ঢাকা, বুধবার, ২৮ মাঘ ১৪৩১, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২ শাবান ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

সরেজমিন অনুসন্ধানী প্রতিবেদন

‘অপরাজিতা’ গণধর্ষণ: নারীরা ছিলেন নাইওরে!

আহমেদ রাজু, রানা রায়হান, সুমন রায়, এসএম শহীদ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৩৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৭, ২০১৩
‘অপরাজিতা’ গণধর্ষণ: নারীরা ছিলেন নাইওরে!

(গণধর্ষণের ঘটনার ওপর অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরি করতে বাংলানিউজের ইনভেস্টিগেটিভ টিম যায় টাঙ্গাইলে। এই টিমে ছিলেন বিশেষ প্রতিনিধি ও চিফ অব করেসপন্ডেন্টস আহমেদ রাজু, আউটপুট এডিটর রানা রায়হান, চিফ ফটো করেসপন্ডেন্ট জীবন আমীর।

তাদের সঙ্গে ছিলেন টাঙ্গাইল জেলা প্রতিনিধি সুমন রায় ও মধুপুর প্রতিনিধি এসএম শহীদ। )

মধুপুর, টাঙ্গাইল থেকে ফিরে: ‘অপরাজিতা’ (মেয়েটির আসল নাম নয়) গণধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন বোকারবাইদ গ্রামে। সেই গ্রামটিতে এখন বিরাজ করছে নির্জন-নীরবতা। গ্রামের বেশির ভাগ বাড়িতেই পুরুষ মানুষ নেই। পুলিশের ভয়ে তারা পালিয়ে গেছেন। আছে কেবল নারী ও শিশুরা। পুরো গ্রাম ঘুরে পুরুষ মানুষ তেমন চোখে পড়ে নি।

গণধর্ষণের খবর প্রকাশ হওয়ার পর গ্রেফতার হন এসএম নুরুজ্জামান ওরফে গেদাসহ চার ধর্ষক। গত শুক্রবার বেলা ১২টার দিকে গেদার বাড়িতে যায় বাংলানিউজের ইনভেস্টিগেটিভ টিম। মধুপুর থেকে ময়মনসিংহের দিকে ৮ কিলোমিটার দূরে ইদিলপুর বাজার। এই বাজারেই গেদার মোবাইল সার্ভিসিং ও রিচার্জিংয়ের দোকান। সেখান থেকে আরো কিছুদূর উত্তরে যাওয়ার পর পশ্চিম দিকে কিলোমিটার খানেক ভেতরে বোকারবাইদ গ্রাম।

jibon-3-পাহাড়ি এলাকা হওয়ায় গ্রামটির সঙ্গে ইদিলপুরের যোগাযোগ ব্যবস্থা দুর্গম। গ্রামটিতে যাওয়ার রাস্তা কাঁচা। রাস্তা কাঁচা হওয়ায় গ্রামটির সঙ্গে মধুপুরের ভালো যোগাযোগ গড়ে ওঠে নি। রিকশাভ্যান ছাড়া বোকারবাইদ গ্রামে যাওয়ার অন্য কোনো বাহন নেই। কাঁচা রাস্তা দিয়ে গ্রামটিতে যাওয়ার পর দেখা যায়, গেদার বাড়িতে সরাসরি গাড়ি যায় না। তাই রাস্তার ওপর গাড়ি রেখে যেতে হয়। গাড়ি থেকে নেমে কয়েকশ’ গজ দক্ষিণ দিকে গেলেই ডান দিকে একটি টিনের বাড়ি। বাড়িটির দক্ষিণে আরেকটি বাড়ি।

