ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৮ মাঘ ১৪৩১, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১১ শাবান ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

নিরাপদ অবস্থানে মহেশখালীর সন্ত্রাসীরা?

রহমান মাসুদ ও ইলিয়াস সরকার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৩৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৮, ২০১৩
নিরাপদ অবস্থানে মহেশখালীর সন্ত্রাসীরা?

ঢাকা: মহেশখালীর ডাকাত ও সন্ত্রাসীদের নিয়ে বাংলানিউজে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশের পর সেখানকার সন্ত্রাসীদের একটি বিশাল অংশ গা-ঢাকা দিয়ে নীরব রয়েছে। প্রতিবেদন প্রকাশের পর ৠাব, পুলিশসহ সরকারের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো সক্রিয় হয়ে ওঠায় সন্ত্রাসীরা দূর থেকে পরিস্থিতি অনুধাবন করছেন।


সংবাদগুলোতে কোনো কোনো সন্ত্রাসীর নাম না আসায় নিজেরা হাফ ছেড়ে বাঁচছেন বলেও মনে করছে সন্ত্রাসীদের একটি অংশ।

সম্প্রতি কক্সবাজারের উপকূলীয় ওই দ্বীপের দস্যুতা ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নিয়ে বাংলানিউজে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। বাংলানিউজের ইনভেস্টিগেটিভ টিম মহেশখালী অবস্থান কালে সেখানকার সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য খুঁজে পায়। এ বিষয়ে বাংলানিউজে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর পুলিশ, ৠাব ও কোস্টগার্ড ওই এলাকায় ব্যাপক অভিযান শুরু করে। সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও সক্রিয় হয়ে ওঠে। সরকারের ওপর মহল থেকেও বিষয়টি নিয়ে বেশ তদারকি শুরু হয়। ইতোমধ্যে পুলিশ কালারমার ছড়ার পাহাড়ে অভিযান চালিয়ে এলাকার মূর্তিমান ত্রাস বহু মামলার আসামি শীর্ষ কিলার নাজিম উদ্দিন ওরফে নাজু ডাকাতকে গ্রেফতার করেছে। তাকে নিয়ে অভিযান চালিয়ে পুলিশ পাহাড়ে তার অস্ত্র ভাণ্ডারেরও সন্ধান পায়। রাতে এই সন্ত্রাসীকে সঙ্গে নিয়ে অস্ত্র ভাণ্ডারে অভিযান চালালে পুলিশের সঙ্গে নাজু ডাকাত বাহিনীর বন্দুকযুদ্ধ বাধে। এতে ৪ পুলিশ সদস্যসহ এনকাউন্টারে গুরুতর আহত হন এই শীর্ষ কিলার।

বাংলানিউজের সংবাদের সূত্র ধরে পাহাড়ে চলছে একের পর অভিযান। সমুদ্রে দস্যুদের পাকড়াও করতে কোস্টগার্ডও দিন-রাত অভিযান অব্যাহত রেখেছে।

রোমহর্ষক এসব অভিযান দূর থেকে মনিটরিং করছে এলাকার সন্ত্রাসীদের গডফাদার ও দাগী সন্ত্রাসীদের একটি বিশাল অংশও। বাংলানিউজে এসব সন্ত্রাসী গডফাদারদের নাম না আসায় কিংবা নাম আসলেও তাদের দিকে অভিযান তাক না হওয়ায় কখন এই অভিযানে ভাটা পড়বে কিংবা বাংলানিউজের ধারাবাহিক প্রতিবেদনে ভাটা পড়বে তার দিকে তাকিয়ে আছে সন্ত্রাসীদের ওই অংশটি।

