ঢাকা, বুধবার, ২৮ মাঘ ১৪৩১, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২ শাবান ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

পল্লীফোনে নিঃস্ব অনেকেই!

ইশতিয়াক হুসাইন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪১৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৯, ২০১০
পল্লীফোনে নিঃস্ব অনেকেই!

পীরগাছা, রংপুর থেকে: ফোনের ব্যবসা করে দ্রুত অর্থলাভের আশায় পীরগাছার তাজুল ইসলাম গ্রামীণ ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণে পল্লীফোন নিয়ে এখন নিঃস্ব। উপজেলার পারুল ইউনিয়নের দেউতি গ্রামের এই তাজুল ইসলাম ব্যবসা করে বড় হওয়া তো দূরে থাক ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে অভাব অনটনে দিন কাটাচ্ছেন।


 
সরেজমিনে দেউতি গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, শুধু তাজুল ইসলামই নন, পল্লীফোন নিয়ে লাভের বদলে নিঃস্বই হতে হয়েছে বেশিরভাগ গ্রাহককে। প্রথম দিকে শুধুমাত্র নারীদের এই মোবাইল ফোন দেওয়ার কথা বললেও দ্রুত পুরুষরাও মোবাইল নেওয়ার সুযোগ পেয়ে যান। এ সুযোগেই গ্রামীণ ব্যাংকের সৈয়দপুর শাখা থেকে ২২ হাজার টাকা দিয়ে পল্লীফোনের সংযোগ ও মোবাইল সেট নেন তাজুল ইসলাম। এর মধ্যে ১০ হাজার টাকা নগদ পরিশোধ করেন তিনি। বাকি ১২ হাজার টাকা গ্রামীণ ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে পরিশোধ করেন।
 
তাজুল ইসলামের অভিযোগ, পল্লীফোন নেওয়ার আগে প্রায়ই সৈয়দপুর শাখার গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মকর্তারা এসে এই ফোন নিতে উৎসাহ দিতেন। ২০০৩ সালে দেউতি গ্রামের অনেক যুবককে অতি অল্প সময়ে বড় লোক হতে পল্লীফোন সাহায্য করবে বলে বোঝানো হয়। ‘মোবাইল ফোন কিনে গর্বিত মালিক হোন’ এ ধরনের প্রলোভন ও স্বপ্নের কথা শোনাতেন গ্রামীণ ব্যাংকের কর্তা-ব্যক্তিরাও। গ্রামের অশিক্ষিত গরিব মানুষ গ্রামীণ ব্যাংকের শিক্ষিত কর্তাদের কথায় পূর্ণ আস্থা রেখে একে একে অনেকেই পল্লীফোনের গর্বিত মালিক হতে ঝাপিয়ে পড়ে।  
 
তাজুলের সঙ্গে একই গ্রামের জাহিদুল ইসলাম টেক্কা, সক্কু মিয়া, সাইফুল ইসলাম, মো. মান্নান, আতাবুল ইসলাম, কানুরা গরিব মানুষ ঋণ নিয়ে পল্লীফোনের গর্বিত মালিক হন। তাজুল ইসলাম পল্লীফোন নেওয়ার আগে দেউতিবাজারে ওষুধ দোকান দিয়ে ছিলেন। গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মকর্তারা তাজুলসহ অন্যদেরকে বলেন মিনিটে ৩/৪ টাকা ব্যয়ে ৫/৬ টাকা ব্যবসা করতে পারবে।
 
