ঢাকা, শনিবার, ১৯ আশ্বিন ১৪৩২, ০৪ অক্টোবর ২০২৫, ১১ রবিউস সানি ১৪৪৭

বাংলানিউজ স্পেশাল

রাজধানীতে বেড়েছে অপরাধ, বাড়ছে কিশোর অপরাধী

মিরাজ মাহবুব ইফতি, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭:০২, অক্টোবর ৪, ২০২৫
রাজধানীতে বেড়েছে অপরাধ, বাড়ছে কিশোর অপরাধী

রাজধানীতে কিশোর অপরাধীদের দৌরাত্ম্য ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ছিনতাই, গার্মেন্টসের ঝুট ব্যবসা, পরিবহন খাতে চাঁদাবাজি, মাদক কারবার, জমি দখল, টার্গেট কিলিংসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে কিশোররা।

তারা নিয়ন্ত্রিত হয় কোনো না কোনো গ্যাং কালচারের মাধ্যমে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর নজরদারির পরও তাদের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে আসছে না। বরং ঢাকার মতো সারা দেশেই বেড়ে যাচ্ছে কিশোর অপরাধ। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) সূত্র জানিয়েছে, রাজধানীতে বর্তমানে সক্রিয় রয়েছে ৬৮২ কিশোর অপরাধী। তাদের বিচরণ মোহাম্মদপুর, মিরপুর, ডেমরাসহ অপরাধপ্রবণ চিহ্নিত এলাকায়।  

কিশোররা অপরাধে জড়াচ্ছে মূলত দারিদ্র্য, পরিবার ভাঙন, বেকারত্ব, স্কুল থেকে ঝরে পড়া ও নেশার প্রভাবে। দারিদ্র্য তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণে ব্যর্থ করে, ফলে তারা দ্রুত অর্থ উপার্জনের অবৈধ পথ বেছে নেয়। পরিবারে স্নেহ-নির্দেশনার অভাব ও অভিভাবকদের বিচ্ছেদ মানসিক শূন্যতা তৈরি করে। বেকারত্ব ও শিক্ষার সুযোগ হারিয়ে অনেক কিশোর সমাজের মূলধারা থেকে বিচ্যুত হয়। নেশাজাতীয় দ্রব্য তাদের বিবেক ও নিয়ন্ত্রণক্ষমতা নষ্ট করে, যা অপরাধে উৎসাহ দেয়।

অপরাধ বিশেষজ্ঞরাও একই মত দিয়েছেন। তারা বলছেন, মাদকাসক্তি, দারিদ্র্য, নিম্নমানের জীবনযাত্রা, পারিবারিক সমস্যা, হতাশা, সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, পর্যাপ্ত শিক্ষার অভাব ও ধর্মীয় অনুশাসনের অভাবেই মূলত কিশোর গ্যাং গড়ে উঠছে। নগরায়ণের প্রভাবে একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে একক পরিবারে পরিণত হচ্ছে। ফলে কিশোররা পারিবারিক অনুশাসনে দীক্ষিত হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তা ছাড়া কেউ কেউ রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থের লক্ষ্যে এবং এলাকায় আধিপত্য বজায় রাখতে কিশোরদের ব্যবহার করছে নানা সন্ত্রাসীমূলক কর্মকাণ্ডে। বিগত সময়ে দেখা গেছে, রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা নানা কৌশলে কিশোরদের অপরাধের দিকে ঠেলে দিয়েছেন।  

কিশোর গ্যাংয়ের কাঠামো
কিশোর গ্যাংগুলোর গডফাদাররা সাধারণত দরিদ্রতা, পারিবারিক দুর্বলতা এবং শিক্ষাহীনতার সুযোগ কাজে লাগিয়ে প্রয়োজনীয় অর্থ, সুরক্ষা বা ‘ভাগিদারী’ দেখিয়ে কিশোরদের আকৃষ্ট করেন। মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের মাধ্যমে স্কুল, খেলাধুলা, অনলাইন গ্রুপ পর্যবেক্ষণ করে তারা তাদের ‘গিনিপিগ’ নির্ধারণ করে। যারা অর্থ ও মাদকের দিকে ঝুঁকে পড়ে তাদের মদ, গাঁজা, ইয়াবা ও ভালো উপার্জনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে দলে টেনে নেয়। আনুগত্য বজায় রাখতে ভয়, উপহার বা সুবিধা দিয়ে থাকে গডফাদাররা।  

