ঢাকা, বুধবার, ২৮ মাঘ ১৪৩১, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২ শাবান ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

ড. ইউনূসের ক্ষুদ্রঋণ

‘কট ইন মাইক্রো ডেট’-এর গবেষকের মুখোমুখি

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭০৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২, ২০১০
‘কট ইন মাইক্রো ডেট’-এর গবেষকের মুখোমুখি

জাঈদ আজিজ বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সংগঠক, প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা। দীর্ঘদিন ধরে প্রামাণ্যচিত্র নিয়ে কাজ করছেন।

তিনি ফুলবাড়ী কয়লাখনি ও উন্মুক্ত পদ্ধতিতে খননের বিরুদ্ধে সংঘটিত আন্দোলন নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র ‘ফুলবাড়ীর সাত দিন’  নির্মাণ করেছেন। ‘ছবির লড়াই’  নামের একটি চলচ্চিত্র সংগঠনে কাজ করেন। সম্প্রতি নরওয়ের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে প্রচারিত বাংলাদেশের গ্রামীণ ব্যাংকের ক্ষুদ্র ঋণ ব্যবস্থা নিয়ে নির্মিত ‘কট ইন মাইক্রো ডেট’ (Caught in Micro Debt) বা ‘ক্ষুদ্রঋণের ফাঁদ’ প্রামাণ্যচিত্রটি প্রচারিত হয়। এর পরিচালনায় ছিলেন ডেনমার্কের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও প্রমাণ্যচিত্র নির্মাতা টম হাইনেমান (Tom Heinemann)।   আর এর গবেষণার দায়িত্বে ছিলেন জাঈদ আজিজ। বুধবার তিনি বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম-এর মুখোমুখি হন। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম-এর নিউজরুম এডিটর রানা রায়হান  

বাংলানিউজ: ড্যানিশ সাংবাদিক টম হাইনেমান সম্প্রতি বাংলাদেশের গ্রামীণব্যাংকের  ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থা নিয়ে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন। মূলত গ্রামীণ ব্যাংকের কার্যক্রমের ওপর এটা নির্মিত হয়েছে। গত মঙ্গলবার নরওয়ের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে তা প্রচার করা হয়েছে। আপনি তথ্যচিত্রটির গবেষণার কাজের দায়িত্ব পালন করেছেন। আপনার অভিজ্ঞতার কথা বলুন।

জাঈদ আজিজ: এর আগেও টমের সঙ্গে আমি কাজ করেছি। বেশ কয়েকটি প্রামাণ্যচিত্র (ডকুমেন্টারি) নির্মাণে আমি তার সঙ্গে ছিলাম। শুটিং এর লোকেশন, কার কার সাক্ষাৎকার নেওয়া হবে, কোথায় শুট করা হবে, কিভাবে করা হবে এগুলো ঠিক করার দায়িত্ব ছিলো আমার। মোটকথা, ছবির গবেষণার কাজটা আমি করেছি।

বাংলানিউজ: টম হাইনেমান কেন ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী হলেন, আপনি বলতে পারবেন?

জাঈদ আজিজ: টম মূলত একজন সাংবাদিক। ইউরোপে প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা হিসেবে তার পরিচিতি আছে। অনুসন্ধানী প্রামাণ্যচিত্র করতে পছন্দ করেন। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নোবেল পুরস্কার পাওয়ার ব্যাপারটা তিনি জানতেন। ২০০৬ সালের আগে থেকেই বাংলাদেশে তার যাতায়াত ছিলো। বাংলাদেশের খবরের কাগজে গ্রামীণ ব্যাংকের ক্ষুদ্রঋণের ওপর প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়, সেখানে গ্রামীণ ব্যাংকের সুদের হার, ঋণ বিতরণ ও আদায় পদ্ধতির কিছু সমালোচনা ছিল। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোর পত্র-পত্রিকতায়ও নানান খবর লক্ষ্য করে তিনি এ বিষয়ে প্রামাণ্যচিত্র তৈরিতে আগ্রহী হন।

বাংলানিউজ: প্রামাণ্যচিত্রটির শুটিং কোথায় হয়েছে?

