‘সবুজ পাতার খামের ভেতর
হলুদ গাঁদা চিঠি লিখে
কোন পাথারের ওপার থেকে
আনল ডেকে হেমন্তকে?’
সুফিয়া কামালের এই কবিতাতেই এখন হেমন্ত আবদ্ধ। বাংলা সাহিত্যে, কবিতায় বারবার দেশের ছয় ঋতুর সৌন্দর্য ফুটে উঠলেও এখন ছয় ঋতু কেবল হাতের করেই সীমাবদ্ধ।
এক সময় হাড় কাঁপানো শীত পড়তো এ দেশে। সে কারণে প্রবাদ তৈরি হয়েছিল- ‘মাঘের শীতে বাঘ কান্দে। ’ তবে দিন যত যাচ্ছে, ততো সংক্ষিপ্ত হচ্ছে শীতকাল। চার ঋতুর মধ্য গ্রীষ্মকাল দীর্ঘায়ত হচ্ছে, বর্ষাকাল ছোট হয়ে আসছে। তবে শরৎকাল স্থিতিশীল আছে বলে জানিয়েছেন পরিবেশবিদ অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার।
গিরগিটির মতো আবহাওয়ার এই জটিল পরিবর্তনের চরম মাশুল গুনতে হচ্ছে দেশের মানুষকে, বিশেষ করে দেশের দরিদ্র শ্রেণির মানুষকে।
গত কয়েক বছরের তুলনায় এবার চৈত্রের আগে থেকেই তাপমাত্রা বেড়েছে। ‘অহনতো বাংলা পঞ্জিকাই উল্টাই গেছে, কহন যে আবহাওয়া কি অয় বুজি না, এই ঠাডা পড়ে তো এই রইদ ওঠে, আবার এই দেহি বিষ্টিও হয়। হারাডামাস ভালো বেচা-কিনি করতে পারলাম না’, বলছিলেন ৬০ বছর বয়সী শওকত আলী।
হ্যাঁ, গত কয়েক বছর এই রোদ, এই বৃষ্টির আবহাওয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। আর এ কারণে দিনকে দিন জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা বেড়েই চলেছে। এ বছর মার্চ থেকে গরম পড়তে শুরু করলেও মে মাসে কাঠফাটা গরমে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল সারা দেশ। এর মাঝেই আবার আকাশে মেঘের ঘনঘটা। গত কয়েকদিন লাগাতার বৃষ্টি। নিম্নচাপ আঘাত হানে উপকূলে। গত ২৭ মে উত্তর-পশ্চিম বঙ্গোপসাগরে একটি লঘুচাপ তৈরি হয়েছিলো। সমুদ্র সৈকত এলাকায় অধিকাংশ জায়গায় ভাঙন দেখা দিয়েছে। উপকূলীয় এলাকাগুলোতে ঝড়ো হাওয়া অব্যাহত রয়েছে। টানা ভারী বৃষ্টিতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে নিম্নাঞ্চলের মানুষ। অতিরিক্ত জোয়ারের পানির তোড়ে বিভিন্ন জায়গায় গ্রামরক্ষা বেড়িবাঁধগুলো ভেঙে গেছে।
কী কারণে নিম্নচাপ?