কিশোর গ্যাংয়ের নেতৃত্ব কাঠামো সাধারণত অপরাধী চক্রের মতো সংগঠিত। প্রতিটি গ্যাংয়ে থাকে একজন ‘লিডার’ বা ‘ডন’, যে গ্যাংয়ের সিদ্ধান্ত, লক্ষ্য ও কর্মকৌশল নির্ধারণ করে। তার অধীনে থাকে ‘সহ-নেতা’ বা ‘সিনিয়র মেম্বার’ যারা নতুন সদস্য নিয়োগ, টাকা সংগ্রহ, এলাকা নিয়ন্ত্রণ ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখে। সবচেয়ে নিচের স্তরে থাকে ‘জুনিয়র’ বা ‘নবীন সদস্যরা’, যারা নেতার নির্দেশে হুমকি, মারামারি বা ছোটখাটো অপরাধে অংশ নেয়। গ্যাংয়ের নেতৃত্ব প্রায়ই ভয়, আনুগত্য ও আর্থিক লোভের মাধ্যমে টিকে থাকে। অনেক সময় বড় অপরাধী বা রাজনৈতিক ব্যক্তিও এসব কিশোর গ্যাংকে গোপনে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়।

বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী, ১৮ বছরের কম কেউ অপরাধ করলে তাকে ‘কিশোর অপরাধী’ হিসেবে গণ্য করা হয়। হত্যাকাণ্ডের মতো সর্বোচ্চ অপরাধের জন্য শাস্তি মাত্র ১০ বছরের কারাদণ্ড। ইউনিসেফের হিসাবে, বাংলাদেশে কিশোর-কিশোরীদের সংখ্যা ৩ কোটি ৬০ লাখ, যা দেশের মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কিশোর গ্যাং ও তাদের গডফাদারদের বিরুদ্ধে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ না করা হলে সামাজিক অবক্ষয় ভয়াবহ রূপে দেখা দিতে পারে। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, শাস্তির মাত্রা লঘু হওয়ায় কিশোররা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয়। ফলে অপরাধের মাত্রা বিবেচনায় নিয়ে আইনের সুষ্ঠু সংস্কারও প্রচণ্ড জরুরি। প্রয়োজনে কিশোর কারাগার ব্যবস্থা চালু এবং কিশোর সংশোধন কেন্দ্রগুলোকে সময়োপযোগী করে সংশোধন কার্যক্রম পরিচালনায় সক্ষম কাঠামো গড়ে তুলতে হবে। একই সঙ্গে গড়ে তুলতে হবে সামাজিক আন্দোলন। কিশোর গ্যাং নির্মূল করতে হলে, এর নেপথ্যে যারা আছে তাদের আইনের মুখোমুখি করতে হবে। দিতে হবে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি।

কিশোর গ্যাং কালচারের শুরু- 
২০১৮ সালের ৬ জানুয়ারি ঢাকার উত্তরায় ‘ডিসকো বয়েজ’ ও ‘নাইন স্টার’ নামে দুটি কিশোর গ্যাংয়ের দ্বন্দ্বে খুন হয় নবম শ্রেণির ছাত্র আদনান কবির। মূলত এরপরই কিশোর গ্যাংয়ের বিষয়টি আলোচনায় আসে।

২০১৮ সালের পর থেকে মোহাম্মদপুর, মিরপুর, ডেমরা ও রাজধানীর আশপাশের এলাকায় কিশোর অপরাধ বেড়ে চলেছে। বিগত সরকারে এসব দমনে কাজ শুরু করলেও সেটি সম্ভব হয়নি। কেননা, সরকারের থাকা বিভিন্ন এমপি-কাউন্সিলররা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এসব গ্যাং পরিচালনা করেছেন। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পরও কিশোর অপরাধ ব্যাপকহারে বেড়েছে।  

