ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৮ মাঘ ১৪৩১, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১১ শাবান ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

আলোচনায় পিপার স্প্রে

মাজেদুল নয়ন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২১৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৬, ২০১৩
আলোচনায় পিপার স্প্রে

ঢাকা: আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে এখন পুলিশের সবচেয়ে কার্যকর অস্ত্র পিপার স্প্রে। গত ৯ জানুয়ারি প্রেসক্লাবের সামনে এমপিও (মান্থলি পেমেন্ট অর্ডার)এর দাবিতে আন্দোলনরত নন-এমপিও শিক্ষকদের ছত্রভঙ্গ করতে সর্বপ্রথম পিপার স্প্রে ব্যবহার করে পুলিশ।

এই স্প্রে চোখে, মুখে ঢোকায় এক আন্দোলনরত শিক্ষকের মৃত্যু হয় বলে অভিযোগ করেন শিক্ষকরা।

এরই মধ্যে বুধবার বামদলগুলোর হরতালে আলোচিত এই স্প্রে ব্যবহারের কারণে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যাবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন, বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম।

তবে পৃথিবীতে অনেক দেশেই এ স্প্রে ব্যবহার হচ্ছে উল্লেখ করে, এতে মারাত্মক শারীরিক ক্ষতির অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন ডিএমপির উপ-কমিশনার (জনসংযোগ) মাসুদুর রহমান।

পিপার স্প্রে সর্ম্পকে শাহবাগ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) শহীদুল বাংলানিউজকে বলেন, আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে এ স্প্রে ব্যবহার করা হয়। ঝাঁঝালো এ স্প্রেতে চলে যেতে বাধ্য হয় জড়ো হওয়া লোকজন।

তিনি বলেন, “স্প্রে করার পর আক্রান্ত ব্যক্তি কিছুক্ষণের জন্যে চোখ মেলে তাকাতে পারেন না। সময় চোখ দিয়ে পানি বের হতে থাকে। তবে এতে মানুষের শরীরে বা চোখে দীর্ঘস্থায়ী কোনো ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। ”


এদিকে পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, পিপার স্প্রে আনা হয়েছে ফিলিপাইন থেকে। প্রথমবারের মতো আনা হয়েছে প্রায় দুই হাজার স্প্রে।

অলিওরেসিন ক্যাসিকাম ও ক্যাপসিকাম স্প্রে নামেও পরিচিত এ পিপার স্প্রের ল্যাকরিমেটরি এজেন্ট এমন এক ধরনের রাসায়নিক মিশ্রণ যা চোখে ঝাঁঝ লাগিয়ে পানি বের করে, ব্যথা সৃষ্টি করে। এতে আক্রান্ত ব্যক্তি স্থায়ী অন্ধও হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

দাঙ্গা ও কোন্দল ঠেকাতে এ স্প্রে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া কুকুর ও হিংস্র জন্তু থেকে রক্ষা পেতেও ব্যবহার হয়। প্রস্তুতের সময় এতে ব্যবহার করা হয় লঙ্কাবাটা ও মরিচের গুঁড়াও। এ ঝাঁঝালো স্প্রে তৈরি করা হয়ইথানলের মিশ্রণে। উচ্চ কার্যকরী তরল ক্রোমোটোগ্রাফী(এইচপিএলসি) মেথডে এ স্প্রেতে মরিচ ও লঙ্কার মিশ্রণ ঠিক রাখা হয়।

পিপার স্প্রে বহনযোগ্য এক ধরনের রাসায়নিক অস্ত্র, যা অনেকটা টিয়ার গ্যাসের মতো কাজ করে। কারো ওপর এ স্পে করা হলে তার শ্বাস নিতে কষ্ট হয়, নাক দিয়ে পানি পড়ে এবং শুরু হয় কাশি। এর প্রভাব থাকে ৩০ থেকে ৪৫ মিনিট পর্যন্ত।

দ্য জার্নাল অব ইনভেস্টিগেটিভ অপথেমলজি এন্ড ভিজ্যুয়াল সায়েন্স প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একবারের জন্যে অলিওরিন ক্যাসিকাম ক্ষতিকর না হলেও, বারবার ছোঁড়া হলে চোখের কর্ণিয়াকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।

তবে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট সায়েন্টেফিক এন্ড টেকনোলজিক্যাল অপশনস অ্যাসেসমেন্ট প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, টিয়ার গ্যাসের চাইতেও ক্ষতিকর পিপার স্প্রে। এটা ১৫ থেকে ৩০ মিনিট পর্যন্ত প্রভাব থাকলে স্থায়ী অন্ধত্ব হতে পারে। ৪৫ থেকে ৬০ মিনিটের স্থায়ীত্ব থাকলে পুড়ে যেতে পারে চামড়া। যাদের অ্যাজমার মতো সমস্যা রয়েছে তাদের ওপর এ স্প্রের ব্যবহার হতে পারে মৃত্যুর কারণ পর্যন্ত।

কেমিক্যাল উইপেনস কনভেনশনের ১.৫ আর্টিকেল অনুযায়ী প্রিপার স্প্রের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

বাংলাদেশে পিপার স্প্রে নিয়ে যেমন কৌতূহল তৈরি হয়েছে, তেমনি শুরু হয়েছে এর সমালোচনাও।

বুধবারের হরতাল সমর্থনকারীদের ওপর পিপার স্প্রে ছুঁড়লে বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, “মরিচের গুঁড়া (পিপার স্প্রে) একটি অবৈধ কেমিক্যাল। পুলিশকে দিয়ে ক্ষতিকর এ কেমিক্যাল ব্যবহার করায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিরুদ্ধে আইননানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ”

বুধবার হরতাল চলাকালে রাজধানীর পুরানা পল্টনের দলীয় কার্যালয়ের সামনের সমাবেশ থেকে এ ঘোষণা দেন তিনি।

মরিচের গুঁড়ার ব্যবহার প্রসঙ্গে সেলিম বলেছেন, “আফগানিস্তান-ইরাক যুদ্ধে আমেরিকা এ ধরনের কেমিক্যাল ব্যবহার করেছিল। এখন এদেশের অন্দোলনকারীদের ওপর ব্যবহার করা হচ্ছে। ”

তিনি আরও বলেন, “পশ্চিমা দেশগুলোতে এই মরিচের গুঁড়ার ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। দেশগুলোতে আগে যখন এটি ব্যবহার করা হতো, তখন পুলিশ এক ধরনের মাস্ক ব্যবহার করতো। কিন্তু আমাদের পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা যখন আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ্যে এটি ব্যবহার করছেন, তখন মাস্ক ব্যবহার করছেন না। ফলে এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দুই পক্ষই। ”

এটি মানবদেহে স্থায়ী রোগসহ বড় ধরনের সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। যা ধীরে ধীরে শরীরে ছড়িয়ে পড়ে বলেও উল্লেখ করেন সেলিম।

তবে উইকিপিয়া থেকে পাওয়া তথ্যমতে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এসব স্প্রে সাধারণ জনগনও কিনতে পারেন যে কোনো দোকান থেকে। যেমন, ভারত, ফিলিপাইন, দক্ষিণ কোরিয়া।

আবার, চেক রিপাবলিকে নারী এবং ঝুঁকিগ্রস্তদের এই স্প্রে বহনে উৎসাহী করা হয়। রাশিয়া, স্লোভাকিয়া, সুইজারল্যান্ডসহ অসংখ্য দেশে পিপার যে কোনো ব্যক্তি নিজের প্রয়োজনে বহন করতে পারে।

তবে ব্রাজিল, নিউজিল্যান্ড, স্পেনের মতো দেশে এ স্প্রেকে অস্ত্র হিসেবে গণ্য করা হয়। যা আইনশৃঙ্খলাবাহিনী ব্যতিত অন্য কেউ বহন করতে পারে না।

এদিকে, গত বৃহস্পতিবার শহীদ মিনারে পুলিশের মরিচের গুঁড়া মিশ্রিত টিয়ার স্প্রেতে অসুস্থ হয়ে পটুয়াখালীর মাদ্রাসা শিক্ষক সেকান্দার আলী গত মঙ্গলবার ভোর সাড়ে চারটায় মারা যান বলে অভিযোগ করেছেন নন-এমপিও শিক্ষক কর্মচারী ঐক্যজোট।

জোটের সভাপতি এশারাত আলী বলেন, “গত বৃহস্পতিবার শহীদ মিনারে শিক্ষকরা আমরণ অনশন কর্মসূচি পালন করার সময় পুলিশ সেখানে বাধা দেয়। শিক্ষকদের তাড়াতে এক পর্যায়ে মরিচের গুঁড়া মিশ্রিত টিয়ার স্প্রে মারে। ”

তিনি বলেন, “সরাসরি নাক, মুখ এবং চোখে এই বিষাক্ত স্প্রে প্রবেশ করলে গুরুতরভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন সেকান্দার আলী। ঢাকায় প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হলেও বিকেলের দিকে আবারও অসুস্থ হয়ে পড়েন এ মাদ্রাসা শিক্ষক। বৃহস্পতিবারই তাকে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখান তার অবস্থার আরও অবনতি হয়। ”

পরে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়েও বাঁচানো যায়নি সেকান্দার আলীকে। অবশেষে মঙ্গলবার ভোর সাড়ে চাটায় মৃত্যুবরণ করেন তিনি। পুলিশের ছোঁড়া স্প্রের কারণেই মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ করেন এশারাত।

তবে পিপার স্প্রের এ ধরনের ক্ষতির কথা অস্বীকার করেছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার মাসুদুর রহমান। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ফোনে বাংলানউজকে তিনি বলেন, “স্বাভাবিকভাবে যে কোনো বিশৃঙ্খল মোকাবেলা করতে পুলিশ এই পিপার গান ব্যবহার করছে। ”

এর তরল পদার্থ কারও শরীরে লাগলে কোনো স্থায়ী ক্ষতি হবে না বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

তিনি আরও জানান, পিপার স্প্রে কাঁদানে গ্যাসের আধুনিক রূপ। কারো ওপর এ স্প্রে নিক্ষেপ করলে চোখ দিয়ে পানি বের হলে এবং কাশি আসলেও ১৫ থেকে ২০ মিনিটের মধ্যেই আবার সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হয়ে যায়।

বাংলাদেশ সময়: ২২০০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৬, ২০১৩
এমএন/সম্পাদনা: আসিফ আজিজ, নিউজরুম এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।