ঢাকা, বুধবার, ১৭ আষাঢ় ১৪৩২, ০২ জুলাই ২০২৫, ০৬ মহররম ১৪৪৭

বাংলানিউজ স্পেশাল

ফিরে এলো মহাকাব্যিক রক্তিম জুলাই

ফাহিম হোসেন, ইউনিভার্সিটি করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২:০৩, জুলাই ১, ২০২৫
ফিরে এলো মহাকাব্যিক রক্তিম জুলাই ফাইল ছবি

ঢাকা: ঠিক এক বছর আগে, জুলাইয়ের এই দিনে কোটা সংস্কার আন্দোলন শক্তিশালী হতে শুরু করে। কে জানতো, সরকারি চাকরিতে কোটা প্রথা সংস্কারের দাবিতে একটি সাধারণ আন্দোলন রূপ নেবে বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় গণঅভ্যুত্থানে।

ছাত্র-জনতার ওই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে শেখ হাসিনার দীর্ঘ ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসান হয়েছিল।

বছর ঘুরে আবারও ফিরে এলো সেই মহাকাব্যিক রক্তিম জুলাই। গত বছর কোটা সংস্কার আন্দোলনটি অবশ্য শুরু হয়েছিল তারও আগে। সরকারি দপ্তর, স্বায়ত্তশাসিত ও আধা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন করপোরেশনের চাকরিতে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল করে ২০১৮ সালে যে পরিপত্র জারি করা হয়, ৫ জুন সে পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন হাইকোর্ট।  

রায় ঘোষণার পরপরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে বৈঠক করেন এবং রায় বাতিলের দাবি জানিয়ে বিক্ষোভ মিছিল করেন।  

পরে ৬ জুন কোটা প্রথা বাতিলের দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে থেকে মিছিল করেন শিক্ষার্থীরা। একইদিন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন।  

এভাবে কয়েকদিন কর্মসূচি পালনের পর ৩০ জুন পর্যন্ত আল্টিমেটাম দেন আন্দোলনকারীরা। ঈদের ছুটির কারণে আন্দোলন কিছুটা স্তিমিত হয়ে পড়লেও ১ জুলাই থেকে তা শক্তিশালী হতে থাকে। শিক্ষার্থীরা ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ নামে একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেন। তারা শাহবাগ থেকে বাংলা ব্লকেড কর্মসূচি দেন এবং ঢাকাসহ সারাদেশ অচল করে দিতে শুরু করেন।  

এই আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে গড়ে ওঠা ‘গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি’ নামে সংগঠনের অধিকাংশ শীর্ষ নেতা যুক্ত ছিলেন। এ ছাড়া ক্যাম্পাসের বিভিন্ন ক্রিয়াশীল সংগঠন, অ্যাক্টিভিস্ট ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যুক্ত হন।  

আন্দোলনকে রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ রাখতে ছাত্রসংগঠনের শীর্ষ নেতাদের এই প্ল্যাটফর্মের বাইরে রাখা হয়।  

১৪ জুলাই রাতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোটা নিয়ে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্য করে বলেন, (কোটা) মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিরা পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতি-পুতিরা পাবে? শেখ হাসিনার এমন মন্তব্যে ফুঁসে ওঠেন শিক্ষার্থীরা। তারা মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মিছিল বের করেন এবং প্রথম সরাসরি ছাত্রলীগের সঙ্গে সংঘাতে জড়ান।  

১৫ জুলাই নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগ এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালায়। এতে অন্তত তিনশ’র বেশি শিক্ষার্থীর মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থান ফেটে যায়। এদিন নারীদের ওপর ভয়াবহ নির্যাতন চালানো হয়।  

আন্দোলন ভিন্ন মোড় নেয় ১৬ জুলাই। এদিন পুলিশের গুলিতে প্রথম শহীদ হন রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ। দুই হাত পেতে দাঁড়িয়ে থাকা নিরস্ত্র সাঈদের বুকে একেবারে সামনে থেকে গুলি করে পুলিশ। যার ভিডিও মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।

আবু সাঈদের হত্যাকাণ্ড আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি পাল্টে দেয়। এ সময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচি ও পরিকল্পনার সরাসরি জড়িত ছিলেন সমন্বয়ক আব্দুল কাদের।  

এক সাক্ষাৎকারে তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ১৬ তারিখ যখন আমরা খবর পেলাম সারাদেশে ছয়জন শহীদ হয়েছেন। আমরা একটা মিটিং ডাকলাম। আমরা অ্যাজেন্ডা সেট করলাম, ছয়টি লাশ পড়ে যাওয়ার পর আন্দোলন কী কোটায় সীমাবদ্ধ থাকে?

সবাই একমত হলো, এর পরিসর আর কোটায় নেই। বিচ্ছিন্ন কিছু দাবি-দাওয়া এলো। যেমন পুলিশ যেহেতু গুলি করেছে, তাই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগ, স্থানীয় ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগকে শাস্তির আওতায় আনা। তবে গোছানো কিছু হয়নি।

তিনি বলেন, এ সময় সরকার থেকে নানা সূত্রে শিক্ষার্থীদের আলোচনায় বসতে চাপ দেওয়া হয়। ডিজিএফআই শিক্ষার্থীদের সংবাদ সম্মেলন করতে বলে। কিন্তু আমরা সংবাদ সম্মেলন না করে প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিলাম এবং উল্লেখ করলাম ‘সরকারই উদ্ভূত সমস্যার জন্য দায়ী এবং সরকারকেই সমাধান করতে হবে’।  