এদিকে রিপোর্টের তালিকায় সন্ত্রাসীদের নাম আসা না আসা নিয়ে মহেশখালীতে বাংলানিউজের স্থানীয় প্রতিনিধির কাছে নানা দেন-দরবার ও হুমকি আসছে একটি প্রভাবশালী মহলের পক্ষ থেকে। ওই তদবিরকারীদের দৌঁড় বাংলানিউজের ঢাকা অফিস পর্যন্ত এসে গড়িয়েছে। এ নিয়ে সন্ত্রাসী বাহিনীগুলোর নিজেদের মধ্যে শুরু হয়েছে এক ধরনের কাঁদা ছোড়াছুড়ি। সন্ত্রাসী ও গডফাদারদের ব্যাপারে রিপোর্ট না করতে এবং প্রতিপক্ষের অপরাধ ফিরিস্তি তুলে ধরতে এক পক্ষ অন্য পক্ষের ব্যাপারে নানা লিখিত অভিযোগ পাঠাচ্ছে বাংলানিউজে।
এতে উঠে আসছে অপরাধীদের পরস্পর বিরোধী অন্দর মহলের খবর।

সন্ত্রাসের উত্থান

কালারমার ছড়ায় সন্ত্রাসীদের গ্রুপ, উপ-গ্রুপগুলো মূলত দুই ধারায় বিভক্ত। প্রথম থেকেই সৈয়দ নুর ও জিয়া বাহিনীর হয়ে কাজ করতেন এই সব সন্ত্রাসীরা। এলাকায় এসব সন্ত্রাসীদের উত্থানের বিষয়ে কারিগর হিসাবে কাজ করেন সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত জেলা আওয়ামী লীগ নেতা ওসমান গণি (ওসমান চেয়ারম্যান) এবং কক্সবাজার প্রেসক্লাবের বিএনপিপন্থী সাংবাদিক নেতা জেলা বিএনপি নেতা বর্তমানে কারান্তরীণ রুহুল কাদের বাবুলের গ্রুপ।
এক সময় ইউপি চেয়ারম্যান হওয়ার পর এলাকায় নিজের একক নিয়ন্ত্রণ নেন ওসমান চেয়ারম্যান। পরে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর এলাকায় তার একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা হয়। তার অনুগত লোকজনের হাতে প্রতিপক্ষ খউস্যার গ্রুপের লোকজন অত্যাচারিত ও নিগৃহীত হন। সে সময় এলাকার মূর্তিমান আতঙ্কের নাম ছিল এই ওসমান চেয়ারম্যান। একপর্যায়ে নিগৃহীত ওই গ্রুপটি রাজনৈতিক শেল্টার পেতে বিএনপির আশ্রয় খোঁজে। এ সময় তারা রুহুল কাদের বাবুলকে ব্যবহার করে।

গতবার জামায়াত-বিএনপি সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর কোণঠাসা হয়ে পড়ে ওসমান চেয়ারম্যানের ওই গ্রুপটি। এ সময় এলাকায় সন্ত্রাসের মূল নিয়ন্ত্রণ তুলে নেন বিএনপির এমপি আলমগীর মুহাম্মদ মাহফুজ উল্লাহ ফরিদ। মাইক টানিয়ে কালারমার ছড়া বাজারে একটা বড়সড় সমাবেশ ডেকে প্রকাশ্যে ওসমান চেয়ারম্যান গ্রুপকে বিতাড়িত করে এলাকায় একক আধিপত্য নেওয়ার ঘোষণা দেন তিনি।

ওই সমাবেশে এমপি এই বাহিনীর প্রধান হিসাবে পরিচয় করিয়ে দেন ছাত্রদলের জিয়াউর রহমান ওরফে জিয়াকে। এমপি ফরিদ সেই সমাবেশে ‘এই জিয়া সেই জিয়া, এই জিয়া আমার জিয়া’ বলে নিজের হাতে জিয়ার হাত উঠিয়ে ধরে জনগণকে পরিচয় করিয়ে দেন। এবং এই জিয়ার নেতৃত্বেই এলাকা নিয়ন্ত্রিত হবে বলে ঘোষণা দেন।

সেই থেকে শুরু হয় নৈরাজ্য। জামায়াত-বিএনপি সরকারের পুরো সময় বিদেশে পালিয়ে থাকতে হয় ওসমান চেয়ারম্যানকে। বাড়ির অন্য সদস্যদেরও হতে হয় এলাকাছাড়া। মাঝে মধ্যে এমপি ফরিদ এসে যুবদল-ছাত্রদলের সঙ্গে বৈঠক করে তার জিয়ার সাম্রাজ্য দেখে খুশিমনে ফিরে যান। সে সময় ওসমান চেয়ারম্যানের বাড়িতে লুটপাট চালাতে চালাতে বাড়ির দেয়ালের মাটি পর্যন্ত খুলে নিয়ে গিয়েছিল ওই খউস্যার গ্রুপ। একের পর এক লাশও পড়তে থাকে।

