চলতি আগস্ট থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পণ্য রপ্তানিতে বাংলাদেশকে আগের ১৫ শতাংশের সঙ্গে নতুন করে ২০ শতাংশ শুল্ক দিতে হচ্ছে। একই হারে শুল্ক দিতে হচ্ছে ভিয়েতনামকে।
ভিয়েতনামের শুল্ক বাংলাদেশের সমান হলেও দেশটির পণ্য রপ্তানিতে ট্রান্সশিপমেন্ট থাকায় বাংলাদেশের চেয়ে বেশি গুনতে হবে। ফলে মার্কিন বাজারে পোশাক শিল্পের প্রতিযোগী ভিয়েতনাম, চীন ও ভারতের চেয়ে বাংলাদেশ সুবিধাজনক অবস্থানে আছে।
তৈরি পোশাক রপ্তানিতে ভারতের উৎপাদনকারীরা নিজ দেশে বাড়তি নীতি সহায়তা পায়। পোশাক রপ্তানিতে তারা উদীয়মান দেশ হয়ে ওঠায় বাংলাদেশের জন্য ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এবার ভারতীয় পণ্যে ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করায় সেই প্রতিবন্ধকতা কিছুটা কমেছে বলে জানিয়েছেন রপ্তানিকারকরা। তারা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন দেশের জন্য পণ্য রপ্তানিতে ভিন্ন ভিন্ন শুল্ক কাঠামো আরোপ করার ফলে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানিতে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সাবেক পরিচালক ও স্পারো গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শোভন ইসলাম বলেন, চীন বা ভারতের ওপর উচ্চ শুল্ক আরোপের খবর শুনে অতিরিক্ত আশা তৈরি করা উচিত হবে না। শেষ পর্যন্ত এই শুল্কের বিষয়গুলো বড় বড় বাজার খেলোয়াড়দের মধ্যেই সমাধান হবে। ভারতের হাতে এখনও ২৭ আগস্ট পর্যন্ত সময় আছে—তার আগে সমঝোতা বা সময় বাড়ানোর সম্ভাবনাই বেশি, ফলে ঘোষিত ৫০ শতাংশ পারস্পরিক শুল্ক হয়তো কার্যকরই হবে না।
বাংলানিউজকে তিনি বলেন, অন্য দেশের ওপর শুল্ক বৃদ্ধির আশায় না থেকে আমাদের উচিত নিজের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা। একইসঙ্গে সরকারি অবকাঠামোর ভেতরের নন-ট্যারিফ বাধাগুলো— কাস্টমস, ভ্যাট-ট্যাক্স, ব্যাংকিং, বন্দর, জ্বালানি খাত এবং হয়রানি ও অস্থিরতার কারণে উৎপন্ন লিড টাইম কমিয়ে আনতে মনোযোগ দিতে হবে।
শোভন ইসলাম আরও বলেন, সবার সক্রিয় অংশগ্রহণে সক্ষমতা বৃদ্ধি সম্ভব। নন-ট্যারিফ বাধা দূর করতে আমাদের ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে এবং এক্ষেত্রে বিএজিএমইএ-এর সহযোগিতা অত্যন্ত জরুরি।
যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশর পণ্যর ওপর গত এপ্রিল মাসে অনেকটা হঠাৎ করে বাড়তি ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে। এরপর প্রথম দফায় ২ শতাংশ কমিয়ে ৩৫ শতাংশ নির্ধারণ করে। যুক্তরাষ্ট্রর সঙ্গে দরকষাকষির এক পর্যায়ে নন ডিসক্লোজার এগ্রিমেন্ট শেষে ৩১ জুলাই দ্বিতীয় দফায় ১৫ শতাংশ কমিয়ে ২০ শতাংশ শুল্ক নির্ধারণ করে। ফলে আগের ১৫ শতাংশসহ বাংলাদেশকে এখন দিতে হচ্ছে ৩৫ শতাংশ শুল্ক।
পণ্য রপ্তানিতে আগের শুল্কের পাশাপাশি নতুন করে ভিয়েতনামের ওপর ২০ শতাংশ, ভারতের ওপর ৫০ শতাংশ, পাকিস্তানের ওপর ১৯ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়ার ওপর ১৯ শতাংশ এবং চীনের ওপর ৪১ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র।
যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বিভিন্ন দেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি
যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশ তৃতীয় পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। প্রতি বছর দেশটি সারা বিশ্ব থেকে গড়ে প্রায় ৮০ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক আমদানি করে থেকে। দেশটিতে ২০২৪ সালে ৭.৩ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ৫.২ বিলিয়ন ডলার; ২০২১ সালে ৭.১ বিলিয়ন ডলার; ২০২২ সালে ৯.৭ বিলিয়ন ডলার এবং ২০২৩ সালে ৭.৩ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছিল।
ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড অ্যাডমিনিস্টেশনের অফিস অব টেক্সটাইল অ্যান্ড অ্যাপারেলের তথ্য মোতাবেক, যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাকের বাজারে চীনের শেয়ার ২০.৮২ শতাংশ, ভিয়েতনামের ১৮.৯০ শতাংশ, বাংলাদেশর ৯.২৬ শতাংশ, ভারতের ৫.৯১ শতাংশ এবং ইন্দোনেশিয়ার ৫.৩৬ শতাংশ।
এখানে উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রপ্তানির প্রায় ৯০ শতাংশই তৈরি পোশাক। বাকি ১০ ভাগ প্লাস্টিক পণ্যসহ অন্যান্য পণ্য।
যে কারণে যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানি গুরুত্বপূর্ণ