মে মাস ঘূর্ণিঝড়প্রবণ মাস। গত দেড় যুগে (২০০৭ থেকে ২০২৫) এই মাসে ১২বার ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়েছে বঙ্গোপসাগরে। এর আঘাত পড়েছে উপকূলে। তবে এবারের নিম্নচাপে ঘূর্ণিঝড় হয়নি দেশে। এর কারণ হিসেবে মৌসুমি বায়ুর সক্রিয়তার কথা বলছেন আবহওয়াবিদরা। মৌসুমি বায়ু এবার সময়ের আগেই দেশে প্রবেশ করেছে। আর তা অনেকটাই সক্রিয়। এই সক্রিয়তা ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হতে দেয়নি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
মৌসুমি বায়ুর সক্রিয়তার পাশাপাশি লঘুচাপ সৃষ্টি হওয়ার এলাকা এবার ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি না হওয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে—এমনটাই মনে করছেন আবহাওয়াবিদেরা।
মৌসুমি বায়ু বাংলাদেশের টেকনাফ উপকূল দিয়ে সাধারণত প্রবেশ করে ৩১ মে থেকে ১ জুনের মধ্যে। সাম্প্রতিক সময়ে এর অবশ্য ব্যত্যয় হচ্ছিল। স্বাভাবিক সময় থেকে গত প্রায় দেড় দশকে মৌসুমি বায়ু দেরিতে প্রবেশ করতো। এবার ১৬ বছর পর এর ব্যতিক্রম হলো।
তবে মে মাসে ঘূর্ণিঝড় গত দেড় দশকে প্রায়ই দেখা গেছে। এই তো গত বছরের ২৬ মে ঘূর্ণিঝড় ‘রিমাল’ আঘাত করেছিল বাংলাদেশের উপকূলে। ২০২৩ সালের ১৪ মে ‘মোখা’, ২০২১ সালের ২৭ মে ‘ইয়াস’, ২০২০ সালের ২১ মে ‘আম্পান’, ২০১৯ সালের ৪ মে ‘ফণি’, ২০১৭ সালের ৩১ মে ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’, ২০১৬ সালের ২২ মে ঘূর্ণিঝড় ‘রোয়ানা’, ২০১৩ সালের ১৬ মে ঘূর্ণিঝড় ‘মহাসেন’, ২০১০ সালের ২১ মে ঘূর্ণিঝড় ‘লায়লা’, ২০০৯ সালের ২৫ মে ঘূর্ণিঝড় ‘আইলা’, ২০০৮ সালের ৩ মে ঘূর্ণিঝড় ‘নার্গিস’, ২০০৭ সালের ১৫ মে ঘূর্ণিঝড় ‘আকাশ’ উপকূলে আঘাত করেছিল।
এসব ঘূর্ণিঝড় তাণ্ডব চালিয়েছে বাংলাদেশের উপকূলে। এতে প্রতিবছরই প্রাণহানি হয়েছে, সম্পদ নষ্ট হয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকার। কিন্তু এবার ‘শক্তি’ নাম নিয়ে যে ঘূর্ণিঝড়ের আসার কথা বলছিল আবহওয়াবিদরা, তার শক্তি আগেই দুর্বল হয়ে গিয়েছে। যে কারণে নিম্নচাপ হলেও ঝড়ের কবল থেকে রক্ষা পেয়েছে দেশ। তবে এটি ইতিবাচক বার্তা হলেও আবহওয়াবিদরা আশঙ্কা করছেন, জলবায়ু পরিবর্তনে বড় ধরনের মাশুল দিতে হবে বাংলাদেশকে। সম্প্রতি বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ জলবায়ু নিয়ে নতুন শঙ্কার জানান দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) আর্থ, অ্যাটমোসফিয়ারিক এবং প্ল্যানেটারি সায়েন্সেস বিভাগের একদল গবেষক। তারা বলছেন, বাংলাদেশে বড় ধরনের ঘূর্ণিঝড়ের ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। আগে যে ধরনের বড় ঝড় ১০০ বছরে একবার হতো, এখন তা ১০ বছরেই হতে পারে। এই ঝুঁকি অঞ্চল ও মৌসুমভেদেও ভিন্ন হতে পারে।
আবহাওয়াবিদ ড. মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক বলেন, বে অব বেঙ্গলে ২০১৪ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বর্ষাকাল ৭০ শতাংশ হয় জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বর্ষা পরবর্তী মৌসুম অক্টোবর থেকে নভেম্বর ২১ শতাংশ, মার্চ থেকে মে তে হয় মাত্র ৬ শতাংশ, ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারিতে হয় ৫ শতাংশ।
১৮৯১ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত মোট ৭১৫টি মৌসুমি নিম্নচাপ সৃষ্টি হয়েছে, এর মধ্যে জুন মাসে ৭৪টি। জুলাইয়ে ১০৭টি, আগস্টে ১৫৭টি, সেপ্টেম্বরে ১২৮টি, অক্টোবরে ১০৪টি, নভেম্বরে ৫০টি, ডিসেম্বরে ৩৫টি, জানুয়ারিতে ১২টি, ফেব্রুয়ারিতে ৫টি, মার্চে ৪টি, এপ্রিলে ৮টি এবং মে মাসে ৩০টি। অর্থাৎ ডাটা অনুযায়ী দেশে সবচাইতে বেশি নিম্নচাপ হয়েছে আগস্ট মাসে।
আবুল কালাম জানান, বিশ্ব উষ্ণায়ণের ফলে সারা পৃথিবীতে বায়ুমণ্ডলের আবর্তনের পরিবর্তন হয়েছে। আর সেটার ফলেই দিনের পর দিন মৌসুমি নিম্নচাপ বঙ্গপোসাগরে কমে যাচ্ছে। আবহাওয়ার এই নেতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে শঙ্কা রয়েছে বলেও সতর্ক করেন তিনি।
তিনি বলেন, চরম ভাবাপন্ন আবহাওয়া তৈরি হয়েছে। ঝড়ের সংখ্যা কমলেও অতি প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড়ের প্রবণতা বঙ্গোপসাগরে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
কেন হচ্ছে ঋতুর এ পরিবর্তন?
