ঢাকা: সম্প্রতি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দলীয় নেতাকর্মীদের সতর্ক করে বলেছেন, দেশের ওপর গভীর ষড়যন্ত্র চলছে। গণতান্ত্রিক শক্তিগুলো যদি এখনই ঐক্যবদ্ধ না হয়, তবে ভবিষ্যতে দেশে ‘গুপ্ত স্বৈরাচার’ আবির্ভূত হতে পারে।
বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতারাও বিভিন্ন সময়ে 'গুপ্ত স্বৈরাচার' প্রসঙ্গ তুলে নানা ইঙ্গিতপূর্ণ কথা বলেছেন, যদিও তারা পরিষ্কারভাবে এই ‘গুপ্ত স্বৈরাচারের’ নাম উল্লেখ করেননি। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বিএনপির এই ইঙ্গিত কেবল একটি রাজনৈতিক রূপক নয়; বরং এর মাধ্যমে তারা দেশের উদীয়মান শক্তিগুলোর মধ্যে সম্ভাব্য স্বৈরতান্ত্রিক প্রবণতার দিকেই আঙুল তুলেছে। তাদের মতে, বিএনপি পরোক্ষভাবে 'গুপ্ত স্বৈরাচার' বলতে জামায়াতে ইসলামীকেই বোঝাচ্ছে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিএনপি ও জামায়াত দীর্ঘদিনের মিত্র। ২০০১ সালের নির্বাচনে চারদলীয় জোটের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে এই দুই দল একসঙ্গে সরকারও গঠন করে। তবে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর থেকে জামায়াতের প্রতি আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ চাপ বাড়তে থাকে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিএনপিও কৌশলগতভাবে জামায়াত থেকে দূরত্ব তৈরি করার চেষ্টা করেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটার পর বিএনপি-জামায়াতের সম্পর্কের টানাপোড়েন তীব্র আকার ধারণ করে। বিশেষ করে ‘সংস্কার আগে না নির্বাচন আগে’- এই প্রশ্নে দুই দলের মধ্যে স্পষ্ট বিভক্তি তৈরি হয়। বিএনপি জাতীয় নির্বাচনকে অগ্রাধিকার দিতে চাচ্ছে, অন্যদিকে জামায়াত পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবি তুলে এ অবস্থানগত বিভাজন সম্পর্কের টানাপোড়েনকে আরও গভীর করেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, গত জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর জামায়াতে ইসলামী গণতান্ত্রিক রাজনীতি চর্চার পথে হাঁটলেও, তাদের একটি শক্তিশালী ধর্মীয় লেবাস রয়েছে। জামায়াত কতটুকু গণতান্ত্রিক দল হিসেবে আবির্ভূত হবে, সে বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টদের। তাদের দলীয় গঠনতন্ত্রও গণতন্ত্রকে পুরোপুরি সমর্থন করে না এবং অতীত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডও নানাভাবে বিতর্কিত বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় আঁকড়ে ধরে আওয়ামী লীগ নিজেদের গণতান্ত্রিক পরিচয়কে স্বৈরাচারে পরিণত করেছিল। একই সঙ্গে, তারা অন্যান্য গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোকেও দমন করে ধ্বংস করতে চেয়েছে। এর ফলস্বরূপ বিএনপিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং সেখান থেকে উঠে আসতে তাদের সময় লাগছে বলে মনে করছেন রাজনীতি সংশ্লিষ্টরা। তারা মনে করেন, আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের দমন-পীড়ন গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা তৈরি করেছে, যা তারেক রহমানের বক্তব্যেও পরোক্ষভাবে প্রতিফলিত হয়েছে।
