ঢাকা: বাচ্চু রাজাকারকে মহান মানুষ হিসেবে পরিচিত করার প্রয়াস চালালো বাংলাদেশে সুপরিচিত আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম বিবিসি, রয়টার্স, এপি ও এএফপি।
বাংলাদেশের প্রথম যুদ্ধাপরাধীর মৃত্যুদণ্ড ঘোষণার খবরে বাচ্চু রাজাকারকে তারা বললো যাজক, সুপরিচিত মুসলিম ধর্মপ্রচারক বা ক্লেরিক(Cleric)।
আরো এক কাঠি সরেস বিবিসি। অজ্ঞাতপরিচয় বিশেষজ্ঞের বরাত দিয়ে বিবিসি বললো, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হননি। ‘নিহতে’র সংখ্যা বড়জোর ৩ থেকে ৫ লাখ হতে পারে।
![BBC BBC](../../../images/PhotoGallery/2012December/BBC-0120130123034409.jpg)
তাই সঙ্গত কারণেই খ্যাতনামা এই চার সংবাদ প্রতিষ্ঠানের এমন অবস্থান নানা প্রশ্ন ও বিতর্কের জন্ম দিলো।
ফরিদপুর শহরের গোয়ালচামট এলাকার শ্রীঅঙ্গন প্রভু জগদ্বন্ধু আশ্রমে পাকিস্তানি বাহিনী এনে প্রার্থনারত মহানাম সম্প্রদায়ের ৮ যাজককে হত্যায় সহায়তাকারী বাচ্চু রাজাকারকে কোন বিবেচনায় যাজক বলা হচ্ছে তা কিন্তু ব্যাখ্যা করে নি বিবিসি, রয়টার্স, এপি বা এএফপি। বাচ্চু রাজাকারের রায় কেন বিতর্কিত তারও ব্যাখ্যা নেই তাদের রিপোর্টে। রাজাকার পরিচয় ফাঁস হওয়ার কারণেই যে বাচ্চুকে টেলিভিশনের ‘ছওয়াল জবাব’ অনুষ্ঠান থেকে ছিটকে পড়তে হয় তা-ও এড়িয়ে গেলো এসব সংস্থা।
উপরন্তু যুদ্ধাপরাধের অভিযোগের ব্যাপারে তারা নিজেদের তদন্ত আছে বলে দাবি যেমন করেনি, তেমনি দেয় নি আগামীতে কোনো তদন্ত বা অনুসন্ধান করার ঘোষণাও।
এসব মিডিয়ার এমন আচরণ তাহলে কি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচালে জামায়াতের আন্তর্জাতিক লবিস্ট নিয়োগের প্রভাব?
অজ্ঞাতপরিচয় সমালোচকদের বরাত দিয়ে এ রায়কে বিবিসি যে উদ্দেশ্য প্রণোদিত বলছে, উল্টোভাবে সেটাকেই উদ্দেশ্য প্রণোদিত বললে খুব কি অত্যুক্তি হবে?
সরকার রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্যই এ বিচার করছে বলে যে কথা বলা হচ্ছে, তার গ্রহণযোগ্যতা কতোটুকু? রায় ঘোষণার পর হাইকোর্ট গেটে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ব্যানারে আনন্দ মিছিলকারী মুক্তিযোদ্ধাদের পোড়খাওয়া মুখগুলোতে প্রশান্তি না দেখে প্রতিহিংসা কেন দেখলো তারা? তাহলে কি হাজার কোটি টাকার লবিং প্রক্রিয়া কাজে দিয়েছে?
কই, বাংলাদেশের মিডিয়া তো বাচ্চু রাজাকারকে নিয়ে এমন বিভ্রান্ত হলো না! তাহলে আন্তর্জাতিক মিডিয়া কেন এমন অবস্থান নিলো?