জাঈদ আজিজ: এর ৭৫ শতাংশ শুটিং হয়েছে বাংলাদেশে। এরপর ইউরোপ, আমেরিকা ও আফ্রিকার কয়েকটি দেশে প্রামাণ্যচিত্রটির বাকি ২৫ শতাংশ শুট করা হয়। বাংলাদেশের চট্টগ্রাম, সাভার ও দিনাজপুরে এর শুটিং হয়। ক্ষুদ্র ঋণগ্রহীতাদের ও  বাংলাদেশের বিশিষ্ট কয়েকজন বুদ্ধিজীবীর সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়।

বাংলানিউজ: সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময়কার অভিজ্ঞতার কথা বলুন।

জাঈদ আজিজ: আমরা দিনাজপুরের প্রায় ৪০টি গ্রামে গিয়েছি। এছাড়া চট্টগ্রাম ও সাভারেও গিয়েছি। সেখানকার অনেক মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি। যাদের সবাই কোনো না কোনো এনজিওর কাছ থেকে ঋণ নিয়েছে। অনেকে আবার একই সময়ে দুই/তিনটি সংস্থার কাছ থেকে নিয়েছে। এর কারণ হচ্ছে, একজন একটি সংস্থার কাছ থেকে ঋণ নেওয়ার পর  দেখা গেল, তিনি হয়ত  ঋণের টাকা কোনো কাজে লাগাতে পারলেন না। একসঙ্গে অনেক টাকা পেয়ে তিনি পরিবারের সদস্যদের জন্য নতুন জামা কাপড় কিনলেন। কয়েকদিন ভালো খাবার-দাবার খেলেন। টাকা শেষ হয়ে গেল। ঋণের টাকা কোথাও বিনিয়োগ করা হলো না। তিনি যে অন্যের জমিতে কৃষিকাজ করতেন, সেই কাজই করতে থাকলেন। কিন্তু সপ্তাহ শেষে যে ঋণ পরিশোধের তাগাদা রয়েছে! এটা তিনি শোধ দেবেন কিভাবে? এটা তো তার জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াল। এজন্য আরেকটি ঋণদাতা সংস্থার শরণাপন্ন হতে হলো তাকে। এরপর আরেকটার কাছে গেলেন। এভাবে একটি ঋণচক্রের মধ্যে ঢুকে পড়লেন তিনি।

বাংলানিউজ: আত্মহত্যার ঘটনা কোথায় পেয়েছেন?

জাঈদ আজিজ: ঋণের কারণে লোকে আত্মহত্যা করেছে এটা প্রমাণ করা কঠিন। তবে দিনাজপুরের কাহারোল ও বিরামপুর উপজেলায় যারা আত্মহত্যা করেছে তাদের অনেকেই ঋণ নিয়েছিলো।

বাংলানিউজ: সংস্থাগুলোর তো শর্ত থাকে ঋণগ্রহীতাকে এ অর্থ আয়-রোজগার হয় এমন খাতে বিনিয়োগ করতে হবে। এও নিশ্চিত হতে হবে যে গ্রহীতার পক্ষে ঋণ ফেরত দেওয়ার সামর্থ্য আছে কি না।

জাঈদ আজিজ: আমরা মাঠ পর্যায়ে এনজিওগুলো ঋণ দেওয়ার প্রতিযোগিতা লক্ষ্য করেছি। গ্রামীণ ব্যাংক, ব্র্যাকসহ নানা স্থানীয় এনজিও রয়েছে। এরা সবাই ঋণ দিতে চায়। সব সংস্থাই নানা ধরনের প্রলোভন দেয়, মিথ্যা স্বপ্ন দেখায়। তবে ঋণ দেওয়ার পর টাকা কোথায় কিভাবে খরচ হচ্ছে তার খোঁজখবর রাখে না। অনেকেই ঋণের তুলে দৈনন্দিন নানান প্রয়োজনে খরচ করে ফেলে। অপ্রয়োজনীয় খাতেও ব্যয় হয়। যৌতুক দেওয়া, ছেলেমেয়ের পড়ালেখার জন্য খরচ, ধার-দেনা শোধ করা, গৃহস্থালী আসবাবপত্র কেনা--এসব কাজে এনজিও থেকে তোলা টাকা খরচ করতে দেখেছি আমরা অনেককে।

