ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৮ শ্রাবণ ১৪৩২, ১২ আগস্ট ২০২৫, ১৭ সফর ১৪৪৭

বাংলানিউজ স্পেশাল

জুলাই ঘোষণাপত্র ও সনদ বাস্তবায়নের নিশ্চয়তা কতটুকু

খাদেমুল ইসলাম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১:৩৩, আগস্ট ১১, ২০২৫
জুলাই ঘোষণাপত্র ও সনদ বাস্তবায়নের নিশ্চয়তা কতটুকু ৫ আগস্ট জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় আয়োজিত অনুষ্ঠানে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ পাঠ করেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে শেখ হাসিনার ভারতে পালিয়ে যাওয়ার এক বছর পূর্ণ হয়েছে। এই সময়ে কয়েকটি বিষয় আলোচনার কেন্দ্রে ছিল।

তার মধ্যে রয়েছে—সংস্কার, ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’, জুলাই ঘোষণাপত্র এবং জুলাই সনদ। জাতীয় সংস্কারের লক্ষ্যে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে রাজনৈতিক দলগুলো যেসব বিষয়ে একমত হয়েছে, তা জাতীয় সনদ হিসেবে স্বাক্ষরের প্রক্রিয়া চলছে। এটাই হলো জুলাই সনদ। আর জুলাই আন্দোলনের ফলে যে সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা প্রতিষ্ঠার অভিপ্রায় এবং তাদের মাধ্যমে সংস্কারের যে অভিপ্রায় সেটিকে বলা হয় জুলাই ঘোষণাপত্র।

গত ৫ আগস্ট জুলাই ঘোষণাপত্র আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস সংসদ ভবনের সামনে এই ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। ঘোষণাপত্র বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সূচনালগ্ন থেকে জুলাই অভ্যুত্থান পর্যন্ত সমস্ত গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে প্রেক্ষাপট হিসেবে নিয়ে সংস্কার, বিচার ও গণতান্ত্রিক রূপান্তরের অঙ্গীকার করা হয়েছে। ঘোষণাপত্রকে পরবর্তী সরকার সংবিধানের তফসিলে অন্তর্ভুক্ত করবে বলে অভিপ্রায় ব্যক্ত করা হয়।

ওই ঘোষণাপত্রের মধ্য দিয়ে আরেকটি বিষয় স্পষ্ট হয় যে, প্রস্তাবিত সংস্কারের মাধ্যমে রচিত হতে যাওয়া জুলাই সনদ আসলে কীভাবে বাস্তবায়ন হবে? অনেক রাজনৈতিক দল চেয়েছিল গণপরিষদ বা গণভোটের মাধ্যমে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পর নির্বাচন হোক। তবে বিএনপি ও তার মিত্র দলগুলো বলে আসছিল, কেবল নির্বাচিত সংসদই পারে সংবিধান পরিবর্তন করতে।

জুলাই ঘোষণাপত্রেও সংবিধান সংস্কারের বিষয়টি পরবর্তী সংসদের হাতেই ছেড়ে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। ঘোষণাপত্রে সংস্কারের বিষয়টি পরবর্তী সংসদের হাতে ছেড়ে দেওয়ায় জুলাই সনদ নিয়ে একধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হলো বলে মনে করে কোনো কোনো রাজনৈতিক দল।

দীর্ঘদিন আলোচনার পর ঐকমত্য কমিশন যেসব সংস্কারে একমত হয়েছে, তা নিয়ে জুলাই সনদের এখন শেষ সময়ের প্রস্তুতি চলছে। সেই সনদ বাস্তবায়নের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেক রাজনৈতিক দল আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। যদিও বিএনপির পক্ষ থেকে নির্বাচিত হলে জুলাই সনদ বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে।

আগামী দিনে পুরাতন ব্যবস্থা ফেরত এলে তার জন্য এই অন্তর্বর্তী সরকারই দায়ী থাকবে বলে মনে করে রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন। দলটির পক্ষ থেকে জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে এক বিবৃতিতে বলা হয়, দলীয় সরকার গঠন ও পরিচালিত হয় সংবিধানের ওপর ভিত্তি করে। ফলে সংবিধানের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা সে সরকারের একটা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হয়ে ওঠে। একান্ত প্রয়োজনে সংবিধানের ছোটখাট সংশোধনী করার এখতিয়ার রাখলেও মৌলিক কোনো সংস্কার করার এখতিয়ার কোনো দলীয় সরকারের থাকে না। তারপরও কোনো দলীয় সরকার সংবিধানের কোনো মৌলিক সংস্কার করলে তা পরবর্তী দলীয় সরকার ও বিচার বিভাগের এখতিয়ারভুক্ত থাকে, টেকসই হতে পারে না।

রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের ওই বিবৃতিতে আরও বলা হয়, জুলাই ঘোষণাপত্রের ২৫ ও ২৭ অনুচ্ছেদে আগামী জাতীয় সংসদের ওপর সংবিধান সংস্কারের দায়-দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। এটা বিপজ্জনক এবং অসম্ভব একটা উদ্যোগ। সংবিধানের মৌলিক সংস্কার জাতীয় সংসদের এখতিয়ার বহির্ভূত। সরকার যদি এটা না জেনে থাকে, তবে তা সরকারের আরেকটা বড় ব্যর্থতা। আর জেনেবুঝে বলে থাকলে তা জাতির জন্য ভয়াবহ অশনিসংকেত।

বিবৃতিতে আরও বলা হয়, প্রকৃত সত্য হলো, মাত্র ৩-৪টি দল বা জোট বাদে বাকি সব দল ও জোট এর বিপক্ষে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব করেছে। তারা সংবিধান সংস্কারের জন্য হয় সংবিধান সংস্কার সভা বা গণপরিষদ বা গণভোটের প্রস্তাব করেছে। এ নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন তৃতীয় পর্যায়ে সংলাপের ঘোষণাও এরই মধ্যে দিয়েছে। কিন্তু সে সংলাপ না করেই সরকারের পক্ষ থেকে অল্প কিছু দলের প্রস্তাবকে জনগণের অভিপ্রায় হিসেবে ঘোষণা দেওয়া একটা মিথ্যাচার।

পরবর্তী সংসদের হাতে সবকিছু ছেড়ে দেওয়ার ঘোষণা দেওয়ায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর। জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে পরবর্তী নির্বাচিত সংসদের সংস্কারকৃত সংবিধান। পরবর্তী নির্বাচিত সরকারই যদি সব সিদ্ধান্ত নেয়, তবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপের নামে এই তামাশার কী দরকার ছিল? আমরা বলেছিলাম, যেসব সংস্কারের আইনি ভিত্তি নির্বাচনের আগে সম্ভব, সেগুলো আগেই আইনি ভিত্তি দেওয়া হোক। আমরা বলেছিলাম, আগামীর বাংলাদেশ পরিচালিত হবে জুলাই ঘোষণাপত্রের ভিত্তিতে। কিন্তু জুলাই সনদের কথা এই ঘোষণাপত্রে উল্লেখই করা হয়নি। যদি বলা হতো, এই ঘোষণাপত্রের বাস্তবায়নে একটি জাতীয় সনদ তৈরি হবে। তদুপরি একটি শক্ত আইনি ভিত্তি পেতো।

জুলাই সনদের বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছে জামায়াতে ইসলামীও। জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ায় জামায়াতের নায়েবে আমির  ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, আগামী নির্বাচন জুলাই সনদের ভিত্তিতে হোক। কারণ, মানুষ যে প্রত্যাশা নিয়ে এতদিন অপেক্ষা করছিল, তা জুলাই ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে পূরণ হয়নি। এতে করে দেশের জনগণের মাঝে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে। অন্যদিকে শহীদ পরিবার ও জুলাই যোদ্ধাদের মধ্যেও নতুন করে উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে। তাই ঐকমত্য কমিশনের মাধ্যমে আগামীর জুলাই জাতীয় সনদ প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন কেমন হবে, তা এখনও অস্পষ্ট।

তবে নির্বাচিত সংস্কারের মাধ্যমে আগামী দিনে জাতির আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী সংস্কার বাস্তবায়ন হবে বলে মনে করে বিএনপি। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ এ নিয়ে সব শঙ্কা উড়িয়ে দেন। জুলাই ঘোষণাপত্র ও নির্বাচনের ঘোষণার পর প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, এই দিনে আমাদের বিশাল অর্জন। দীর্ঘ এক বছর ধরে আমরা মানুষের কল্যাণে, রাষ্ট্রব্যবস্থার সংস্কারে কমিশনগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জন্য প্রয়োজনীয় যে সংস্কার রাষ্ট্র কাঠামো প্রয়োজন, তার একটা পর্যায়ে ঐকমত্যে উপনীত হয়েছি। আশা করি, শিগগিরই ঐকমত্যের ভিত্তিতে যথাযথ প্রক্রিয়ায় সই হবে এবং সেটা বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়েও যদি আলাপ-আলোচনা হয়, সেখানে আমরা অংশগ্রহণ করব। এর মধ্য দিয়ে জাতির যে ফ্যাসিবাদবিরোধী জাতীয় ঐক্যবদ্ধ প্রতিষ্ঠা হয়েছিল আগে, সেটাকে আমরা সমুন্নত রাখব এবং এই ফ্যাসিবাদবিরোধী জাতীয় ঐক্যকে আমরা শক্তিতে পরিণত করে এগিয়ে নিয়ে যাব।

কেআই/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।