বাড়িটির প্রবেশপথের বাঁ দিকে আনারস এবং ডান দিকে কলার বাগান। কলার বাগানে মাটি কাটায় গর্ত হয়েছে। দু’পাশের বাগান পেরিয়ে বাড়িতে ঢুকতেই বাঁ দিকে একটি টিনের ছাপড়া ঘর। তার পশ্চিমে টিনের চালা দিয়ে তৈরি করা হয়েছে একটি রান্নাঘর। তার ডানে চারচালা টিনের ঘর। মাঝখানে ছোট উঠোন। উঠোনে একটি কাঠের বেঞ্চ। পুবদুয়ারি ঘরটির দরজায় তালা। তালাবদ্ধ ঘরটির বাঁ দিকের বারান্দায় উঁচু মাটির ওপর রাখা আছে একটি ভাঙ্গা ট্রাংক। মাঝখানে একটি কাঠের বেঞ্চ। ডান দিকে ঘরের বেড়া ঘেঁষে বাঁধা আছে একটি চিকন তার। সেই তারে টানানো কাপড়চোপড়। শুকোতে দেওয়ার পর এগুলো আর তোলা হয়নি।

বাড়িটিতে আছে দুটো রুম। এ বাড়িতেই গেদা তার স্ত্রী ও দুই জমজ কন্যাকে নিয়ে বাস করেন। সেদিন রাতে বাড়িটির এক রুমে নাচ-গান করছিলেন বীথি ও অন্যরা। পাশের রুমে ‘অপরাজিতা’কে পালাক্রমে ধর্ষণ করে পাষণ্ডরা।

গেদার বাড়ির উত্তর দিকে পাশাপাশি দু’টি বাড়ি। বাড়ি দু’টির একটি বড়, অপরটি ছোট ভাইয়ের। দুই বাড়িতে গিয়েই দেখা যায়, কোনো পুরুষ মানুষ নেই।

গেদা গ্রেফতার হওয়ার পর থেকেই এই গ্রামের পুরুষরা পালিয়ে গেছেন। আশপাশের বাড়িতে খোঁজ নিয়ে গেদার স্ত্রী কিংবা স্বজনদের পাওয়া যায়নি। পাওয়া যায়নি কোনো প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ। সব বাড়িতেই আছে কেবল নারী ও শিশুরা।

পুরুষ মানুষ কোথায় জানতে চাইলে তারা জানান, “বাইত নাই (বাড়িতে নাই)। ” গেদার কথা জানতে চাইলে তারা কিছুই জানেন না বলে দাবি করেন। সেদিন সন্ধ্যায় গেদার বাড়িতে কোনো নারী এসেছিলো কিনা- জানতে চাইলে তারা জানান, “হেইদিন (সেদিন) নাইওর গেছিলাম। ”

মুখে তারা যা-ই বলুন, তাদের হাবভাব-আচরণে মনে হচ্ছিল তারা কিছু লুকোচ্ছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ওই সব বাড়ির নারীরা সেদিন বাড়িতেই ছিলেন। কিন্তু, কেউ মুখ খুলতে চান না। গেদা ছাড়া পেলে যদি তাদের কোনো ক্ষতি করেন, এই ভয়েই কেউ ওই দিনের ঘটনা সম্পর্কে কিছুই বলতে চান না। তাই গণমাধ্যমের কর্মীরা ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলেই তারা বলছেন, “হেইদিন (সেদিন) নাইওর গেছিলাম। ’’

গেদার ভাইদের বাড়ি দু’টি একেবারেই খোলা। বাড়ির চারপাশে কোনো বেড়া নেই। পাশের রাস্তা দিয়ে যে কেউ গেলেই চোখে পড়ে। কিন্তু দুই বাড়ির নারীরা জানান, তারা গেদার বাড়িতে কাউকে আসতে দেখেন নি। এমন কী গান-বাজনার শব্দও তারা শোনেন নি।

গেদার বাড়ির পশ্চিমে আরেকটি বাড়ি। বাড়িটি আফাজ আলীর। আফাজ আলী রিকশা চালান। বাড়িতে ছিলেন আফাজ আলীর স্ত্রী সালিমা খাতুন। তিনিও জানান, ঘটনার দিন তিনি ‘নাইওরে’ ছিলেন। তাই গেদার বাড়িতে কি হয়েছিল তা তিনি জানেন না। তবে তিনি গেদার স্ত্রী সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য করেন। শাস্তি হলে গেদার স্ত্রীর হওয়া উচিত বলে তিনি অভিমত প্রকাশ করেন।