বিএনপি সরকারের শেষের দিকে ওসমান চেয়ারম্যানে অনুপস্থিতিতে এ গ্রুপের নেতৃত্বের দায়িত্ব নিয়ে নিজেদের লোকজনকে আস্তে আস্তে এলাকায় এনে পুরো গ্রুপকে সংগঠিত করার দায়িত্ব নেন নিহত ওসমানের সৎ ভাই মো. সৈয়দ নুর বাঙালি। বিএনপি সরকারের শেষ মুহূর্তে তারাও একটা শক্ত নাড়া দেয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে মোটামুটি এলাকার নিয়ন্ত্রণে চলে আসে এই সৈয়দ নুর বাহিনী। সে সময় ঢাকার ন্যাম ফ্ল্যাট থেকে ৠাবের হাতে গ্রেফতার হন সেই ক্ষমতাধর এমপি আলমগীর ফরিদ। এতে বাবুল চেয়ারম্যান তথা জিয়া বাহিনীর কোমর ভেঙ্গে যায়।

পরে আওয়ামী লীগের বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এলে সৌদি আরব থেকে এলাকায় চলে আসে ওসমান চেয়ারম্যান। এ সময় দ্রুত এলাকা ছেড়ে পালায় জিয়া বাহিনীর একটি বিশাল অংশ। তা সত্ত্বেও শত্রুদের মরণ কামড় দিয়ে চলছিলেন জিয়া। চলে চোরাগোপ্তা হত্যা। একের পর এক বন্দুকযুদ্ধে পরাস্ত হতে থাকে জিয়া বাহিনী। দুই গ্রুপেই পড়তে থাকে একের পর এক লাশ।   জিয়া বাহিনী কৌশল পালটিয়ে সে সময় আয় করা অর্থের একটি বিশাল বাজেট নিয়ে ৠাব, পুলিশের ওপর মহলে ধর্না দিতে থাকে। এক পর্যায়ে সফলও হয় তারা। চট্টগ্রামে ৠাবের হাতে আটক হয়ে পরে কথিত বন্দুকযুদ্ধে মারা যান সৈয়দ নুর। সাধারণ মানুষকে উপকার করতেন- এ রকম একটা আবেগ থেকে সৈয়দ নুরের জানাজায় স্মরণকালের সবচেয়ে বেশি মানুষ জমায়েত হন।

সাধারণ মানুষও ঝুঁকে পড়েন এই বাহিনীর দিকে। সৈয়দ নুর বাহিনীর কমান্ডারের দায়িত্ব নেন বর্তমান মেম্বার নাজিম উদ্দিন ওরফে নাজু। গেল ইউপি নির্বাচনে নিরঙ্কুশ ভোট পেয়ে তিনি মেম্বার নির্বাচিত হওয়ার পর সন্ত্রাসের পথ থেকে কিছুটা হলেও সরে আসেন। বাহিনী চালানোর দায়িত্ব পড়ে ওসমান চেয়ারম্যানের পরিবারের সদস্য কালা জাহাঙ্গীর ও কালাবদার ওপর। নেতৃত্বে থাকেন আওয়ামী লীগ নেতা ওসমান চেয়ারম্যান।

অন্যদিকে কিছু দিনের মাথায় ৠাবের হাতে আটক হন জিয়া বাহিনীর প্রধান জিয়া। সে সময় এই সন্ত্রাসীকেও ক্রসফায়ারে দেওয়া হচ্ছে বলে রব উঠলেও পরে বিপুল সংখ্যক অস্ত্র-শস্ত্রসহ জিয়াকে একাধিক মামলায় জেলে পাঠানো হয়।