এছাড়া গত বছরের ৫ আগস্টের পর সারা দেশে বিভিন্ন স্থানে মাজার-দরগায় হামলা এবং ‘তৌহিদী জনতা’র নামে যেভাবে মব সৃষ্টি করা হয়েছে, বিশ্লেষকরা মনে করেন, যদি এই ধরনের কর্মকাণ্ডে জামায়াতের সংশ্লিষ্টতা বা নীরব সম্মতি থাকে, তবে তা ‘গুপ্ত স্বৈরাচারকে’ লালন-পালন করার শামিল। তাদের মতে, তারেক রহমান তার বক্তব্যে এই শঙ্কার কথাই প্রকাশ করেছেন। এই ধরনের কার্যকলাপ সমাজে অস্থিরতা তৈরি করে এবং গণতান্ত্রিক পরিবেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে ঘিরেও নানা ন্যারেটিভ ছড়ানো হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। অভিযোগ আছে, জামায়াত সক্রিয়ভাবে এসব প্রচারণায় অংশ নিচ্ছে এবং তাকে চাঁদাবাজ প্রমাণ করার প্রচেষ্টাও চালাচ্ছে। একই সঙ্গে বিএনপির বিরুদ্ধে মিডিয়া ট্রায়াল চালানো হচ্ছে, যা গণতান্ত্রিক পরিবেশকে আরও জটিল করে তুলছে। রাজনীতি সংশ্লিষ্টদের মতে, সোশ্যাল মিডিয়ায় বিএনপিকে ঘিরে অপপ্রচার চালানো জামায়াতের একটি চাপ প্রয়োগের কৌশল। তারেক রহমান হয়তো এই প্রক্রিয়াকেও ‘গুপ্ত স্বৈরাচারী’ ভূমিকার অংশ হিসেবে ইঙ্গিত করেছেন।
অভিযোগ আছে, অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর প্রশাসনের বিভিন্ন পদে জামায়াত সমর্থিত ব্যক্তিরা অধিষ্ঠিত হয়েছেন। এর ফলে জামায়াতকে অনেকে 'ছায়া সরকার' বলেও অভিহিত করছে। এ প্রসঙ্গে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বাংলানিউজকে বলেন, নির্বাচন না হলে অনেকের সুবিধা হবে, তাই তারা পিআর পদ্ধতির কথা বলে নির্বাচন বানচালের অপচেষ্টা চালাচ্ছেন। অনেকে জামায়াতকে ‘ছায়া সরকার’ বলছে। তবে বিএনপি দেশকে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দিকে নিতে চায়। আমরা চাই শিক্ষা ক্ষেত্রে, স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে সব যোগ্য মানুষ থাকবে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. দিলারা চৌধুরী এ প্রসঙ্গে বাংলানিউজকে বলেন, বিএনপি সরাসরি নাম না নিলেও বোঝা যাচ্ছে, জামায়াতের মতো কিছু দলকে তারা সন্দেহের চোখে দেখছে। কারণ, অতীতে জামায়াত যেভাবে ধর্মীয় আবেগকে ব্যবহার করেছে এবং রাজনৈতিক সঙ্কটে সুযোগ নিয়েছে, তাতে তাদের গণতান্ত্রিক চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। বিএনপি এখন দ্বৈত সংকটে আছে, একদিকে আওয়ামী লীগের দীর্ঘ স্বৈরাচার থেকে মুক্ত হওয়ার লড়াই, অন্যদিকে পুরনো মিত্রদের অগণতান্ত্রিক প্রবণতার সঙ্গে সমন্বয় করা। এই দোদুল্যমান অবস্থাই ‘গুপ্ত স্বৈরাচার’ ইস্যুকে সামনে এনেছে বলে মনে করি।
বিএনপি ও জামায়াতের সাম্প্রতিক বিরোধের বড় উদাহরণ হলো পিআর পদ্ধতি। বিএনপি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, তারা এই পদ্ধতি চায় না। অন্যদিকে জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেছেন, তার দল ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে অংশ নেবে এবং সংসদের উভয় কক্ষে পিআর পদ্ধতি বাস্তবায়নের দাবি জানাবে।
এ প্রসঙ্গে জাতিসংঘ সফরে থাকার সময় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আবারও স্পষ্ট করে জানিয়েছেন, বিএনপি পিআর পদ্ধতি চায় না। দেশের মানুষও পিআর বোঝে না। তিনি সেসময় সংবাদমাধ্যমকে বলেন, এ বিষয়ে আমাদের বক্তব্য একেবারে সুস্পষ্ট। আমরা পিআর পদ্ধতিতে যাব না। আর এ দেশের মানুষ এটা মেনে নেবে না, এবং এটা তারা বোঝেও না।