বাচ্চু রাজাকারের বিরোধিতাকারী হিসেবে যেসব রাজনৈতিক দলের বরাত তারা দিচ্ছে তারাও কি কেবল রাজনৈতিক কারণেই ট্রাইব্যুনালের বিরোধিতা করছে না? রায়ে সন্তোষ প্রকাশকারী লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি) চেয়ারম্যান কর্নেল (অব.) অলি আহমদ আর বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমরা কি সরকারি দলের নেতা? নাকি তাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোক মানতে আপত্তি আছে? জাতীয় মানবাধিকার কমিশন চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান কোন পক্ষের লোক?
রায় ঘোষণার পর চট্টগ্রামে সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী তরুণ উদ্যোগের শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শহীদ স্মরণ, বরিশালে ২৭ সাংস্কৃতিক সংগঠনের আনন্দ মিছিল, স্থানে স্থানে মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশ কিভাবে প্রতিহিংসামূলক কর্মসূচি হয়?
আন্তর্জাতিক কোনো তদারকি ছাড়াই ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত গঠন করা হয়েছে বলে যে দাবি এএফপি তুলেছে, তা কতোটুকু যুক্তিযুক্ত? বাংলাদেশ কি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ নয়? বাংলাদেশের অপরাধীদের বিচার বাংলাদেশের আইনে কেন করা যাবে না?
![AFP AFP](../../../images/PhotoGallery/2012December/AFP0120130123034419.jpg)
ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরোধিতার কথা যারা বলছেন, তাদের কি জানা নেই যে, গত চার দশকে অনেক গুছিয়ে বসেছে রাজাকাররা? রাজাকাররা কি অন্য দল, প্রভাবশালী পরিবারে আত্মীয়তা গড়ে সমাজ ও রাষ্ট্র কাঠামোতে নিজেদের আরো ছড়িয়ে দেয় নি? যদি দিয়ে থাকে, তাহলে তাদের বিরোধিতাও তো প্রবলই হবে। কিন্তু এর মানে কি এই যে, অভিযুক্তরা একাত্তরে কোনো অপরাধ করেনি। অভিযুক্তদের বর্তমান পরিচয় কেন মূল ফোকাস পয়েন্ট হবে? একাত্তরে তারা কি করেছে তা কেন সরিয়ে ফেলতে হবে বিবেচনার বাইরে?
কোনো রিপোর্টেই কিন্তু কোনো সমালোচনার ব্যাখ্যা স্পষ্ট করা হয়নি।
তাহলে জাতীয় সংসদে বিল পাসের পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের এই প্রক্রিয়াকে কটাক্ষ করা কেন? যেখানে ১৯৮৯ সালের আগে সংঘটিত কোনো দেশের যুদ্ধাপরাধের বিচার জাতিসংঘের অধীনে হওয়ার সুযোগ নেই বলে খোদ জামায়াত নেতা কামরুজ্জামানই ২০১০ সালের মার্চে স্বীকার করেছেন। যেখানে বিশ্বমোড়ল যুক্তরাষ্ট্র মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারকে সমর্থন জানাচ্ছে, সেখানে এসব মিডিয়ার এমন অবস্থানের কারণ কি?
তাহলে কি জামায়াতের আন্তর্জাতিক লবিস্ট নিয়োগ কাজে দিয়েছে? কাজে এসেছে লন্ডন প্রবাসী জামায়াত-সমর্থক আইনজীবীদের দৌড়ঝাঁপ?
পুলিশের রিমান্ডে থাকা তিন জামায়াত নেতা ২০১০ সালের জুলাই মাসে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে জনমত গড়তে ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে গঠিত টিমকে প্রাথমিকভাবে ৬৬ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়ার যে তথ্য স্বীকার করেছেন তা কি ভুলে গেছেন সবাই?