গত কয়েক বছরের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে বিএনপি নেতা জবল চৌধুরীসহ উভয়পক্ষে বেশ কয়েকজন হতাহত হন। গত কয়েক বছরে শুধুমাত্র এই একটি ইউনিয়নে নিহত হয়েছেন ৩ ডজনেরও বেশি লোক। আহত হয়েছেন পুলিশ- ৠাব সদস্য, নারী ও শিশুসহ হাজার হাজার লোক। মামলাও হয় শত শত।

দল নয় স্বার্থই প্রধান

এখানকার দুই সন্ত্রাসী গ্রুপ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির লেবাস পরলেও আসলে দল তাদের মুল বিষয় নয় বলে বাংলানিউজকে জানিয়েছেন একাধিক সূত্র। মূলত: দীর্ঘ দিনের বিবদমান পাহাড়ি ভূমি, ইউনিয়নের পশ্চিমে বিশাল বিশাল চিংড়ি ঘের, লবণ প্রজেক্ট ও কাঁকড়া ঘোনা দখলই সন্ত্রাসীদের মূল টার্গেট। এসব বাহিনীর বিভিন্ন উপ-দলের নেতা ও ক্যাডাররা একাধিকবার দল বদল করে উভয় পক্ষের দেওয়া মামলার আসামিও হয়েছেন।

যেভাবে ওসমান খুন

নির্বাচন এলেই ভোট করার নেশা ছিল ওসমানের। বিগত উপজেলা ও ইউপি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেও অল্প ভোটে হেরে যান ওসমান। দলের সিদ্ধান্তের বাইরে উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ায় তাকে দল থেকে বহিষ্কারও করা হয়। এই হেরে যাওয়ার পেছনে আওয়ামী লীগের কিছু নেতা ও ইউনিয়নের কয়েকজন গডফাদারকে দায়ী করতেন ওসমান। পরাজিত হলেও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকায় তিনি বিভিন্ন চিংড়ি ঘের ও লবণ প্রজেক্টে একক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন।

মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পরিবারের সন্তান হিসাবে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় একাধিক নেতার সঙ্গে তার ছিল ভালো যোগাযোগ। ওসমান চেয়ারম্যানের জামাতা মোহাম্মদ ওসমানও ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। এসবসহ দলের নাম ব্যবহার করে জমির মালিকদের থেকে অগ্রিম লাগিয়ত নিয়ে কিংবা বিভিন্ন ভাবে এসব জমিতে চাষ করে অর্থনৈতিক ভাবে লাভবান হতে থাকেন ওসমান।

ফলে এসব ঘের থেকে আগে লাখ লাখ টাকা আয় করা অন্য প্রতিপক্ষরা তার ওপর রুষ্ট হন। ওসমানকে পরাজিত করে ইউপি চেয়ারম্যান হওয়া সন্ত্রাসী মীর কাসেম চৌধুরী, অপর পরাজিত প্রার্থী সেলিম চৌধুরী ও সাংবাদিক রুহুল কাদের বাবুল একযোগে ওসমান চেয়ারম্যানকে ধরিয়ে দেওয়ার মিশনে নামেন। সর্বশেষ কয়েক মাস আগে তারা বেশ কয়েকটি সন্ত্রাসী গ্রুপকে ব্যবহার করে অফিস থেকে ডেকে নিয়ে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করেন আওয়ামী লীগ নেতা ওসমান গনি ওসমান চেয়ারম্যানকে। স্মরণকালের এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডে শেষ হয় একটি অধ্যায়।

ওসমানের মৃত্যুর পর এই বাহিনীর দেখভাল শুরু করেন ওসমানের বড় পুত্র আওয়ামী লীগ নেতা অ্যাড. নোমান। এখন সন্ত্রাসীরা নোমান ও তার ভাই তারেককেও বিভিন্ন ভাবে হত্যার পাঁয়তারা শুরু করছে বলে বাংলানিউজকে জানিয়েছে নিহত ওসমানের পারিবারিক সূত্র।     

একটি অংশ নিরাপদে?

