ঢাকা, বুধবার, ১৫ আশ্বিন ১৪৩২, ০১ অক্টোবর ২০২৫, ০৮ রবিউস সানি ১৪৪৭

বাংলানিউজ স্পেশাল

নির্বাচন পদ্ধতির পরিবর্তনই কি দেশে গণতন্ত্রের সমাধান?

দেলোয়ার হোসেন বাদল, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১:৫২, সেপ্টেম্বর ৩০, ২০২৫
নির্বাচন পদ্ধতির পরিবর্তনই কি দেশে গণতন্ত্রের সমাধান?

ঢাকা: বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে কয়েক মাস ধরে নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে বিতর্ক চলছে। বর্তমানে প্রচলিত ‘ফার্স্ট-পাস্ট-দ্য-পোস্ট’ (FPTP) বা যে বেশি ভোট পায় সেই জয়ী—এই পদ্ধতি নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠছে।

একদিকে এই পদ্ধতি যেমন স্থিতিশীল সরকার গঠনের নিশ্চয়তা দেয়, অন্যদিকে এর সীমাবদ্ধতা নিয়ে সমালোচকরা বরাবরই সরব। সাম্প্রতিক সময়ে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (PR) পদ্ধতির আলোচনা জোরেশোরে শুরু হয়েছে। এই পদ্ধতি কি আসলেই দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থার সংকট দূর করতে পারবে?

দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের নির্বাচনে যে পদ্ধতি চলছে, তা হলো এফপিটিপি। এই পদ্ধতির মূল সুবিধা হলো, এতে সরকার গঠনে কোনো জটিলতা থাকে না। যেহেতু একটি আসনে একজনই জয়ী হন, তাই সাধারণত একটি দল সুস্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। এর ফলে দেশে একটি শক্তিশালী ও স্থিতিশীল সরকার গঠিত হয়, যা দ্রুত নীতি নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন করতে পারে। তাই বিএনপির মতো রাজনৈতিক দলগুলো এই পদ্ধতির পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে। তারা মনে করে, এফপিটিপি পদ্ধতি দেশে জোটের রাজনীতিকে উৎসাহিত করে, যা দেশের জন্য স্থিতিশীলতা তৈরি করতে পারে।

তবে, এফপিটিপি পদ্ধতির বড় দুর্বলতা হলো, এখানে ভোটের অপচয় হয়। একজন প্রার্থী জয়ী হলে বাকি সবার ভোট কার্যত মূল্যহীন হয়ে পড়ে। এতে জনগণের প্রকৃত জনমতের প্রতিফলন ঘটে না। প্রায়শই দেখা যায়, কোনো দল মোট প্রদত্ত ভোটের কম শতাংশ পেয়েও সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করে, যা গণতান্ত্রিক বৈধতার প্রশ্নে বিতর্ক তৈরি করে।

অন্যদিকে পিআর পদ্ধতির মূল ভিত্তি হলো প্রতিটি ভোটের গুরুত্ব নিশ্চিত করা। এই ব্যবস্থায় কোনো দল মোট ভোটের যে অংশ পায়, সংসদের আসনও সেই আনুপাতিক অনুপাতে বণ্টিত হয়। এর ফলে ছোট দল, নতুন রাজনৈতিক শক্তি এবং সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হয়, যা একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতন্ত্রের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশের ছোট দলগুলো সাধারণত এই পদ্ধতির পক্ষে কথা বলে। তাদের মতে, এফপিটিপি পদ্ধতি ভোট কারচুপি এবং একচেটিয়া ক্ষমতাকে উৎসাহিত করে। আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব চালু হলে নির্বাচনের স্বচ্ছতা বাড়বে বলে তারা মনে করে।