আফাজ আলীর বাড়ির পশ্চিম দিকে মঈন খানের বাড়ি। ওই বাড়িতে গিয়েও কোনো পুরুষ মানুষ পাওয়া যায় নি। ওই বাড়ির নারীরাও একই কথা বলেন, তারা ‌‌‌‌‌‌‍‌সেদিন ‘নাইওরে’‌‌‌‌‌ ছিলেন। তাই এব্যাপারে কিছুই বলতে পারবেন না বলে জানান তারা।

পুরো গ্রাম ঘুরে কোনো পুরুষ মানুষ পাওয়া যায় নি। গ্রামটির নারী ও শিশুদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গেদা গ্রেফতার হওয়ার পর থেকেই গ্রামটির বাসিন্দারা আতঙ্কে আছেন। তাই বেশির ভাগ বাড়িতে পুরুষ মানুষ নেই। সব বাড়িতেই বিরাজ করছে সুনসান নীরবতা।

jibon-বোকারবাইদ গ্রামটির পুরোটাই পাহাড়ি (গড়) এলাকায়। গ্রামটি ঘুরে মনে হয় পুরো গ্রামই যেন একটি আনারস ও কলার বাগান। গ্রামের মাঝখান দিয়ে চলে গেছে ছোট ছোট সরু কাঁচা রাস্তা। তার পাশ দিয়ে ছোট ছোট টিনের বাড়ি। বাড়িগুলোর বেড়াও তৈরি টিন দিয়ে। প্রচুর গাছপালা সুশোভিত গ্রামটিতে এখন ভুতুড়ে পরিবেশ।

গেদার বাড়ি থেকে বের হয়ে বেশ কিছুদূর আসার পর কয়েকজন পুরুষের দেখা মেলে। আলাপকালে তারা জানান, পুলিশের ভয়ে প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ মানুষ বাড়িতে থাকছেন না। কারণ, পুলিশ আশপাশের বাড়িতেও তল্লাশি চালিয়েছে। তাই ভয়ে গ্রামের কেউ বাড়িতে থাকছেন না।

গ্রামের এক বাসিন্দা জানান, গ্রামটির পাহাড়ময় এক এলাকায় আছে একটি বড় খামার বাড়ি। সেখানে আছে সুন্দর বাংলো। খামার বাড়িটি সুন্দরভাবে সাজানো হয়েছে। আছে ফুলের বাগান ও প্রাকৃতিক নৈসর্গিক পরিবেশ। প্রায়ই গান-বাজনা ও নাচ-গানের আয়োজন করা হয়ে ওই খামার বাড়িতে। সেখানে গেদার যাতায়াত ছিল। সেই খামার বাড়িতে মাঝমধ্যেই সুন্দরী তরুণীদের যাতায়াত করতে দেখেছেন গ্রামবাসী। খামার বাড়িতে সাধারণের প্রবেশ নিষেধ। তাই ভেতরে কী হয় তা জানেন না এলাকার বাসিন্দারা। তবে মধুপুরের অনেক প্রভাবশালীও সেখানে যাতায়াত করেন বলে জানা যায়।

মধুপুর থেকে পশ্চিম দিকে কয়েক কিলোমিটার দূরে পশ্চিম জটাবাড়ি। এই গ্রামের বাসিন্দা আরেক ধর্ষক শাহজাহান আলী। তিনি মাদ্রাসা থেকে ফাজিল পাস করেছেন। তারপর তিনি স্ট্যাম্প ভেন্ডরের (স্ট্যাম্প বিক্রেতা) কাজ করেন। এলাকায় তিনি শাহজাহান ভেন্ডর বলে পরিচিত। তারা তিন ভাই ও চার বোন। বাড়িতে আছেন বৃদ্ধ মা, স্ত্রী ও সন্তানরা। এ বাড়িতেও কোনো পুরুষ মানুষ পাওয়া যায়নি। শাহজাহানের স্ত্রী অসুস্থ। ডায়াবেটিস ও কিডনি সমস্যায় ভুগছেন। স্বামী গ্রেফতার হওয়ার পর তিনি আরও অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। শাহজাহানের মা বাংলানিউজকে বলেন, “আমার ছেলে এ কাজ করতে পারে না। তাকে শত্রুতা করে কেউ ফাঁসিয়েছে। ”