বাংলানিউজ: এর অর্থ হচ্ছে, ঋণ নিয়ে উপকার পাওয়ার চেয়ে চূড়ান্ত পর্যায়ে তার ক্ষতিই হচ্ছে বেশি।

জাঈদ আজিজ: আমরা যাদের সঙ্গে কথা বলেছি তাদের অধিকাংশই জানিয়েছে ঋণ নিয়ে তাদের উন্নতির চেয়ে দুর্ভোগই হয়েছে বেশি। খুব কম পরিবারের নারীরাই বলেছে ঋণ নিয়ে তাদের অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। বরং বছরের পর বছর ধরে নানান এনজিওর ঋণের মধ্যে থেকে অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে এমন উদাহরণই বেশি। জীবনমানের উন্নতি হয়েছে এমন নজির খুব কম। যারা অল্প জমির তাদের জমি বেড়েছে, যারা হাঁসমুরগি পালার জন্য ঋণ নিয়েছেন তারা বড় খামার করেছে এমন উদাহরণ আমরা পাই নাই বললে চলে।

বাংলানিউজ: ক্ষুদ্র ঋণসংক্রান্ত কিছু কিছু প্রতিবেদন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলেও সবই তো আসে না। এটা এখন জাতীয়, আন্তর্জাতিক পরিসরে স্বীকৃত একটি বিষয়।

জাঈদ আজিজ: এমনও ঘটনা আছে, ২০/৩০ বছর একসাথে থাকার পর ঘরসংসার ভেঙে যাচ্ছে। স্বামীর অগোচরে ঋণ নেওয়ায় তালাকের ঘটনা ঘটছে। ক্ষুদ্রঋণের প্রতিক্রিয়ায় পরিবার, সমাজ ভেঙে পড়ছে। লোক ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে পালিয়ে শহরে চলে আসছে। পুরুষ শহরে এসে রিকশা চালাচ্ছে। নারী গার্মেন্টস-এ কাজ করছে, বুয়া-আয়ার কাজ করছে। টিকতে না পেরে আবার গ্রামে ফিরে যাচ্ছে। ভিটামাটি হারানোর পর অন্যের আশ্রয়ে যাচ্ছে।

বাংলানিউজ: আপনার সঙ্গে টম হাইনেমানের যোগাযোগ হলো কিভাবে?

জাঈদ আজিজ: আকস্মিকভাবেই যোগাযোগ হয়েছে। একদিন শাহবাগ মোড়ে এসে একটা লোক জানতে চাইল, নরসিংদী কোথায় বলতে পারেন? আমরা কয়েকজন বন্ধু সেখানে আড্ডা মারছিলাম। তিনি বললেন, তিনি এসেছেন ভারত থেকে একটা ডকুমেন্টারির কাজ করতে। আমি জানতে চাইলাম নরসিংদীতে কী কাজ। তিনি জানালেন, টাওয়ার অব প্রমিজ নামে একটা ডকুমেন্টারির জন্য ছবি তুলতে হবে। ডিরেক্টর টম হাইনেমান। ওর মাধ্যমেই টমের সঙ্গে যোগাযোগ হয়।

বাংলানিউজ: কট ইন মাইক্রো ডেট প্রামাণ্যচিত্রটি নির্মাণের বিষয়টি কি ড. ইউনূস জানতেন?

জাঈদ আজিজ: হ্যাঁ, আমরা তার সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু তিনি যোগাযোগ করতে চাননি।

বাংলানিউজ: আপনাকে ধন্যবাদ।
জাঈদ আজিজ: আপনাকেও ধন্যবাদ।

বাংলাদেশ সময়: ১৪৩১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০২, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।