সিল হওয়ার বিধান রয়েছে। সে অনুযায়ী, আগামী ডিসেম্বরে শেষ হবে দলটির সর্বশেষ কমিটির মেয়াদ। গত ১০ মে কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণার পর ওই কমিটির মেয়াদ আছে আরও সাত মাস। তবে নিবন্ধনের স্থগিতাদেশ উঠে গেলে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন কমিটির ওই সাত মাস সময় বলবৎ থাকবে কিনা—এ বিষয়ে দলীয় সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে মনে করছেন ইসি কর্মকর্তারা। তাদের মতে, কমিটির তালিকা কেবল ইসিতে জমা দিলেই হবে।
এ বিষয়ে ইসির সাবেক অতিরিক্ত সচিব (যিনি ২০০৮ সালে প্রথমবারের দল নিবন্ধন কার্যক্রম চালুর সঙ্গে অতোপ্রতোভাবে জড়িত ছিলেন) ও অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত ‘নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন’র সদস্য জেসমিন টুলী বলেন, সরকার দলটির কার্যক্রমের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। কাজেই তাদের সকল কার্যক্রম বন্ধ থাকবে। অর্থাৎ কোনো ধরনের কার্যক্রমই আর তাদের চলবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞা না উঠে যায়। আর ইসির স্থগিতাদেশ যেহেতু সেই নিষেধাজ্ঞার আলোকে হয়েছে, সেজন্য নিবন্ধন সংক্রান্ত সকল কার্যক্রম ও শর্তাবলীর ওপরও স্থগিতাদেশ কার্যকর থাকবে।
তিনি বলেন, স্থগিতাদেশ দেওয়ার অর্থ হচ্ছে—সোজা কথায় সবকিছু থেমে যাবে। ব্যাংক অ্যাকাউন্টের ওপরও স্থিতাবস্থা থাকবে। কমিটির ক্ষেত্রেও তাই। যদি কখনো স্থগিতাদেশ উঠে যায়, তখন কোনো কমিটি বলবৎ থাকবে তা সেই দলই নির্ধারণ করে ইসিকে জানাবে। কোন কমিটি থাকবে বা থাকবে না, তা নিয়ে ইসির আইনে কিছু বলা নেই। বরং দল থেকে যে কমিটির তালিকা দেওয়া হবে সেটিই আমলে নেবে ইসি। কেননা, এই সময়ের মধ্যে অনেকে মারা যেতে পারেন, কেউ কেউ রাজনীতি ছেড়ে দিতে পারেন, অনেকেই দেশের বাইরে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করতে পারেন। কাজেই এটা তাদের ব্যাপার, ইসির ব্যাপার না।
জাতীয় নাগরিক পার্টির দুইদিনের আন্দোলনের মুখে গত ১০ মে আওয়ামী লীগের সকল কার্যক্রমের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় সরকার। এরপর সেই নিষেধাজ্ঞার আলোকে গত ১২ মে দলটির নিবন্ধনও স্থগিত করে নির্বাচন কমিশন। আর এই সিদ্ধান্তের ফলে দেশের সবচেয়ে প্রাচীন দলটি প্রথমবারের মতো নির্বাচনি প্রক্রিয়া থেকে ছিটকে পড়ে।
এসকে/ইইউডি/এমজে