তার বাড়িতে যাওয়ার পর গ্রামের অনেক মানুষ ছুটে আসেন। গ্রামবাসীরা তাদের প্রতিক্রিয়ায় বলেন, “আমরা আগে কখনও শাহজাহানের খারাপ কিছুই শুনি নি। তবে তিনি দোষী সাব্যস্ত হলে তার শাস্তিও দাবি করেন তারা। ”

শাহজাহানের বাড়ি থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার পশ্চিমে কুড়িবাড়ি চানপুর। এ গ্রামেও বেশির ভাগ বাড়িতেই নেই পুরুষ মানুষ। এই গ্রামেই আরেক আসামি হারুনের বাড়ি। হারুনরা দুই ভাই। বাড়িতে তার মা ও স্ত্রীকে পাওয়া যায়। হারুনের দুই ছেলে। বড় ছেলের বয়স ৯ বছর, ছোটটির দুই। ছোট ছেলে শারীরিক প্রতিবন্ধী। হাঁটাচলা করতে পারে না। হারুনের মা জানান, সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত হারুন লেখাপড়া করেছে। আর্থিক টানাপোড়েনে তার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। গ্রেফতার হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি সুপ্তি কম্পিউটারে চাকরি করতেন।

হারুনের বাড়িতে গেলে গ্রামের অনেক নারী ও শিশুরা ছুটে আসে। গ্রেফতার হওয়ার পর হারুনের মা ও স্ত্রী মানসিকভাবে ভেড়ে পড়েছেন। তার মা ও স্ত্রী জানান, হারুন এ কাজ করতেই পারে না। তাকে সুপ্তি কম্পিউটার্সের মালিক মনিরুজ্জামান মনি ফাঁসিয়েছেন। তারা জানান, সত্য একদিন বেরিয়ে আসবেই।

মধুপুর থেকে দুই কিলোমিটার পুবদিকে মনিরুজ্জামান মনির বাড়ি। পারিবারিকভাবে তারা বেশ ধনাঢ্য। তার চাচা পৌরসভার চেয়ারম্যান। তাই মধুপুরে তারা খুব প্রভাবশালী। তিনি বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। জাতীয়তাবাদী যুবদলের তিনি তিন নম্বর যুগ্ম-আহবায়ক। স্ত্রী, এক ছেলে এবং এক মেয়ে নিয়ে তার সংসার।

তিনি মধুপুরের সুপ্তি কম্পিউটার্সের মালিক। সেখানে ভিডিও, ছবি তোলা, ভেন্ডর এবং মোবাইলফোন সার্ভিসিং করা হয়। বিএনপি সরকারের আমলে তিনি ঠিকাদারি করতেন।

তার বাড়িতে গিয়ে তার ভাগিনা এবং বড় বোনের সঙ্গে কথা হয়। কথা বলার সময় তার বাড়িতে গ্রামবাসীও জড়ো হয়। তার পরিবারের সদস্যরা জানান, তাকে পরিকল্পিতভাবে এই মামলায় জড়ানো হয়েছে। তিনি কোনোভাবেই এই ঘটনায় জড়িত নয় বলে জানায়, তার পরিবারের সদস্যরা।

গত ৬ ডিসেম্বর মধুপুরের অদূরে গহীন পল্লীতে নিয়ে গিয়ে পালাক্রমে ধর্ষণ করা হয় ‘অপরাজিতা’কে। সেখান থেকে বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। শেষ পর্যন্ত ১০ ডিসেম্বর সকালের দিকে রেললাইনের পাশে অর্ধচেতন অবস্থায় পাওয়া যায় তাকে। এ মুহূর্তে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা চলছে তার।

(ধারাবাহিক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের তৃতীয় অংশ)

বাংলাদেশ সময়: ১৩৪০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৭, ২০১৩
এআর/আরআর, জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর, [email protected]

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।