ঢাকা: জামায়াত নেতা আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে উত্তাল তরুণ প্রজন্ম। এই প্রজন্মের এক কিশোরীর গগণবিদারী সাহসী উচ্চারণ শাহবাগ গণজাগরণ চত্বরে উপস্থিত সবাইকে বিদ্ধ করছে।
এই কিশোরী বা আন্দোলনে আসা অন্যরা চার দশক আগের স্বাধীনতা যুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের বিচার দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন, অথচ সেসময় কারোরই জন্ম হয়নি।
এদের একজন ১৩ বছর বয়সী নিধি হোসেন মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবিতে উদাত্ত কণ্ঠে আওয়াজ তুলছিল, “এ কলঙ্ক আমাদের সবার । ” তার দৃপ্ত কণ্ঠে উচ্চারিত হচ্ছিল, “আমরা একদিন এই অপরাধীদের থেকে মুক্তি পেয়ে এগিয়ে যাব। ” নিধির মতো বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতির এই শহরের সবাই তার সঙ্গে একাত্ম।
শাহবাগে জমায়েত হওয়া লাখো মানুষ একত্রে গান ধরেছে, তারা হয়ত একে অন্যের প্রতিদ্বন্দ্বী, বা সর্বশেষ তেলের মূল্য বেড়ে যাওয়ার ব্যাপারে ভিন্ন মত রয়েছে তাদের। অথচ শাহবাগের প্রায় দুই সপ্তাহের এই আন্দোলন সব বিভেদ ভুলিয়ে, রাজনীতির উর্ধ্বে তুলে, শ্রেণী-পেশা-বয়স এমনকি ধর্মের বাধা ডিঙিয়ে তাদের একত্র করেছে।
এদিকে, এই আন্দোলন কোনো রাজনৈতিক রূপ পরিগ্রহ করেনি। যখনই আন্দোলনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কোনোভাবে এই সক্রিয় হতে গেছে, তখনই তরুণ সমাজের সমস্বর বিরোধিতার মুখোমুখি হতে হয়েছে তাদের। হতাশাগ্রস্ত তরুণ প্রজন্মের জেগে ওঠায় তাদের বাধভাঙা স্রোতের মুখে সব রাজনীতিবিদই পেছনে সরে আসতে বাধ্য হয়েছেন।
শাহবাগে দেশপ্রেমিক জনতার এ আন্দোলন শুরু হয় ৫ ফেব্রুয়ারি, যখন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল দেশের সবচেয়ে বড় ইসলামী দলের অন্যতম নেতা কাদের মোল্লাকে মুক্তিযুদ্ধকালীন হত্যা ও পাকিন্তানি বাহিনীকে সহযোগিতার দায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেন।
যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতাদের বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে দেশের মানুষের ওপর পাশবিক নির্যাতন, গণহত্যা, গণধর্ষণ, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া, লুণ্ঠন ও বুদ্ধিজীবী হত্যার অভিযোগ রয়েছে আর তা প্রমাণিত।
শুরুতে অনলাইন অ্যাকটিভিস্টরা শাহবাগ চত্বরের এই আন্দোলন শুরু করে মাত্র ৪০০-৫০০ তরুণ। এখন এ সমাবেশে লাখো মানুষ অংশ নেয়।
উচ্ছ্বসিত এই তরুণ প্রজন্ম ভীতি ও সহিংসতার আশঙ্কা সত্ত্বেও অভূতপূর্ব আন্দোলনকে শাহবাগসহ দেশের অন্যান্য জায়গা, বিশেষ করে বড় শহরগুলোতে ছড়িয়ে দিচ্ছে। নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে এই আন্দোলনও হয়ে উঠেছে একটা আনন্দ মেলা। যেখানে আইসক্রিম বিক্রেতা, রিকশাচালক, ছাত্র-জনতা থেকে শুরু করে সবাই দেশের কলঙ্ক মোচনের জন্য এসেছে।
“আমরা যুদ্ধ করেছি, কিন্তু মানুষ এর প্রতিদান পায়নি”, বলছিলেন ৭৬ বছর বয়সী মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম। যুদ্ধে তার পায়ে ও কব্জিতে গুলিবিদ্ধ হন। আন্দোলনের সপ্তম দিনে তিনি তার তিন মেয়ে ও ১২ বছর বয়সী নাতনীকেও নিয়ে এসেছেন শাহবাগে কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড দাবিতে।
অপরদিকে, গত শুক্রবার এই আন্দোলন দ্বিগুণ গতি লাভ করে একজন শীর্ষ আন্দোলনকারী ও আন্দোলনের সমন্বয়কারী ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দারের মৃত্যুতে। ওইদিন দুর্বৃত্তরা রাতে রাজীবকে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করে। আন্দোলকারীরা এই ঘটনায় শিবিরকে দায়ী করলেও শিবির তা অস্বীকার করেছে।
এ ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিকেলে রাজীবের বাড়িতে যান। ওই সপ্তাহেই সরকার স্বাধীনতাকালীন অপরাধে জড়িত ব্যক্তি ও সংগঠনকে বিচারের ব্যবস্থা রেখে ট্রাইব্যুনালের আইনে সংশোধনী আনে। এতে বাদী-বিবাদীর আপিল করার সমান সুযোগ রাখা হয়।
এদিকে, একজন ব্লগারের এই নির্মম মৃত্যুর পর জামায়াতের হরতালসহ নানা কর্মসূচি স্তিমিত হয়ে পড়েছে। আন্দোলকারীরা পণ করেছে, রাজাকারদের সমুচিত শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত তারা ঘরে ফিরে যাবে না।
অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট নেটওয়ার্কের সদস্য ও আন্দোলনের আরেক সমন্বয়ক মাহমুদুল হক মুন্সী বলেছেন, ‘‘রাজীবের হত্যার পর আমরা শপথ নিয়েছি সঠিক বিচার না নিয়ে ফিরে যাব না। ’’
(টাইম সাময়িকী থেকে সংক্ষিপ্ত অনুবাদ)
বাংলাদেশ সময়: ২১২১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২০, ২০১৩