এরপর দেশের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলন, সহিংসতা, আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশ এবং আওয়ামী লীগসহ তার অঙ্গসংগঠন আন্দোলনকারীদের ওপর নৃশংস হামলা চালায়।

১৯ জুলাই ৯ দফা ঘোষণা করেন আব্দুল কাদের। এরপর ইন্টারনেট শাটডাউন, ডিবি হেফাজতে সমন্বয়কদের আটক ও তাদের মুক্তি দাবিতে আন্দোলন গোটা দেশকে উত্তপ্ত করে। এর মধ্যে বাড়তে থাকে লাশের মিছিল। শেখ হাসিনার লেলিয়ে দেওয়া নিরাপত্তা বাহিনী ও আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের সশস্ত্র ক্যাডারদের গুলিতে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আন্দোলনকারীদের নিহত হওয়ার খবর আসতে থাকে। এই প্রেক্ষাপটে ৩ আগস্ট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শেখ হাসিনার পদত্যাগের এক দফা ঘোষণা হয়। তারপরও অস্ত্রের জোরে তিনি ক্ষমতায় থাকতে চাইলে ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতা রাজপথ দখলে নেয়, শেখ হাসিনা জনরোষ থেকে বাঁচতে পালিয়ে ভারতে চলে যান।

জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তরের (ওএইচসিএইচআর) তদন্ত প্রতিবেদন অনুসারে, জুলাই অভ্যুত্থানে জুলাই-আগস্ট মাসে সাড়ে ১৪শ’র ওপর মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। অধিকাংশই নিহত হয়েছেন রাইফেল এবং শটগানের গুলিতে এবং এই সময়ে নিরাপত্তা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সমন্বয় কাজে নেতৃত্ব দিয়েছেন তখনকার প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তাদের নির্দেশেই এই হত্যাকাণ্ড হয়েছে।  

মঙ্গলবার এই অভ্যুত্থানের এক বছর পূর্ণ হয়েছে। বর্ষপূর্তি উপলক্ষে ইতোমধ্যে অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন মাসব্যাপী নিজেদের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে।  

জুলাই অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে মাসব্যাপী কর্মসূচি দিয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি। ১ থেকে ৩০ জুলাই পর্যন্ত তারা  ‘দেশ গড়তে জুলাই পদযাত্রা’ নামে কর্মসূচি পালন করবে। এ ছাড়া ১৬ জুলাই ‘বৈষম্যবিরোধী শহীদ দিবস’ উপলক্ষে দোয়া-মাহফিল ও স্মরণসভা, ৩ আগস্ট শহীদ মিনারে ছাত্র জনতার জুলাই ঘোষণাপত্র ও ইশতেহার পাঠ ও ৫ আগস্ট ‘ছাত্র জনতার মুক্তি দিবস’ উদযাপন করবে দলটি।  

অভ্যুত্থানের বর্ষফূর্তি উপলক্ষে মাসব্যাপী কর্মসূচি দিয়েছে বিএনপিও। ৩০ জুন শহীদ মিনারে (রাত) ছাত্রদলের উদ্যোগে আলোয় আলোয় স্মৃতি সমুজ্জ্বলের মধ্য দিয়ে এই কর্মসূচি শুরু হবে।  

পরে আলোচনা সভা, রক্তদান, গ্রাফিতি, পথনাটক, ফুটবল টুর্নামেন্ট, শিশু অধিকারবিষয়ক অনুষ্ঠান, ডেঙ্গু ও করোনা প্রতিরোধে জনসচেতনতামূলক কার্যক্রমসহ ২২টি ভিন্নধর্মী আয়োজনের মাধ্যমে ‘জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থান’কে স্মরণ করবে বিএনপি। ৬ আগস্ট পর্যন্ত এসব কর্মসূচি চলবে।  

মাসব্যাপী কর্মসূচি দিয়েছে জামায়াতে ইসলামীও। ১ জুলাই অভ্যুত্থানের শহীদ, আহত ও পঙ্গুত্ববরণকারীদের জন্য দেশব্যাপী দোয়া করার মধ্য দিয়ে এই কর্মসূচি শুরু হবে। এরপর ২ থে‌কে ৪ জুলাই দরিদ্র, অসহায়, দুস্থ ও এতিমদের মধ্যে খাবার বিতরণ করা হ‌বে। ৮ থে‌কে ১৫ জুলাই শহীদ প‌রিবার এবং আহতদের স‌ঙ্গে সাক্ষাৎ, মতবিনিময় ও দোয়া করা হ‌বে।

১৬ জুলাই শহীদ আবু সাঈদ স্মরণে রংপুরে আলোচনা সভার আ‌য়োজন কর‌বে জামায়াত। এ ছাড়া ১৯ জুলাই জামায়া‌তের ৭ দফা বাস্তবায়নে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জাতীয় সমাবেশ করা হ‌বে। একই দি‌নে শহীদ পরিবারের অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন জামায়াত আমির।

এ ছাড়া সভা-সিম্পোজিয়াম, তথ্যচিত্র প্রদর্শনী ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, আলোকচিত্র প্রদর্শনীসহ একাধিক কর্মসূচি রয়েছে জামায়াতের। ৫ আগস্ট দেশব্যাপী গণমিছিলের ঘোষণা দিয়েছে দলটি।  

এ ছাড়া ছাত্রশিবির, আপ বাংলাদেশসহ একাধিক সংগঠনের পক্ষ থেকে অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে মাসব্যাপী কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে।  

এফএইচ/আরবি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।