ডিএমপি সূত্র জানায়, রাজধানীর ৮ বিভাগে সক্রিয় রয়েছে ৫২টি কিশোর গ্যাং। এর মধ্যে মিরপুর বিভাগে সর্বাধিক ১৩টি গ্যাংয়ের হয়ে ১৭২ জন কিশোর সক্রিয়। তারা মাদক, জমি দখল, চাঁদাবাজি, ছিনতাই ও টার্গেট কিলিংয়ে জড়িত। তেজগাঁও বিভাগে রয়েছে সাতটি গ্রুপের ১২১ জন কিশোর অপরাধী। রমনা বিভাগে সাতটি গ্রুপে ১১৩ জন, গুলশানে সাতটি গ্রুপে ৬৩ জন, ওয়ারীতে ছয়টি গ্রুপে ১০৮ জন, উত্তরায় ছয়টি গ্রুপে ৬৪ জন, মতিঝিলে চারটি গ্রুপে ৩১ জন এবং লালবাগ বিভাগে দুটি গ্রুপে ১০ জন কিশোর অপরাধী। এর আগে ২০২৩ সালে রাজধানীতে ১২৭টি কিশোর গ্যাং ও ১৩৮২ জন সদস্যকে চিহ্নিত করেছিল পুলিশ।

গত ৩ জানুয়ারি সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত আদাবরের মেহেদীবাগ ও বাজার এলাকায় শতাধিক কিশোর দেশিয় অস্ত্র নিয়ে প্রকাশ্যে মহড়া দেয়। এতে বাধা দিলে স্থানীয়দের ওপর হামলা চালিয়ে অর্ধশতাধিক মানুষকে আহত করে গ্যাং সদস্যরা।

গত ১ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর হাতিরঝিলে কিশোর গ্যাংয়ের দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে গুলিবিনিময়ের ঘটনা ঘটে। এসময় এক কলা ব্যবসায়ী এবং এক কিশোর গুলিবিদ্ধ হন। গত ৫ ফেব্রুয়ারি মোহাম্মদপুরের রায়েরবাজারে মাদকবিরোধী অভিযানের সময় কিশোর গ্যাং ‘পাটালি গ্রুপ’ পুলিশের ওপর হামলা চালায়। চাপাতি দিয়ে এলোপাতাড়ি কোপাতে গিয়ে চার পুলিশ সদস্য আহত হন। নেতৃত্ব দেয় ল্যাংড়া হাসান, ফরহাদ ও চিকু শাকিল। পুলিশের ভাষ্যমতে, হামলায় ৩০-৪০ জন কিশোর অংশ নেয়।

গত ১৪ মে রাত পৌনে ২টার দিকে মোহাম্মদপুরের জাফরাবাদ এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের হামলায় এক পরিবারের সাতজন গুরুতর আহত হন। স্থানীয় রাব্বি নামের এক যুবক দুই কিশোরকে সন্দেহজনক অবস্থায় জিজ্ঞেস করলে তাদের সঙ্গে বাগবিতণ্ডা হয়। পরে ১৫-২০ জনের একটি দল দেশিয় অস্ত্র নিয়ে এসে প্রথমে রাব্বিকে, পরে তার পরিবারকে একে একে কুপিয়ে জখম করে।

১২ জুলাই বিকেল পাঁচটার দিকে রাজধানীর পল্লবীর আলব্দিরটেক এলাকায় এ কে বিল্ডার্স নামের একটি আবাসন নির্মাণ প্রতিষ্ঠানে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটে। প্রতিষ্ঠানের কাছে পাঁচ কোটি টাকা চাঁদা দাবি করা হয়েছিল। দাবি পূরণ না করায় একদল সন্ত্রাসী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এসে হামলা চালায়। হামলাকারীরা এ সময় চার রাউন্ড গুলি ছোড়ে। গুলিতে শরিফুল ইসলাম নামে প্রতিষ্ঠানের এক কর্মকর্তা আহত হন। ঘটনার বিষয়টি প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা এবং পুলিশ নিশ্চিত করে।

গত ১ সেপ্টেম্বর রাত ১১টার দিকে রাজধানীর আদাবরের সুনিবিড় হাউজিং এলাকায় পুলিশের ওপর হামলা চালায় স্থানীয় কিশোর গ্যাং ‘কবজি কাটা’ গ্রুপ। এ সময় গ্রুপের সদস্য জনি ও রনি ধারালো অস্ত্র দিয়ে পুলিশ সদস্য আল-আমিনকে কুপিয়ে গুরুতর জখম করে। আহত আল-আমিন বর্তমানে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। স্থানীয়রা জানান, জনি ও রনি দীর্ঘদিন ধরে বালুর মাঠ এলাকায় প্রভাব বিস্তার করে পুরো এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে।