উন্নয়নের নামে উন্নত দেশগুলোর কার্বন নিঃসরণ জলবায়ু পরিবর্তনে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে বলে মনে করছেন পরিবেশবিদরা।
আবহাওয়াবিদ আবুল কালাম বলেন, উন্নয়নের গতি বাড়াতে গিয়ে বিশ্বে ৩৫ শতাংশ কার্বন নিঃসরণ করছে চীন, ৭ শতাংশ ভারত, আমেরিকা ১৫ শতাংশ ও রাশিয়া ৫ শতাংশ। আর এ কারণেই উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, কমে আসছে ঋতু। বাংলাদেশ হারাচ্ছে প্রকৃতিক সম্ভার।
মাইক্রো ক্লাইমেটিক চেইঞ্জ (ক্ষুদ্র জলবায়ু পরিবর্তন) দেখা যাচ্ছে। আগে মেঘের পরিমাণ বেশি থাকতো, এটার কারণ অনেক বেশি জলাধার ছিল, যেখান থেকে জলীয়বাষ্প উৎপন্ন হয়ে মেঘ থেকে বৃষ্টি হতো। এখন আর তা হয় না বলে জানান পরিবেশবিদ অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার। তিনি আর জানান, গত ২৫ বছরে রাজধানীতে সবুজের পরিমাণ ৬-৭ শতাংশে নেমে এসেছে, যা পরিবেশকে বিপর্যস্ত করে তুলছে।
ঋতুর পরিবর্তনের বৈচিত্র্য হারাচ্ছে প্রকৃতি
যদি যথাসময়ে ঋতুর আগমন হতো তাহলে প্রকৃতিতে আগে যে বৈচিত্র্য দেখা যেত, সেটা অপরিবর্তিত থাকতো। কিন্তু এখন প্রকৃতির রূপ-রঙেও ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে বলে জানান আবুল কালাম।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন বলেন, ঋতুর সাথে প্রকৃতির যোগসাজশ রয়েছে। যেমন বৃষ্টিতে কদম ফুল দেখতে পাই আমরা। কালবৈশাখী শুরু হলেই মাঠে সবুজ ঘাস জন্মাতো। তবে এখন তা আমরা দেখতে পাই না। আবার আগাম বৃষ্টির কারণে একুয়াটিক প্লান্টের গ্রোথ (জলজ উদ্ভিদের বৃদ্ধি) তাড়াতাড়ি হচ্ছে।
আবহাওয়ার সঙ্গে সমঝোতা
আবহাওয়ার এ পরিবর্তনকে চ্যালেঞ্জ করা বাংলাদেশের জন্য দুষ্কর বলে মনে করেন পরিবেশবিদ আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার। তিনি বলেন, আবহাওয়ার সঙ্গে সমঝোতা করেই এখন টিকে থাকতে হবে। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয় বৈশ্বিকভাবে মোকাবিলা করতে হবে। জীবাশ্ম জ্বালানি কমিয়ে আনতে হবে, সবুজের পরিমাণ বাড়াতে হবে। আমাদের কার্বন নিঃসরণ কম কিন্তু দূষণ বেশি। বিদ্যুৎ প্রকল্প, ইটভাটাগুলোর কারণে সর্বোচ্চ মূল্য দিতে হচ্ছে দরিদ্র শ্রেণির মানুষকে। তাই স্থানীয় পর্যায়ে দূষণ কমানোর পরামর্শ দেন কামরুজ্জমান।
এজে/এমএম