একক দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাজার। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, দেশের মোট তৈরি পোশাক রপ্তানির প্রায় ২০ শতাংশ রপ্তানি হয় যুক্তরাষ্ট্রে। গত ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই-মে ১১ মাসে দেশের মোট ৩৬.৫৫ বিলিয়ন ডলার তৈরি পোশাক রপ্তানি আয়ের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হয়েছে ৭.৩১ বিলিয়ন ডলার। দেশটি তৈরি পোশাক রপ্তানির ক্রমবর্ধমান বাজার। বাড়তি শুল্ক বসানোর ফলে দেশটিতে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে সংকট তৈরি হয়েছিল। দরকষাকষির মাধ্যমে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে শুল্ক ২০ শতাংশে নামিয়ে আনার ফলে বাংলাদেশকে প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের চেয়ে কম, ভিয়েতনামের সমান, উদীয়মান তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ ভারতের চেয়ে কম এবং পাকিস্তানের চেয়ে কিছুটা বেশি শুল্ক দিতে হবে।
বাংলোদেশে কার্যাদেশ স্থানান্তর হতে পারে
শুল্ক বৃদ্ধির ফলে গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশমুখী হচ্ছিলেন চীনের তৈরি পোশাক উৎপাদনকারীরা। এ সুবিধা ভারতও নেওয়া শুরু করেছিল। নতুন করে ভারতের ওপর অতিরিক্ত ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপের ফলে দেশটি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পণ্য রপ্তানি কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। ভারতে কার্যাদেশ দেওয়া কোম্পানিগুলোর মধ্যে অনেকগুলো ইতোমধ্যে ভারত ছাড়ার চিন্তা-ভাবনা করছে।
শুল্কের এই অবস্থা বাংলাদেশের জন্য একটি স্বস্তির জায়গা তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সাবেক সভাপতি ফজলুল হক। বাংলানিউজকে তিনি বলেন, আমাদের ওপরে প্রথমে ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছিল আর ভারত, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া ও পাকিস্তানের ওপর শুল্ক কম ছিল। এখন বাংলাদেশের কমেছে, ভারতের বেড়ে ৫০ শতাংশ হয়েছে, ভিয়েতনাম সমান হয়েছে। এর ফলে আমরা একটি প্রতিযোগিতার জায়গায় চলে গেলাম। এপ্রিলে ট্রাম্পের নতুন শুল্ক বসানোর আগে যে জায়গায় ছিলাম, আমরা আবার আগের সেই জায়গায় চলে গেলাম।
ফজলুল হক বলেন, তৈরি পোশাক রপ্তানিতে ভারত উদীয়মান প্রতিযোগী হয়ে উঠেছে। দেশটি আমাদের মতো এত বেশি তৈরি পোশাক রপ্তানি করতে পারে না, পিছিয়ে আছে। কিন্তু সম্ভাবনাময়। তারা বেশি সুবিধা পেলে আমাদের সামনে ঝুঁকি হয়ে উঠতে পারত। শুল্ক আরোপে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন অবস্থানের ফলে সেই জায়গাটা থামিয়ে দেওয়া সম্ভব হলো।
যে কারণে সতর্কতা জরুরি
রপ্তানিকারকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রতিযোগিতা সক্ষম শুল্ক ধরে রাখা গেলেও আরও বেশ কিছু বিয়য় আছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেগুলো হলো, উৎপাদনশীলতা ও উৎপাদন ব্যয়। চীনের ওপর আগে থেকেই উচ্চ শুল্ক হার বসালেও দেশটি উৎপাদনে উচ্চ প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বাড়িয়েছে। এর ফলে উৎপাদন ব্যয়ও কমেছে। এতে আগের চেয়ে বেশি শুল্ক হওয়ার পরও চীন যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রেখেছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মুহাম্মদ হাতেম বলেন, এখন ব্যাংকিং খাতে চরম অ-ব্যবস্থাপনা চলছে, গ্যাস সংকট ও কাস্টম থেকে আশানুরূপ সহযোগিতা পাচ্ছি না। এসব সমস্যা সমাধান করা গেলে অবশ্যই ৫৫ বিলিয়ন ডলার রপ্তানির যে লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে, এই লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব।
তিনি বলেন, ভারতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে উদ্যোক্তাদের বিভিন্ন রকম প্রণোদনা ও প্যাকেজ সুবিধা দেওয়া হয়। কিন্তু বর্তমান অবস্থায় আমরা সব কিছুকে ওভারকাম করে আমাদের দেশীয় সমস্যাগুলোর কথা বলছি, সেই সমস্যাগুলো যদি সমাধান করা সম্ভব হয়, এগুলোকে যদি এড্রেস করা যায়, তবে ভারতের চেয়ে ভালো কিছু করা সম্ভব।
ভারতের ওপর বাড়তি শুল্ক আরোপ করার ফলে দেশটির অনেক রপ্তানি আদেশ স্থগিত হচ্ছে। তাদের এসব কার্যাদেশ বাংলাদেশে আসবে, আবার চীন থেকেও বাংলাদেশে আসবে। সবকিছুই নির্ভর করবে আমাদের নিজস্ব সক্ষমতা বাড়ানোর ওপর, যদি নিজেরা প্রস্তত হতে পারি।
জেডএ/এমজেএফ