ঢাকার বাইরে গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও সাভারে রয়েছে অন্তত ১০০টি কিশোর গ্যাং। এর বাইরে চট্টগ্রামে ৫৭টি গ্যাংয়ে ৩১৬ জন সদস্য সক্রিয় রয়েছে।  

কি বলছেন ভুক্তভোগীরা-
মোহাম্মদপুর এলাকার কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে এই এলাকার কিশোর গ্যাংয়ের নিয়ন্ত্রণ ছিল আওয়ামী লীগের নেতাদের হাতে। তারা কিশোর অপরাধীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিতেন। গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ওই কিশোরেরা ভোল পাল্টে বিএনপির কর্মসূচিতে সক্রিয় হচ্ছে।  

মিরপুরের পল্লবী এলাকার স্থানীয়রা অভিযোগ করে বলেন, আওয়ামী লীগের শাসনামল থেকেই মিরপুর এলাকার সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ীরা সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, মাদক কারবার, ছিনতাই ও টার্গেট কিলিংয়ে অতিষ্ঠ ছিলেন। সাম্প্রতিক ছাত্র-গণআন্দোলনে সরকারের পতনের পর নতুন গডফাদারদের ছত্রছায়ায় এসব সন্ত্রাসী গ্রুপ আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।

ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, কিশোর গ্যাংয়ে মেয়েদের সম্পৃক্ততা বাড়ছে। তারা সাধারণত তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার, মাদক সরবরাহ, অর্থ সংগ্রহ, যোগাযোগ রক্ষা, ইভটিজিং, গ্যাংয়ের সদস্যদের জন্য খাবার সরবরাহ, এবং গ্যাংয়ের সদস্যদের জন্য সুরক্ষা প্রদানসহ বিভিন্ন ভূমিকা পালন করে। তবে, তাদের ভূমিকা সাধারণত গ্যাংয়ের পুরুষ সদস্যদের তুলনায় কম সক্রিয় এবং সহায়ক ধরনের হয়ে থাকে। তাদের দাবি, সরকার যেন দ্রুত এসব গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়।

গ্যাং সদস্য বা সাবেক সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা সবাই সাধারণত নিম্নবিত্ত বা সুবিধাবঞ্চিত পরিবার থেকে উঠে আসা। পারিবারিক অবহেলা, মানসিক নিপীড়ন, স্কুলে অমনোযোগিতা, বন্ধুদের প্রভাব ও অর্থের লোভ তাদের অপরাধে জড়াতে প্ররোচিত করেছে। অনেকেই জানান, গ্যাংয়ে যোগ দেওয়ার আগে তারা মাদকাসক্তি, স্কুলে ঝরে পড়া বা পারিবারিক অশান্তির শিকার ছিলেন।

আইনের ফাঁক ব্যবহার করছে অপরাধীরা-
বাংলাদেশ লিগাল অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন চেয়ারম্যান ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট ইব্রাহিম খলিল মজুমদার বাংলানিউজকে বলেন, ১৬ বছরের নিচে সব শিশু আইনের দৃষ্টিতে কিশোর হিসেবে বিবেচিত হয়। এদের যেকোনো অপরাধের ক্ষেত্রে আদালত চাইলে জামিনে মুক্তি দিতে পারেন। এমনকি হত্যা মামলার মতো গুরুতর অপরাধেও সর্বোচ্চ শাস্তি নির্ধারণ করা আছে ১০ বছর। আদালত সাধারণত মনে করেন, প্রথম ও দ্বিতীয়বার অপরাধ করলে শিশুদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে তাদের জামিনে মুক্তি দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার সুযোগ দেওয়া উচিত।

তবে এই সুযোগকে অনেক সময় ‘আইনের ফাঁক’ হিসেবে ব্যবহার করছে অপরাধীরা। কিশোর পরিচয়ের আড়ালে তারা বড় অপরাধ করেও পার পেয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে বড় অপরাধীরা শিশুদের সামান্য অর্থ দিয়ে ব্যবহার করছে নানা অপরাধে। এতে প্রকৃতপক্ষে শিশুরা আইনের সুরক্ষা পেলেও, অপরাধীরা এই সুবিধা নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগাচ্ছে।