বাংলানিউজে একাধিক সন্ত্রাসী, সন্ত্রাসী বাহিনী ও তাদের গডফাদারদের ব্যাপারে সংবাদ প্রকাশিত হলেও তাদের একটি অংশ নিজেদের নিরাপদ মনে করছে। ইতোমধ্যে সংবাদে আসা এক শীর্ষ সন্ত্রাসীকে আটক করে পুলিশ। পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ওই সন্ত্রাসী আহতও হন। তার অস্ত্র ভাণ্ডার থেকে উদ্ধার হয় বিপুল অস্ত্র ও গোলাবারুদ। সোনাদিয়ার নাগু মেম্বার বাহিনীর জাম্বু ডাকাত ও সহযোগীদের ধরতে গত দু’দিনে কোস্টগার্ডও একাধিক অভিযান পরিচালনা করেছে।   আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান কোন দিকে মোড় নিচ্ছে তার গতিবিধি দেখে পা ফেলতে চায় অন্যসব সন্ত্রাসী ও সন্ত্রাসী বাহিনীগুলো। তাই তারা আপাতত নিরাপদ আশ্রয়ে চুপচাপও রয়েছে।  

এদিকে প্রতিপক্ষের সন্ত্রাসীদের ডেরায় পুলিশ বারবার হানা দেওয়ায় সন্ত্রাসীদের একটি অংশ নিজেদের নিরাপদ ভাবতেও শুরু করেছে। বাংলানিউজের সংবাদে সন্ত্রাসী তালিকায় কোনো কোনো সন্ত্রাসী ও তাদের গডফাদারদের নাম বাদ পড়ায় অনেকে হাফ ছেড়ে বেঁচেছেন মনে করে নিজেদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ধারণ করে আছেন বলেও সূত্রে প্রকাশ।

প্রশাসনের হিসাব-নিকাশ

নিজেদের রক্ষার ব্যাপারে সন্ত্রাসীরা যে যতোই আস্থাশীল হোন না কেন প্রশাসনের হিসেব অন্য জায়গায়। সরকারের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো ইতোমধ্যে মহেশখালীর সন্ত্রাসীদের ব্যাপারে রেডম্যাপ সম্পন্ন করেছে বলে বাংলানিউজ গোয়েন্দা সূত্রে জানতে পেরেছে।   খুব শীগগিরই এর একটা প্রভাব সন্ত্রাসী বাহিনীর ওপর পড়তে যাচ্ছে বলে সূত্রে প্রকাশ। ক্ষমতার শেষ এক বছরে পা দিয়েছে সরকার। বৃহৎ স্বার্থে সন্ত্রাসী যেই হোক না কেন, তাকে আইনের আওতায় আনার প্রক্রিয়ায় নামছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। এ নিয়ে কক্সবাজারের ইতোমধ্যে ‘সন্ত্রাসীদের আতঙ্ক’ হিসাবে পরিচিত পাওয়া পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ‘সন্ত্রাসী কার’ এ পরিচয় না দেখে অভিযানে নামছেন বলে বাংলানিউজকে জানিয়েছেন।  

দৃষ্টির বাইরে ৩ উপ-দ্বীপ

ধলঘাটা-মাতারবাড়ি মহেশখালী দ্বীপের ভেতরেও আলাদা দু’টি দ্বীপ। দুটি পৃথক ইউনিয়ন। একই ভাবে দৃষ্টির বাইরে রয়েছে কুতবজোন ইউনিয়নের একটি ওয়ার্ড সোনাদিয়া দ্বীপ। এ ৩ দ্বীপের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড খুব একটা চেখে আসে না। দূর দ্বীপ, যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতাসহ নানা কারণে এমনটি হয়। এখানে প্যারাবন দখলের পর কেটে চিংড়ি ঘের বানানো, লবণ ও চিংড়ি ঘের প্রজেক্টের জমি নিয়ে গ্রুপে গ্রুপে বিরোধ চরমে। আছে জলদস্যুতা, খুনা-খুনির ঘটনাও। ধলঘাটায় সর্বশেষ খুন হয়েছেন ফজল কাদের বাহিনীর গিয়াস উদ্দিন নামের এক যুবক। পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ওই যুবক নিহত হয়েছেন বলে প্রচার করা হলেও নিহতের পরিবারের দাবি, এটি ছিল পরিকল্পিত  হত্যা। প্রতিপক্ষের আওয়ামী লীগ নেতা ও ধলঘাটার ইউপি চেয়ারম্যান আহছান উল্লাহ বাচ্চুর নেতৃত্বে তার বাহিনী গিয়াস উদ্দিনকে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করে বলে সে সময় ব্যাপক রব ওঠে।