নির্বাচনের আগে পাঁচদফা দাবিতে কর্মসূচি ঘোষণা করেছে জামায়াতে ইসলামী। যুক্তরাষ্ট্র সফরকালীন সময় দলটির নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের জানান, জুলাই সনদের ভিত্তিতে জাতীয় নির্বাচন, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করা, ফ্যাসিস্ট সরকারের সব জুলুম-নির্যাতন, গণহত্যা ও দুর্নীতির বিচার এবং পতিত স্বৈরাচারের দোসর জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করাসহ সংসদের উভয় কক্ষে পিআর পদ্ধতি চান তারা। এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার টেবিলে বসার পাশাপাশি রাজপথেও তারা নানা কর্মসূচি ঘোষণা করবে জানা গেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই বিরোধ শুধু একটি নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে নয়, বরং দুই দলের ভবিষ্যৎ কৌশল নিয়েও। বিএনপি মনে করছে জাতীয় নির্বাচন ছাড়া অন্য ইস্যুতে মনোযোগ দেওয়া জনগণের আস্থা হারাতে পারে, অথচ জামায়াত মাঠে উপস্থিতি বজায় রাখতে বহুমুখী দাবিকে সামনে আনছে। পিআর পদ্ধতির জন্য জামাতসহ কিছু ইসলামী দলের রাজপথে কর্মসূচি ঘোষণাকে বিএনপিকে চাপে রাখার কৌশল হিসেবে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
এই মুহূর্তে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে বিএনপি এককভাবে একটি কঠিন পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, বিএনপির সঙ্গে কিছু ছোট ছোট বাম দল থাকলেও তারা তুলনামূলকভাবে দুর্বল। ফলে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার এই লড়াইয়ে বিএনপির পথচলা বেশ কঠিন হবে। বিশ্লেষকরা আরও মনে করেন, আসন্ন নির্বাচন যদি গণতান্ত্রিকভাবে বা গণতান্ত্রিক শক্তির অংশগ্রহণে না হয়, তবে দেশ আবারও সংকটাপন্ন অবস্থানে যাবে। এই অবস্থায় একটি কার্যকর রাজনৈতিক জোট গঠন করা বিএনপির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে তারা মত দিচ্ছেন।
বিএনপি মনে করছে, পিআর নিয়ে জামায়াতের দাবির মূল উদ্দেশ্য নির্বাচনের আগে মাঠে নিজের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা এবং নেতাকর্মীদের সক্রিয় রাখা। এই পরিস্থিতিতে বিএনপি নিজ দলের নেতাকর্মীদের নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত রাখার কৌশল নিয়েছে। এর অংশ হিসেবে দলের মনোনয়নপ্রত্যাশীসহ সব পর্যায়ের নেতাকর্মীদের জনসম্পৃক্ত কাজ বাড়ানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
তারেক রহমানের ‘গুপ্ত স্বৈরাচার’ সংক্রান্ত বক্তব্য এবং এর সঙ্গে জড়িত রাজনৈতিক ঘটনাবলী দেশের ভবিষ্যৎ গণতন্ত্রের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা হচ্ছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই মুহূর্তে গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর মধ্যে ঐক্য এবং একটি সুচিন্তিত কর্মপন্থা গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। অন্যথায়, দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আরও ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে।
বিএনপির সামনে একদিকে যেমন গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের কঠিন পথ, তেমনই অন্যদিকে পুরনো মিত্রদের সঙ্গে নতুন করে সম্পর্কে টানাপোড়েন- সব মিলিয়ে এক জটিল সমীকরণের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় বিএনপি কতটা সফল হয়, তা দেখার জন্য দেশের জনগণ ও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন।
এসবিডব্লিউ/এজে