ওষুধের ব্যবসার পাশাপাশি পল্লীফোনের ব্যবসা চালাতে থাকেন তাজুল ইসলাম। কিন্তু অতি মুনাফা লাভের আশায় ও মোবাইল ফোনের কাস্টমারদের আগমনে মন ফুরফুরে হয়ে যায় তাজুলের। এত মানুষ, এত কল। দ্রুতই উন্নতির স্বপ্ন দেখতে থাকেন এই যুবক। কিন্তু কিছুদিন যেতেই দেখেন মাস শেষে তার কলের হিসাবের সাথে গ্রামীণের বিলের সামঞ্জস্য নেই। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, হয়তো দেখা গেছে তিনি মাসে ১০ হাজার টাকার কল করেছেন। অথচ বিল এসেছে ১২ থেকে ১৪ হাজার টাকা। তারপরেও দমে যান না তিনি। গ্রামীণ ব্যাংকের কর্তাদের কাছে তার এই বেশি বিল আসার কারণ জানতে চান। তারা তাজুলকে বলেন, তোমার হিসাবে ভুল হচ্ছে।
 
নিজের ওষুধের দোকানের পুঁজি থেকে বিল মিটিয়ে দিয়ে আবারও ব্যবসা চালাতে থাকেন। তার ভুল হচ্ছে ভেবে ব্যবসা চালিয়ে যেতে থাকেন। কিন্তু প্রায় চার বছর ব্যবসা চালিয়ে যখন হিসাব মিলাতে বসেন ততদিনে নিজের ওষুধের ব্যবসার পুঁজি থেকে প্রায় এক লাখ টাকা চলে গেছে। সম্বিত ফিরে পেতে তাজুলের আর দেরি হয়নি। সাথে সাথে তার পল্লীফোন ছেড়ে দেন।
 
২০০৩ সালে পল্লীফোন নিয়ে দেউতিবাজারের যে ৮/১০ জন ব্যবসা শুরু করেছিলো বছর খানেক যেতে না যেতে তাদের অনেকেরই ভুল ভাঙে।     
 
এদিকে, তাজুলের ওষুধের ব্যবসাও ততদিনে শেষ হয়ে গিয়েছে। ওষুধের ব্যবসায় নজর না দেওয়া, নতুন ওষুধ না আনা এবং এই ব্যবসার অর্থ ফোনের ব্যবসার পিছনে বিনিয়োগ করে এখন সত্যিকার ভাবে নিঃস্ব তাজুল। তিনি বলেন, মিনিটে পল্লী ফোনে কত বিল কাটতো তা নিয়ে আজো তার সন্দেহ আছে। তাজুলের প্রশ্ন বিল সম্পর্কে ওরা (গ্রামীণ ব্যাংক) কি সত্যি বলতো? তাজুল ইসলাম নিজের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করতে করতে বলে ওঠেন ‘মোবাইল ফোনের নতুন এই প্রযুক্তি আমাদের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েই ড. ইউনূস নোবেল পেয়েছেন!’
 
দেউতিবাজারের জাহিদুল ইসলাম টেক্কা বলেন, এতসব প্রলোভন দেখালেও অনেক প্রতিশ্রুতিই তারা রাখেননি। তিনি বলেন, সিম ও মোবাইল ফোন সেট ফেরত দিলে মোবাইল ফোনের অর্ধেক টাকা ফেরত দেবে বলে জানিয়েছিল। অথচ কয়েক বছর পর যখন সিম ও মোবাইল ফোন ফেরত দিতে যান তখন তাদেরকে কোনো টাকাই দেওয়া হয়নি। বলা হয়, সিমের দাম কমে গেছে। তাই আর টাকা ফেরত দেওয়া যাবে না।

এসব অভিযোগের বিষয়ে রংপুরের গ্রামীণ ব্যাংকের স্থানীয় কর্মকর্তারা কিছুই জানেন না বলে জানান। দৌলতবাজার ব্রাঞ্চের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘অনেক আগে থেকেই তাদের ব্রাঞ্চে পল্লীফোন বিষয়ক কোনো কার্যক্রম চলছে না। ’

তিনি বলেন, দায়িত্ব নেওয়ার সময় আমাদের হাতে পল্লীফোনের কোনো কাগজপত্র বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি।     
 
স্থানীয় সময়: ১১৩৮ ঘন্টা, ০৯ ডিসেম্বর, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।