বাংলানিউজের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এখানে রয়েছে আহছান উল্লাহ বাচ্চুর নেতৃত্বে একটি গ্রুপ। সাপমারার ডেইল এলাকায় রয়েছে জসু বাহিনী। তার ক্যাডারদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বেলাল, বেহা পোয়া, বাঁশি। মহুরী ঘোনা এলাকায় রয়েছে আলোচিত জোবায়ের বাহিনী। তার ক্যাডারদের মধ্যে জাহেদ, কালু অন্যতম। এছাড়া রয়েছে দুর্ধর্ষ ফজল কাদের বাহিনী। বর্তমানে এই সন্ত্রাসী জেলে থাকায় তার কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছেন অন্য ক্যাডাররা। তাদের মধ্যে কাসেম ও রাসেলের নাম পাওয়া গেছে। মাতারবাড়িতে এক সময় দাঁপিয়ে বেড়াত দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী হাজী ইদ্রীস, রাইফেল আমিন, জাহাঙ্গীর, আফজাল, বদর উদ্দিন, বশীর মেম্বার, আলী হোসেন, সবুজ, সজন বাহিনীসহ অনেক ভয়ঙ্কর বাহিনী। বর্তমানে এদের কার্যক্রম গুটিয়ে এলেও সৃষ্টি হয়েছে নতুন নতুন বাহিনী। তার মধ্যে ওয়াসিম, রুহুল আমিনসহ অনেকের নাম উঠে এসেছে। এখানে সর্বশেষ দুই বাহিনীর বন্দুকযুদ্ধে খুন হন মেহের আলী নামের এক ডাকাত। তবে সে সময় পুলিশের গুলিতে টাওয়ার এলাকায় ওই যুবক মারা গিয়েছিলেন বলে এলাকায় জনরব সৃষ্টি হয়েছিল।

নাগুর রাজ্য সোনাদিয়া  

জলদস্যু সরদার ও সোনাদিয়ায় অবৈধ দখল স্থাপন করার বিষয়ে আব্দুল গফুর ওরফে নাগুর নামটি বেশ আলোচিত। মোকাররম হোসেন জাম্বুর নেতৃত্বে তার রয়েছে একটি শক্ত দস্যু গ্রুপ। জাম্বু নাগুর আপন ভাইপো। দক্ষিণ চট্টগ্রাম তথা কক্সবাজার উপকূলীয় এলাকার বঙ্গোপসাগরে প্রতিদিন এই বাহিনীর হাতে একাধিক ট্রলার দস্যুতার শিকার হচ্ছে। ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেন কোস্টগার্ড কক্সবাজার কন্টিনজেন্টের কমান্ডার মোহাম্মদ তাহের মিয়া সিপিও। বাংলানিউজকে তিনি জানান, গত কয়েকদিনে দ্রুত গতির স্পিডবোট ব্যবহার করে এই বাহিনী একাধিক ট্রলারে হানা দিয়েছে।

এখানে রয়েছে দস্যু সরদার সামসুর নেতৃত্বে আরো একটি দস্যুদল। তবে এটি জাম্বু বাহিনীর কারণে কোণঠাসা বলে সূত্রে প্রকাশ। তবে আর যাই হোক স্থানীয় প্রশাসনে সঙ্গে রয়েছে নাগুর ভালো সখ্যতা। নাগু সম্প্রতি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর এই সখ্যতা আরো গাঢ় হয়। নাগুর বিরুদ্ধে ভূমিদস্যুতার অভিযোগেও একাধিক মামলা রয়েছে। গ্রেফতারও হয়েছেন একাধিক বার।

