ঢাকা, বুধবার, ১৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ২৮ মে ২০২৫, ০০ জিলহজ ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

যে কারণে ড. ইউনূসের পদত্যাগের ভাবনা, সেই কারণগুলোই বাড়ছে কেন?

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১:০৬, মে ২৭, ২০২৫
যে কারণে ড. ইউনূসের পদত্যাগের ভাবনা, সেই কারণগুলোই বাড়ছে কেন? প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস

ঢাকা: যে কারণে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পদত্যাগের ভাবনা সেই কারণগুলো বাড়ার মূলে রয়েছে চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন নিশ্চিত না করা ৷ অন্তর্বর্তী সরকার এই সময়ের মধ্যে নির্বাচন নিশ্চিত করলে প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগ ভাবনার কারণগুলো বাড়বে না বলে অনেকেই মনে করছেন।  অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান দায়িত্ব একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করা।

কিন্তু বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অভিযোগ, সরকার সেদিকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নজর দিচ্ছে না। যদিও প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, চলতি বছরের ডিসেম্বর অথবা আগামী বছরের জুনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। গত শনি ও রোববার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকে এ কথা বলা হয়। কিন্তু সরকারের এই বক্তব্যে রাজনৈতিক দলগুলো আশ্বস্ত হতে পারছে না। কারণ এখন পর্যন্ত সরকার নির্বাচনের রোডম্যাপ ও সুনির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা করেনি।

সক্রিয় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে প্রধান এবং সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি দীর্ঘদিন ধরেই নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখ ও রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি করে আসছে। কিন্তু সরকারের দিক থেকে এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ এখনো দৃশ্যমান হয়নি। এর মধ্যেই সংকটে পড়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। আর অন্তর্বর্তী সরকারের এই সংকট তখনই তৈরি হলো যখন বিএনপি এই দাবিকে জোরালো করতে থাকে এবং সরকারের কিছু কর্মকাণ্ডে সমালোচনা করে। পাশাপাশি রাজপথের কিছু কর্মসূচি দিয়ে আন্দোলনে নামে দলটির কর্মীরা।

বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র পদে শপথ পড়ানোর দাবিতে টানা আটদিন ধরে আন্দোলন চলে। গত বৃহস্পতিবার (২২ মে) অন্তর্বর্তী সরকারকে ৪৮ ঘণ্টা আল্টিমেটাম দিয়ে এই আন্দোলন আপাতত স্থগিত করা হয়। এদিন ইশরাককে মেয়র ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশনের দেওয়া গেজেটের বৈধতা নিয়ে এবং তাকে শপথ পড়ানো থেকে বিরত থাকার নির্দেশনা চেয়ে করা রিট খারিজ করে দেন হাইকোর্ট।

এদিকে গত কয়েকদিন ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং ছাত্রদল নেতা শাহরিয়ার আলম সাম্য হত্যার বিচার ও হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে গত কয়েকদিন ধরে শাহবাগে অবস্থান কর্মসূচি দিয়ে আন্দোলন চালিয়ে আসছে ছাত্রদল। বৃহস্পতিবার অবস্থান কর্মসূচি স্থগিত করা হলেও দ্রুত দাবি আদায় না হলে আগামীতে কঠোর কর্মসূচি ঘোষণার হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে।

এদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের যে উপদেষ্টারা একটি নতুন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত তাদের অব্যাহতি দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছে বিএনপি। একইসঙ্গে সরকারের ভাবমূর্তি রক্ষার্থে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমানকেও অব্যাহতি দেওয়ার দাবি জানিয়েছে দলটি। বৃহস্পতিবার (২২ মে) সংবাদ সম্মেলন করে দলটির পক্ষ থেকে এ দাবি জানানো হয়। সার্বিক পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর থেকে বিএনপির সমর্থন উঠে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়।

এর আগে গত বুধবার (২১ মে) সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বাহিনীর কর্মকর্তাদের নিয়ে এক বৈঠকে নির্বাচন, রাখাইনের জন্য মানবিক করিডোর প্রসঙ্গ এবং মব সৃষ্টিসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন। বৈঠকে সেনাবাহিনী প্রধান চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেছেন। রাখাইনের মানবিক করিডোরবিষয়ক সিদ্ধান্ত একটি নির্বাচিত সরকারের থেকে আসতে হবে এবং তা বৈধ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে হতে হবে বলে তিনি জানিয়েছেন। বিভিন্ন সূত্র থেকে গণমাধ্যমে এ বিষয়গুলো এসেছে।

এই প্রেক্ষাপটে বৃহস্পতিবার রাতে শোনা যায়, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস পদত্যাগ করার কথা ভাবছেন। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, পদত্যাগের কারণ হিসেবে ড. ইউনূস বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর নানামুখী চাপ, অনৈক্য, নানা ইস্যুতে তার বাসভবন ঘিরে আন্দোলন, তার বিরুদ্ধে দেশ বিক্রির অভিযোগ, ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের জন্য বিএনপির অব্যাহত চাপ, বিভিন্ন দাবিতে একের পর এক আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে জিম্মি করার চেষ্টা ইত্যাদি কারণে তিনি আর দায়িত্ব পালন করতে চান না। উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে তিনি এ বিষয়গুলো তুলে ধরেন।

পর দিন শুক্রবার (২৩ মে) প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক মন্ত্রণালয়) ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব জানান, প্রধান উপদেষ্টা পদত্যাগ করবেন না৷

সৃষ্ট সংকট ও উদ্ভূত পরিস্থিতির এই প্রেক্ষাপটে শনি ও রোববার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা। কিন্তু যে কারণে পদত্যাগ করতে চেয়েছিলেন প্রধান উপদেষ্টা সেই কারণগুলোই বাড়ছে ৷ এ বাড়ার কারণ মূলত দ্রুত নির্বাচন দেওয়ার বিষয়ে সরকারের পদক্ষেপ না নেওয়া বা পদক্ষেপ স্পষ্ট ও দৃশ্যমান না হওয়া ৷

শনিবার (২৪ মে) প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির সঙ্গে বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা ৷ বৈঠকে বিএনপি চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন এবং তিন উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবি পুনর্ব্যক্ত করেছে৷ বিএনপি লিখিতভাবে প্রধান উপদেষ্টাকে দেওয়া চিঠিতে বলেছে, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের যে সমস্ত উপদেষ্টারা একটি নতুন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত বলে সবাই জানে ও বোঝে; উপদেষ্টা পরিষদে তাদের উপস্থিতি সরকারের নির্দলীয় নিরপেক্ষ পরিচিতিকে ক্রমাগত প্রশ্নবিদ্ধ করে চলেছে বলেই সরকারের ভাবমূর্তি রক্ষার্থে তাদের অব্যাহতি দেওয়া প্রয়োজন। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ইতোমধ্যে বিতর্কিত হয়েছেন, সরকারের ভাবমূর্তি রক্ষার্থে তাকে অব্যাহতি দিতে হবে। ’

জাতীয় নির্বাচনের বিষয়ে বিএনপির চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘জন-আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী একটি নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকার প্রতিষ্ঠা করাই এখন সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। তাই আমরা একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে একটি জাতীয় সংসদ গঠনের জন্য অবিলম্বে সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানাচ্ছি। এই সর্বোচ্চ জন-আকাঙ্ক্ষাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানতম অ্যাজেন্ডা হওয়া উচিত বলে জনগণ মনে করে। এর অন্যথা হলে জনগণের দল হিসেবে বিএনপির পক্ষে এই সরকারের প্রতি সহযোগিতা অব্যাহত রাখা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। ’

বিএনপির এই বক্তব্যের মধ্য দিয়েই দলটির অবস্থান স্পষ্ট যে তাদের উত্থাপিত দাবি বিশেষ করে চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন এবং এর জন্য দ্রুত রোডম্যাপ ঘোষণা না করলে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি তাদের সমর্থনও বেশি দিন অব্যাহত না থাকার সম্ভাবনাই বেশি।

এদিকে রোববার (২৫ মে) রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠকের পর সংবাদ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, পার্টিগুলো অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন কার্যক্রমে সমর্থন জানিয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা জানিয়েছেন, ডিসেম্বর থেকে ৩০ জুনের মধ্যে নির্বাচন করবেন। ৩০ জুনের পরে যাবে না। এতে সবাই সন্তোষ প্রকাশ করেছেন৷ 

নির্বাচনের রোডম্যাপ নিয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, স্যার একটা ডেডলাইন দিয়েছেন, সেটা নিয়ে বারবার বলেছি, গতকালকেও বলেছি, আজও বলছি। তিনি এক কথার মানুষ। নির্বাচন জুনের মধ্যেই হবে। তাকে ট্রাস্ট করতে হবে। যখন সময় হবে, তখন তিনি রোডম্যাপ ও শিডিউল ঘোষণা দেবেন।

সরকারের এই অবস্থান ও বক্তব্যে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন দেওয়ার সম্ভাবনা বা দাবির কোনো প্রতিফল নেই বলেই অনেকে মনে করছেন। এর ফলে সহসা রোডম্যাপ ঘোষণার কোনো নিশ্চয়তাও নেই ৷

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রগুলো থেকে জানা গেছে, বিএনপিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল সরকারের এই অবস্থানে অসন্তুষ্ট ৷ সরকারের গতিবিধি ও অবস্থানে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের বিষয়ে কোনো নিশ্চয়তা বা সদিচ্ছা তারা দেখছেন না। সরকারের এই অবস্থানকে দলগুলো বিশেষ করে বিএনপি স্বাভাবিকভাবে নিচ্ছে না ৷ এই পরিস্থিতিতে দ্রুত নির্বাচনের দাবিতে বিএনপি মাঠে নামার চিন্তাভাবনাও করছে। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই এ বিষয়ে বিএনপির অবস্থান স্পষ্ট হবে বলে দলটির একাধিক সূত্র থেকে জানা গেছে।

এদিকে বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে শপথ পড়ানোর দাবির বিষয়ে সরকার কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম শেষে আবার আন্দোলন শুরু হয়েছে ৷ আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে ডিএসসিসির মেয়র হিসেবে শপথ না পড়ানো হলে আরও কঠোর আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তার সমর্থকরা। সোমবার (২৬ মে) দুপুরে নগর ভবনের ভেতরে ‘অবস্থান কর্মসূচি’ থেকে এ ঘোষণা দেন কর্মসূচির প্রধান সমন্বয়কারী ও সাবেক সচিব মশিউর রহমান।

এসকে/আরবি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।