ঢাকা: ইসলামের কথা বলে মানুষকে বোকা বানিয়ে রাজনীতি করছে ইসলামী ছাত্রশিবির। জামায়াত সমর্থক এই ছাত্র সংগঠন মুখে ধর্মের কথা বললেও সুযোগ পেলেই ছোবল মারে প্রগতিশীল ধারার বিরোধী পক্ষের নেতা-কর্মীদের।
হাত-পায়ের রগ কাটা, গান পাউডার ব্যবহার করে পুড়িয়ে মারা এবং খুনের পর ম্যানহোলে লাশ ফেলে দেয়ার অভিযোগ অনেক আগে থেকেই আছে শিবিরের বিরুদ্ধে।
সর্বশেষ বুধবার রাতে তাদের আদর্শের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। অভিযোগ উঠেছে, শিবির হামলা চালিয়ে হাত-পায়ের রগ কেটে দিয়েছে রাবি ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি আখেরুজ্জামান তাকিমের। তাকিমের শরীরের ছয় জায়গায় জখম ও প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাকে মধ্য রাতে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে নেওয়া হয়েছে।
আশির দশকের গোড়ার দিকে রাবিতে শিবির তাদের জাল বিস্তার করতে শুরু করে। ওই সময়ে ক্যাম্পাসে প্রভাবশালী ছাত্রসংগঠন ছাত্রমৈত্রীর দখলে থাকলেও মসজিদভিত্তিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা শুরু করে শিবির। ধীরে ধীরে ক্যাম্পাস পার্শ্ববর্তী এলাকায় ছাত্রবাসে থাকতে শুরু করে তারা। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মেয়েদের বিয়ে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি নিয়ে অবস্থান শক্তিশালী করে।
![Shibir-zahid Shibir-zahid](../../../images/PhotoGallery/2012November/Shibir-zahid20121121210511.jpg)
১৯৮২ সালের ১১ মার্চ শিবির ক্যাম্পাসে নবীনবরণের আয়োজন করে। ওই কর্মসূচিতে সম্মিলিতভাবে বাধা দেয় বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রমৈত্রী, জাসদ ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নসহ বিভিন্ন প্রগতিশীল সংগঠন। এদিন শিবিরের সঙ্গে প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠনগুলোর সংঘর্ষে তিন ছাত্র মারা যায়। আহত হয় অন্য সংগঠনের অসংখ্য কর্মী। এরপর থেকে প্রভাব বিস্তার করে শিবির। নব্বইয়ের দশকে জামায়াতপন্থি উপাচার্য ইউসুফ আলী শিবিরকে প্রশাসনিক সহায়তা দিয়ে আরও শক্তিশালী করেন। হলগুলোতে সিট দখল করে তাদের কর্মীদের যোগ্যতা না থাকলেও থাকার ব্যবস্থা করেন।
১৯৯২ সালে শিবির ক্যাডাররা রাবির নবাব আবদুল লতিফ হলের বিভিন্ন কক্ষ গান পাউডার দিয়ে আগুনে পুড়িয়ে দেয়। পরের বছর শিবির বিশ্ববিদ্যালয়ের সব আবাসিক হলে রাতের আঁধারে অতর্কিত হামলা চালিয়ে ছাত্রলীগসহ বিভিন্ন প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠন, সাংস্কৃতিক কর্মীসহ অসংখ্য সাধারণ ছাত্রকে মারাত্মকভাবে আহত করে।
এরপর থেকেই শিবির ক্যাম্পাসসহ বিভিন্ন আবাসিক হলগুলোতে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও দখলদারির রাজত্ব কায়েম করে।
ক্যাম্পাস সূত্র জানায়, বুধবার রাতে তাকিমের ওপর হামলা চালিয়ে যাওয়ার সময় হামলাকারীরা ‘নারায়ে তকবির’ স্লোগান দিয়ে চলে যায়।
![Shibir-zahid Shibir-zahid](../../../images/PhotoGallery/2012November/Shibir-zahid01320121121210502.jpg)
রাবি ছাত্রলীগ নেতা তৌহিদ আল-তুহিন সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, তাকিম জ্ঞান হারানোর আগে বলেছেন, শিবিরের কয়েকজন চিহ্নিত ক্যাডার এই হামলা চালিয়েছে। যাওয়ার সময় তারা ফাঁকা গুলি ছোঁড়ে। এসময় তারা ‘নারায়ে তকবির’ স্লোগান দেয়।
ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক আবু হুসাইন বিপু বলেন, রগ কাটার রীতি শিবিরের। মৌলবাদী এই গোষ্ঠী আশির দশকের মতো ক্যাম্পাসে তাণ্ডবলীলা চালানোর পাঁয়তারা শুরু করেছে।
পুলিশও বলছে হামলার সঙ্গে শিবিরের সম্পৃক্ততার কথা।
রাজশাহীর মতিহার থানার ওসি সানাউল হক বলেন, রাত ৮টার দিকে তাকিমসহ কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতা খালেদা জিয়া হলের সামনে দিয়ে যাওয়ার পথে হামলার মুখে পড়েন। অজ্ঞাত পরিচয় ছয় যুবক তিনটি মোটর সাইকেলে পথরোধ করে প্রথমে হাতুড়ি দিয়ে পেটায় তাকে। পরে বাম হাত ও বাম পায়ের রগ কেটে দিয়ে চলে যায়।