কিন্তু এই পদ্ধতিরও কিছু ঝুঁকি আছে। যেহেতু কোনো একক দল সহজে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় না, তাই সরকার গঠনের জন্য প্রায়ই একাধিক দলের জোট প্রয়োজন হয়। এই জোট সরকার অনেক সময় দুর্বল ও অস্থিতিশীল হতে পারে, যার ফলে নীতি নির্ধারণ ও বড় সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিলম্ব ঘটে। এছাড়াও, ভোটাররা সরাসরি কোনো প্রার্থীকে নয়, বরং দলকে ভোট দেন। এতে স্থানীয় প্রতিনিধির জবাবদিহিতা কমে যেতে পারে।

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) মতো বড় দলগুলো সাধারণত এফপিটিপি পদ্ধতির পক্ষে। তাদের যুক্তি হলো, এই ব্যবস্থা দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এনেছে। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ অন্যান্য ছোট দলগুলো আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের দাবি জানাচ্ছে। তারা মনে করে, এই পদ্ধতি চালু হলে তাদের প্রাপ্য ভোট অনুযায়ী আসন পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান বলেন, একটি গোষ্ঠী ষড়যন্ত্র করে নির্বাচনকে পিছিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। তারা এখন নতুন করে পিআর পদ্ধতির কথা বলছে। কিন্তু বাংলাদেশের জনসংখ্যার কত শতাংশ লোক পিআর বোঝে? গণতন্ত্র মানে সবাই সব কথা বলবে এবং সবাই নিজ নিজ মতামত দেবে। কিন্তু পিআর পদ্ধতির মাধ্যমে আবারও নতুন করে ফ্যাসিবাদ নিয়ে আসার চেষ্টা করা হচ্ছে। আমরা ও আমাদের দলের নেতাকর্মীরা এই জন্য দীর্ঘ বছর লড়াই সংগ্রাম করিনি।

জামায়াতে ইসলামের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বলেন, বর্তমান সংসদীয় নির্বাচন ব্যবস্থায় বাংলাদেশে ত্রুটিপূর্ণ ও প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন হচ্ছে। ২০১৮ সালের রাতে ভোট এবং ২০২৪ সালের ডামি নির্বাচনের মতো বিষয়গুলো এফপিটিপি পদ্ধতির ব্যর্থতা প্রমাণ করে। এই সমস্যার সমাধানে এবং দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় বড় ধরনের সংস্কার আনতে পিআর পদ্ধতি গ্রহণের প্রস্তাব জামায়াতের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, পিআর পদ্ধতিতে কালো টাকা এবং মনোনয়ন বাণিজ্যের বিরুদ্ধে একটি কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব। ছোট দলগুলোর জন্য সংসদে প্রতিনিধিত্বের সুযোগ তৈরি হবে। বর্তমান পদ্ধতিতে ৩০-৪০ শতাংশ ভোট পেয়ে একটি দল ক্ষমতায় চলে যায়, যা সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মতামতকে উপেক্ষা করে। পিআর ব্যবস্থা কোনো নির্দিষ্ট দল বা ব্যক্তির একক ক্ষমতাকে সীমিত করবে, যা আওয়ামী লীগের মতো ফ্যাসিবাদী শাসনের পুনরাবৃত্তি রোধে সাহায্য করবে। পিআর পদ্ধতিতে দলগুলো নির্বাচনের আগেই তাদের সবচেয়ে যোগ্য ও ক্লিন ইমেজের প্রার্থীদের তালিকা প্রকাশ করবে। এতে জনগণ তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারবে এবং যোগ্য ব্যক্তিরা সংসদে আসার সুযোগ পাবেন।  

পিআর পদ্ধতিতে সংসদ সদস্যরা জাতীয় বিষয়গুলোর নীতি নির্ধারণ, গবেষণা ও বিতর্কের উপর মনোনিবেশ করবেন। এসব বিবেচনা করেই পিআর পদ্ধতি নির্বাচন সব দিক থেকেই উত্তম বলে মনে করেন জামায়াতের এই শীর্ষ নেতা।

বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরান বলেন, পিআর পদ্ধতি মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী। গত ৫৪ বছর এদেশের মানুষ যেভাবে ভোট দিয়েছে সেভাবে ভোট দিতে চায়। ১৭ বছর পিআরের জন্য মানুষ লড়াই সংগ্রাম করে নাই। মূলত আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের জন্যই এ উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। জুলাই আন্দোলন কোনোদিনই পিআর পদ্ধতির জন্য হয়নি। বরং এটি জামায়াতের একটি অশুভ ষড়যন্ত্র। এর মাধ্যমে ভিন্ন রূপে ফ্যাসিবাদ চালু হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ভারতের পক্ষ থেকেও পিআর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে এবং কিছু রাজনৈতিক দল মাঠ গরম করার জন্য বিষয়টি ব্যবহার করছে। মূলত আওয়ামী লীগ এভাবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হতে চায়।

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক (গণমাধ্যম) আরিফুর রহমান তুহিন বলেন, এনসিপি নির্বাচন পদ্ধতি পরিবর্তনের কথা কোথাও বলেনি। বর্তমান যে পদ্ধতি আছে, সেটিই থাকবে। তবে সংবিধানের বেসিক স্ট্রাকচার পরিবর্তনের প্রশ্নে আমরা বলছি— এর সমাধান একটাই, গণপরিষদ নির্বাচন। এ ক্ষেত্রে সংসদ সদস্যরাই গণপরিষদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব নিতে পারেন। মানে, একই নির্বাচনের মাধ্যমে তারা সংসদ সদস্যও হবেন, আবার সংবিধান রচনার দায়িত্বও নেবেন। কারণ সংবিধান সংশোধন যদি বেসিক স্ট্রাকচারের বিরুদ্ধে যায়, তাহলে আপিল বিভাগ সেটি বাতিল করে দেবে। তাই জনগণের ক্ষমতায়ন ও নতুন করে বেসিক স্ট্রাকচার নির্ধারণের জন্য গণপরিষদ নির্বাচন প্রয়োজন। বর্তমানে যে সংবিধান চালু আছে, সেটি আসলে জনগণের ক্ষমতায়ন নয়; বরং এটি এক ব্যক্তিনির্ভর সংবিধান।

তবে, রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, যে কোনো পদ্ধতিই ফলপ্রসূ হবে যদি তা সঠিকভাবে প্রয়োগ করা হয়। পদ্ধতি পরিবর্তনের চেয়ে রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠনই বেশি জরুরি বলে তারা মনে করেন।

সাধারণ মানুষের ভাবনাও এই বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে। তাদের কাছে পদ্ধতির চেয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন বেশি গুরুত্বপূর্ণ। একজন সাধারণ ভোটার শুধু চান, তিনি যেন নির্ভয়ে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারেন এবং তার ভোট যেন কোনোভাবে নষ্ট না হয়। অনেকে মনে করেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে জার্মানি বা নিউজিল্যান্ডের মতো একটি মিশ্র ব্যবস্থা (Mixed-member Proportional Representation- MMP) হতে পারে একটি আদর্শ সমাধান। এই পদ্ধতিতে কিছু আসন সরাসরি ভোটে এবং কিছু আসন আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে বণ্টিত হয়। এতে জনগণের সরাসরি প্রতিনিধির পাশাপাশি ছোট দলগুলোরও প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হয়।

বাংলাদেশের নির্বাচনী সংকট শুধু পদ্ধতির পরিবর্তন দিয়েই সমাধান করা সম্ভব নয়। একটি পদ্ধতি হয়তো স্থিতিশীলতা দিতে পারে, কিন্তু অন্যটি আরও বেশি প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে। দুটি পদ্ধতির সুবিধা-অসুবিধা বিবেচনা করে একটি ভারসাম্যপূর্ণ সমাধান খুঁজে বের করা জরুরি। তবে আসল চ্যালেঞ্জ হলো রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনা। যদি প্রতিটি দল জনগণের রায়কে সম্মান জানায় এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে ধারণ করে, তাহলে যে কোনো পদ্ধতিতেই নির্বাচন সুষ্ঠু ও অর্থবহ হয়ে উঠবে। বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ তাই নির্ভর করছে রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণের ওপর।

ডিএইচবি/এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।