এই আইনজীবী আরও বলেন, কিশোরদের মধ্যে অধিকাংশই আকস্মিকভাবে অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। হেভিচুয়াল বা অভ্যাসগত অপরাধী কিশোর খুব কমই থাকে। কিন্তু বড় অপরাধীরা এই শিশুদের ব্যবহার করেই অপরাধ ঘটাচ্ছে। শুধু অপরাধ জগতে নয়, রাজনীতিতেও কিশোরদের ব্যবহার করার নজির রয়েছে। বিশেষ করে হামলা, মামলা কিংবা মব তৈরির ঘটনায় এদের জড়িত করা হয়েছে বলে অভিযোগ আছে। আইন অনুযায়ী শিশু অপরাধীদের জেলে না পাঠিয়ে সংশোধনাগারে রাখা হয়। উদ্দেশ্য থাকে—তাদের পুনর্বাসন। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, অনেক কিশোর সংশোধনের পরিবর্তে সংশোধনাগার থেকেই বড় অপরাধী হয়ে বেরিয়ে আসে। ফলে আইন ও বিচারব্যবস্থার উদ্দেশ্য সফল না হয়ে বরং উল্টো ফল বয়ে আনছে।

অপরাধ বিশ্লেষক ড. জিয়া বলেছেন, কিশোর বয়সী ছেলেমেয়েরা প্রভাবিত হয় সহজে। তাদের নতুন করে সবকিছু বুঝতে শেখার এই সময়টাতেই যদি ‘ক্ষমতা’ বিষয়টি তাদের মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া যায়, তবে তারা সহিংসতাকেই হাতিয়ার মনে করে। এখনকার কিশোররা উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে পশ্চিমা সংস্কৃতিতে আকৃষ্ট হচ্ছে এবং সেই সংস্কৃতি নিজেদের মধ্যে ধারণ করার চেষ্টা করছে। কিন্তু এই জায়গায় তারা ব্যর্থ হচ্ছে। যে সংস্কৃতি তারা গ্রহণ করতে চাচ্ছে সেটা পুরোপুরি নিতে পারছে না। অন্যদিকে যারা নিচ্ছে তারাও এটার সদ্ব্যবহার করতে পারছে না। যার ফলে সমাজে এর কু প্রভাব পড়ছে এবং কিশোর অপরাধ বাড়ছে।

তার মতে, শিশুদের ভবিষ্যৎ রক্ষায় আইনগত সুযোগ রাখা হলেও এর অপব্যবহার রোধে কঠোর নজরদারি জরুরি। অন্যথায় অপরাধীরা কিশোরদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে আরও ভয়ঙ্কর অপরাধ ঘটানোর সুযোগ পেয়ে যাবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বাংলানিউজকে বলেন, কিশোর গ্যাংয়ের পৃষ্ঠপোষকদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনা জরুরি। তবে বর্তমানে কৌশল পরিবর্তন করছে। এছাড়া সমাজের বিভিন্ন স্তরে যে ব্যত্যয়গুলো রয়েছে সেগুলো সংশোধন করা প্রয়োজন। কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যবস্থায় ঘাটতি আছে। আইনের বিষয়গুলোয় আরও কিছু সংযোজন-বিয়োজন প্রয়োজন। পাশাপাশি যারা সমাজের দায়িত্বশীল নাগরিকদের তাদের এগিয়ে আসা দরকার।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) উপ-পুলিশ কমিশনার (মিডিয়া) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, কিশোর গ্যাং সদস্যদের নির্দিষ্ট সংখ্যা বলা কঠিন। বর্তমানে অনেক অপরাধী কিশোর গ্যাংয়ের নাম দিয়ে অপরাধ করে যাচ্ছে। কিন্তু আক্ষরিক অর্থে তারা কিশোর নয়। কিশোর গ্যাংসহ রাজধানীর অপরাধ নিয়ন্ত্রণে টহল কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। পাশাপাশি গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। অপরাধপ্রবণ এলাকায় অভিযান চালিয়ে কিশোর গ্যাং সদস্যদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে।

এমএমআই/এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।