এঘটনার প্রতিবাদে রাতেই রাজশাহী শহরের ঘোষপাড়া এলাকায় শিবির নিয়ন্ত্রিত রেটিনা কোচিং সেন্টারে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করে বিক্ষুব্ধ ছাত্রলীগকর্মীরা। একই সময়ে লক্ষ্মীপুর মোড়ে অবস্থিত ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে হামলা চালায়। এসময় হামলাকারীরা একটি মোটরসাইকেলে আগুন ধরিয়ে দেয়।
গত ১১ অক্টোবর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতা ইমরান হোসেন ডেভিড এবং ২৪ অক্টোবর মাহবুব আলম রতন নামের দু’জনকে পিটিয়ে জখম করা হয়েছিল।
মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি শফিকুর রহমান কিটু বাংলানিউজকে বলেন, “রাতের আঁধারে ছাত্রশিবির এ চোরাগোপ্তা হামলা চালচ্ছে। তাকিমের কিছু হলে এর দায় শিবিরকেই নিতে হবে। ”
আশির দশকে শিবিরের উত্থানের পর বিরোধী ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীদের রগ কাটার ইতিহাস অনেক পুরনো।
২০১০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি রাতে রাবির হলে হামলা চালিয়ে ব্যাপক তাণ্ডব চালায় শিবির। এসএম হলের ছাত্র ছাত্রলীগকর্মী ফারুক হোসেনকে খুন করে তার লাশ ম্যানহোলে ফেলে দেয়। এসময় শিবির হাত-পায়ের রগ কাটে চার ছাত্রলীগকর্মীর। এরা এখনও সুস্থ জীবনে ফিরতে পারেনি।
সূত্র জানায়, রগ কাটার জন্য বিশেষ ধরনের ধারালো অস্ত্র ব্যবহার করে শিবির। ধনুকের মত বাঁকানো এই অস্ত্রে রগ কাটে সহজে।
রাবি ক্যাম্পাসের ছাত্রলীগসহ বিভিন্ন প্রগতিশীল সংগঠনের প্রাক্তন নেতারা জানান, একাত্তরের বর্বরতার মতো মানুষ মেরে ম্যানহোলে পুঁতে রাখাও শিবিরের স্বভাব।
ভূ-তত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. এস তাহের আহমেদকে হত্যা করে বাসার ম্যানহোলে ফেলে রাখা হয়। এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে শিবিরের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাবেক সভাপতি মাহবুবুল আলম সালেহীর বিরুদ্ধে। ২০০৬ সালে রাবি ক্যাম্পাসে ড. তাহেরের বাসার পেছনের সেফটিক ট্যাংক থেকে তার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
ম্যানহোলে ফেলে রাখা হয় ২০১০ সালে শিবিরের হাতে খুন হওয়া গণিত বিভাগের ছাত্র ফারুককে। এদিনও ক্যাম্পাসের বেশ কয়েকটি হলে গান পাউডার দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয় শিবির।
অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউনুস হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ততার অভিযোগ ওঠে দুর্ধর্ষ শিবির ক্যাডার সালেকীনের বিরুদ্ধে। ২০০৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় পার্শ্ববর্তী বিনোদপুর এলাকায় প্রাত:ভ্রমণের সময় বাসার তিনশ` গজ দূরে খুন হন তিনি।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর কারমাইকেল কলেজে রগ কাটাসহ বিভিন্ন নৈরাজ্যমূলক কর্মকাণ্ডের অভিযোগ রয়েছে শিবিরের বিরুদ্ধে।
যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম বন্ধ এবং আটক নেতাদের মুক্তি দাবিতে আন্দোলনরত জামায়াতকর্মীদের সঙ্গে গত দুই সপ্তাহ ধরে সারাদেশে পুলিশের সংঘাত চলছে। এরই জের ধরে অস্থিতিশীল অবস্থা তৈরির জন্য হামলা চলছে বলে মনে করেন ছাত্রনেতারা।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি আউয়াল কবির জয় বলেন, “রগ কাটার ইতিহাস ছাত্রশিবিরের অনেক পুরনো সংস্কৃতি। তাকিমের উপর যেভাবে হামলা চালানো হয়েছে, শিবির ছাড়া কেউ এভাবে হামলা চালাতে পারে না। ”
হামলাকারীদের খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমুলক শাস্তি এবং আইন করে জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবি জানান আউয়াল কবির। পাশাপাশি তিনি দ্রুত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শেষ করারও দাবি করেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৪৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ২২, ২০১২
এমআইএইচ/জেডএম; জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর [email protected]