চরম ক্ষমতাধর গডফাদাররা

চট্টগ্রামের আলোচিত এইট মার্ডার, সমুদ্রে ১৪ মাঝিমাল্লা হত্যাকাণ্ড, ২০০০ সালের বিজয় দিবসের প্রথম প্রহরে ভারি অস্ত্রের গোলাবর্ষণের ঘটনায় এখানে এখানে এক ক্ষমতাধরের নাম বেশ আলোচিত। একই ভাবে পৌরসভার সিকদার বাড়ির লোকজনের বিরুদ্ধে চোরাচালান ও এলাকার সন্ত্রাসকে উসকে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। সর্বশেষ গত বছর কোস্টগার্ড এ গ্রুপের আস্তানা থেকে বিশাল বিশাল বিদেশি মদের চালান উদ্ধার করে।
বর্তমানে জেটি ও ফেরি পারাপারে একক আধিপত্য বিস্তারসহ বিভিন্ন ইস্যুতে অপর একটি গ্রুপের নাম বেশ আলোচিত। এলাকার সাবেক এমপির পরিবারেও রয়েছেন এ রকম এক দুর্ধর্ষ লোক। এলাকার পরিবহন সেক্টরকে নিয়ন্ত্রণ করে ওই চক্রটি অপরাধে জড়িত। বড় মহেশখালীর ফকিরাঘোনা, জাগিরাঘোনা, দেবাঙ্ঘী পাড়ায় রয়েছেন রাজনীতির খোলস পান্টানো এরকম বহু ক্ষমতাধর ব্যক্তি। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এলাকায় নৌ-বাহিনীর অভিযান চলাকালে ক্ষমতাধর এসব ব্যক্তিরা থাকেন লাপাত্তা। অন্যদিকে জাবি ছাত্রদলের এক সাবেক ক্যাডারের নেতৃত্বে চলে দেশীয় অস্ত্র চোরাচালান। কেউ আবার অনেকে বাহিনীর উচ্চ পদে আত্মীয় থাকার সুবাদে সন্ত্রাসী ও গ্রেফতারের তালিকায় শীর্ষে থাকার পরেও নিরাপদে থাকেন সে সময়।

সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার হাতে মহেশখালীর এ রকম অনেক শীর্ষ গডফাদারের তালিকা রয়েছে।

নিরীহদের শনির দশা

বিগত বিএনপি–জামায়াত সরকারের আমলে এখানে থানার কোনো ওসিই বেশি দিন স্থায়ী হতে পারেননি। এখন এখানে প্রতি ওসির গড়ে ৭-৮ মাস চাকরির স্থায়িত্ব হলেও মানুষের দুখের শেষ নেই। অনুসন্ধানে বাংলানিউজকে ভুক্তভোগী অনেকে অভিযোগ করে বলেন, মহেশখালীতে ভালো অফিসার আসেন না। যারা এসেছেন তারা সন্ত্রাসীদের ব্যাপারে নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকেননি। সম্প্রতি মাহবুব আলম নামের এক ওসি মহেশখালীতে এসে নিরপেক্ষতার দৃষ্টিকোণ থেকে নিরীহ মানুষের প্রশংসা কুড়ালেও তাকে বেশিদিন রাখা হয়নি।

একই অবস্থা উপজেলা প্রশাসনেও। এখানেও টাকা ছাড়া ভালো কিছু আশা করা যায় না। মহেশখালীর অপরাধের মুল সূত্র ভূমি বিরোধকে কেন্দ্র করে। আর এই বিরোধ জিইয়ে রাখার জন্য উপজেলা ভূমি অফিসই যথেষ্ট বলে মনে করেন অনেকে। এখানে উপজেলা সহকারী কমিশনার(ভূমি) না থাকায় দীর্ঘ দিন ধরে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেনেউপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষক বাংলানিউজকে বলেন, ‘‘মহেশখালীর মতো অপরাধপ্রবণ এলাকা নিয়ন্ত্রণের জন্য তৎকালীন রাসেদুল আমিনের মত ইউএনও দরকার। ’’

বাংলাদেশ সময়: ১৭৩৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৮, ২০১৩
আরএম/এমইএস/ সম্পাদনা: অশোকেশ রায়, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর [email protected]

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।