গোয়েন্দা সূত্রমতে, এমনিতেই ব্যাংকিং ব্যবসাসহ জামায়াতের বার্ষিক আয় ১৫ হাজার কোটি টাকা। ২০১০ সালের শেষ নাগাদ যুক্তরাষ্ট্রের কনসালটেনসি ফার্ম কেসিভি অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসকে ২৫ মিলিয়ন ডলার বা ১৮২ কোটি টাকা অগ্রিম দিয়ে লবিস্ট নিয়োগ দেয় জামায়াত।
বাংলাদেশ বাংকের চোখ ফাঁকি দিয়ে সিটি ব্যাংক এনএ-এর মাধ্যমে ইলেকট্রনিক ট্রান্সফার পদ্ধতিতে কেভিসির হিসাব নম্বরে (৩০৭১৭২৪৮, সুইফট কোড, সিটি ইউএস ৩৩) অগ্রিম টাকা পাঠানোর খবরও পাওয়া যায়।
যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ সরকারের ওপর চাপপ্রয়োগের জন্য করা ওই চুক্তিপত্রে সই তো করেন জামায়াতের খাজাঞ্চি হিসেবে পরিচিত মীর কাসেম আলী। ২০১০ সালের ১০ মে করা ওই চুক্তিতে কেভিসির পক্ষে জেনারেল কাউন্সেল অ্যান্ডু জে ক্যামেরস এর স্বাক্ষরও তো পাওয়া যায়।
২০১১ সালের ৫ এপ্রিল সাবেক কংগ্রেসম্যান মার্টি রুশোর নেতৃত্বাধীন ৭০০ থার্টিন্থ স্ট্রিট, এনডাব্লিউ, সুইট ৪০০ ওয়াশিংটন ডিসি ঠিকানার ওই লবিস্ট ফার্মের সঙ্গে ছয় মাসমেয়াদী চুক্তি শেষ হওয়ার পর আরো ২৫ মিলিয়ন ডলার দিয়ে আরো ৬ মাসের জন্য চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধির কথাও তো বলা হয়। সব ঠিক থাকলে তৃতীয় দফায় বৃদ্ধি হওয়ার কথা ওই চুক্তির মেয়াদ।
চুক্তিপত্রে বলা হয়, মার্কিন কংগ্রেসম্যান ও সিনেট সদস্যদের দিয়ে এবং যারা দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ে মার্কিন নীতি নির্ধারণ করে থাকেন তাদের প্রভাবিত করার জন্য এ চুক্তি।
২০১১ সালের ৬ অক্টোবর কাসেম আলীকে লেখা এক চিঠিতে কেভিসির আন্তর্জাতিক কার্যক্রমবিষয়ক ভাইস-প্রেসিডেন্ট অ্যামোস জে হোসস্টাইন উল্লেখ করেন, তার (কাসেম) স্বার্থরক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্র সরকার ও বাংলাদেশ সরকারের উচ্চ পর্যায়ে লবিং চালিয়ে যাচ্ছেন তারা।
তাহলে সেই লবিংয়ের প্রভাব কি পড়লো আন্তর্জাতিক মিডিয়ায়?
যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে প্রচারণা চালিয়ে কতখানি সফল হলেন মতিউর রহমান নিজামীর লন্ডনপ্রবাসী জামাতা ব্যারিস্টার নজরুল ইসলাম, সাবেক শিবিরনেতা ব্যারিস্টার এম আসাদুজ্জামান এবং দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বড় ছেলে রফিক বিন সাঈদী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ছেলে তাসবিদের ভায়রা ভাই ব্যারিস্টার ইসমাইলরা?
পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের পর ব্রিটেনে তো মানববন্ধন করেছিলেন তারাই।
তারা কি এতোটাই সফল যে আন্তর্জাতিক মিডিয়াতেও নিজেদের স্বার্থ ভাবনা রোপন করতে সক্ষম হয়েছেন?
![AP AP](../../../images/PhotoGallery/2012December/AP0120130123034437.jpg)
কি লিখেছে বিবিসি, রয়টার্স, এপি, এএফপি
বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসে প্রকাশিত রিপোর্টের শিরোনাম ‘বাংলাদেশ ক্লারিক আবুল কালাম আযাদ সেনটেন্সড টু ডাই ফর ওয়ার ক্রাইমস’। এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের একটি আদালত ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য একজন সুপরিচিত মুসলিম ধর্মপ্রচারককে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। বিতর্কিত ট্রাইব্যুনাল তার প্রথম রায়ে আবুল কালাম আজাদকে ফাঁসির আদেশ দিয়েছে।
এ আদালতকে জাতিসংঘ স্বীকৃতি দেয়নি। ট্রাইব্যুনালের সমালোচকরা বলছেন যে, মওলানা আজাদসহ অন্যদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে, তা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। বিরোধী দলগুলো বলছে, সরকার রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্যই এ বিচার করছে।
বাংলাদেশ সরকার দাবি করছে যে, স্বাধীনতা যুদ্ধে ৩০ লাখ লোক নিহত হয়। তবে অনেক গবেষক বলছেন, নিহতের সংখ্যা ৩ থেকে ৫ লাখের মধ্যে।
এএফপি’র রিপোর্টের শিরোনাম ‘টেলিভানজেলিস্ট টু হ্যাং ফর বাংলাদেশ ওয়ার ক্রাইমস’। এতে বলা হয়, আন্তর্জাতিক কোনো তদারকি ছাড়াই সরকার ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত গঠন করে। এ আদালতকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
বিএনপি ও জামায়াত এ মামলাকে উদ্দেশ্য প্রণোদিত এবং প্রহসনমূলক বলে মন্তব্য করেছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলেছে, বিচারে অনেক ঘাপলা আছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার ২০১০ সালের মার্চে এ ট্রাইব্যুনাল গঠন করেন। তবে একাধিক বিতর্কে জড়িয়ে সমালোচিত হয়েছে এ ট্রাইব্যুনাল। রায় দ্রুত দেওয়ার জন্য সরকার চাপ দিচ্ছে বলে স্কাইপ সংলাপ ফাঁস হয়ে গেলে বিচারের স্বচ্ছতা নিয়ে আবারও প্রশ্ন ওঠে। এ ঘটনায় পদত্যাগ করেন ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত ও প্রাইভেট টিভি স্টেশনে মওলানা আজাদের ইসলামী অনুষ্ঠান নাকি বিপুলসংখ্যক দর্শক উপভোগ করেন।
রয়টার্সের রিপোর্টের শিরোনাম ‘ইসলামিক ক্লারিক সেনটেন্সড টু ডেথ ফর বাংলাদেশ ওয়ার ক্রাইমস’। এতে বলা হয়, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সংঘটিত অপরাধের মামলার প্রথম রায়ে বাংলাদেশের বিতর্কিত ট্রাইব্যুনাল একজন জনপ্রিয় ইসলামী টিভি উপস্থাপককে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে।
![Reuters Reuters](../../../images/PhotoGallery/2012December/Reuters0120130123034358.jpg)
আন্তর্জাতিক মান রক্ষা না করে বিচার করার জন্য মানবাধিকার সংগঠনগুলো এ ট্রাইব্যুনালের সমালোচনা করেছে। অন্যদিকে বিরোধী দলগুলো এ বিচারকে রাজনৈতিক প্রহসন বলে মন্তব্য করেছে।
অভিযুক্তদের আইনজীবী, সাক্ষী ও তদন্তকারীরা বলেছেন, বিচারকালে তাদের ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে।
এপির রিপোর্টের শিরোনাম, ‘বাংলাদেশ ওয়ার ট্রাইব্যুনাল ওর্ডারস ক্লারিক’স এক্সিকিউটেড’। এতে বলা হয়েছে, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সংঘটিত অপরাধের বিচার করছে যে বিতর্কিত ট্রাইব্যুনাল, তাদের প্রথম রায়ে আবুল কালাম আযাদকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৪৯ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৩, ২০১৩
আরআর; জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর