ঢাকা, বুধবার, ২৮ মাঘ ১৪৩১, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২ শাবান ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

সরেজমিন: রাজশাহীর পদ্মাপাড়ে গ্রামীণব্যাংকের কিস্তির অত্যাচার!

সাঈদুর রহমান রিমন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৫৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১০, ২০১০
সরেজমিন: রাজশাহীর পদ্মাপাড়ে গ্রামীণব্যাংকের কিস্তির অত্যাচার!

রাজশাহী হরিপুর সীমান্ত থেকে: পদ্মার তীরে ইংরেজ নীলকুঠির সাহেবদের নিষ্ঠুরতাকেও হার মানিয়েছে গ্রামীণ ব্যাংকের ‘কিস্তির অত্যাচার’। সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মচারীদের অব্যাহত তাগিদ, হুমকি-ধমকির মুখে সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোর ঋণগ্রহীতা বহু নারী বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছেন।

স্বামীর সংসার করতে পারছেন না রীতা বেগমের (২৫) মতো অনেকেই। ঋণ-কিস্তির ঝুট-ঝামেলার কারণে হরিপুরের বকুল মিয়া ক’দিন আগেই তালাক দিয়েছেন স্ত্রী সেলিনাকে (৩৮)। সেলিনার কিশোরী মেয়ে ববিতাকেও বাড়ি ছেড়ে নিরুদ্দেশ হতে হয়েছে। ছেলে-মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে রাতের আঁধারে ফুলী বেগমকে (৩৫) পালাতে হয়েছে বেড়পাড়া গ্রাম থেকে।

যারা গ্রাম ছেড়ে পালাতে পারছেন না তারা রীতিমত জিম্মি অবস্থায় দিনাতিপাত করছেন, শিকার হচ্ছেন নানামুখি অত্যাচারের। সাপ্তাহিক কিস্তির টাকা দিতে ব্যর্থ হলে রেহাই নেই। কেড়ে নেওয়া হচ্ছে হালের বলদ, খুলে নেওয়া হচ্ছে চালের টিন।

ঋণের টাকা আদায়ের নামে কাবুলিওয়ালাদের মতো গ্রামীণব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দলবল নিয়ে বাড়ি বাড়ি চড়াও হচ্ছেন। কিস্তি আদায়কারী নব্য কাবুলিওয়ালারা স্থানীয় পর্যায়ে ‘মাস্টার সাহেব’ বলে সম্বোধন করা হয়। এই মাস্টার সাহেবদের সাইকেলের বেইল কিংবা মোটর সাইকেলের শব্দ শুনলেই আত্কে উঠেন ঋণগ্রহীতারা। ঘরের কাজ, রান্নাবান্না ফেলে যেভাবে পারেন সেভাবেই পালিয়ে যান তারা।

গত দু’দিন সরেজমিন ঘুরে রাজশাহীর সীমান্তবর্তী পদ্মাপারের সোনাইকান্দি, বেড়পাড়া, হরিপুর, নিমতলা, খোলাবোনা, আলীপুর, প্রেমতলী, গোদাগাড়ীর গ্রামে গ্রামে এমন পরিস্থিতি দেখা গেছে। কিস্তির টাকা জোগাড় করা নিয়ে ঘরে ঘরে ঝগড়াঝাটি, কান্নাকাটির রোল। ভুক্তভোগীরা বলেছেন, গ্রামীণব্যাংকের ‘মহাজনী সুদের’ ঋণ গ্রামবাসীর জন্য অশান্তির অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে গ্রামীণ ব্যাংকের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা ঋণের দায়ে বিভিন্ন গ্রাম থেকে কিছুসংখ্যক নারী সদস্য পালিয়ে গেছে বলে স্বীকার করলেও সেজন্য নিজেদের দায়ী মনে করেন না।

গ্রামীণব্যাংকের হরিপুর শাখা ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ আব্দুল জলিল বাংলানিউজকে বলেন, ‘দুষ্টু প্রকৃতির কিছু মহিলা গ্রামীণ ব্যাংকসহ বিভিন্ন এনজিও থেকে হাজার হাজার টাকা ঋণ তুলে রাতের আঁধারে পালিয়ে গেছে। এ কারণে গ্রুপভুক্ত অন্য সদস্যদের কাঁধে সেসব ঋণের দায় চেপেছে। তবে ঋণের টাকা একশ’ ভাগই আদায় হচ্ছে। ’

সরেজমিন হরিপুর...
রাজশাহী মহানগর থেকে মাত্র ৬ কিলোমিটার দূরে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সড়কের পাশেই হরিপুর। পদ্মা নদীর তীরঘেঁষা এ জনপদে অভাব মানুষের বসবাস। নদী ভাঙ্গনের কারণে অসংখ্য পরিবারই বিপন্ন প্রায়, কর্মসংস্থানের নিশ্চিত কোনো উপায় নেই। ভারত-বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকা হওয়ায় হরিপুর ইউনিয়নের কিছু লোক চোরাকারবারে জড়িত থাকলেও বাকিরা কঠোর পরিশ্রম করে কোনো রকমে দু’মুঠো আহার জোটান।

স্থানীয় বাসিন্দা ফিরোজ কবীর জানান, অভাব-দারিদ্রের সুযোগ নিয়ে হরিপুরের গ্রামগুলোতে ১০/১২ বছর আগে গ্রামীণব্যাংক কার্যক্রম শুরু করে। ভাগ্য পরিবর্তনের প্রলোভন দিয়ে আশা, ব্র্যাক, ঠেঙ্গামারা মহিলা সমিতিসহ প্রায় এক ডজন এনজিও ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম নিয়ে মাঠে নামে। গ্রামীণব্যাংক প্রথমে গ্রামে গ্রামে নারীদের সমন্বয়ে গ্রুপ গঠন ও তাদের মধ্যে ঋণ বিতরণ শুরু করে। হরিপুরের ঋণগ্রহীতা আছিয়া বেগম (২৬), তানজিলা (২৮), আদিনা (৩৪), সুফিয়া খাতুন (৩৫) সহ কয়েকজন বাংলানিউজকে জানান, চড়া সুদে গ্রামীণব্যাংকের ঋণ শোধ করতে বেশিরভাগ সদস্যই ব্যর্থ হন। কিন্তু কিস্তির টাকা আদায়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কমচারীদের বেপরোয়া আচরণ শুরু করেন। তাদের অব্যাহত চাপের মুখে দিশেহারা এসব ঋণগ্রহীতা অন্য এনজিও বা গ্রামীণব্যাংক থেকে আরও বেশি পরিমাণ ঋণ নিয়ে বকেয়া পরিশোধে বাধ্য হন। গ্রামীণের মহিলা গ্রুপের সদস্য সেলিনা বেগম (৩৮) বলেন, ‘অতিরিক্ত সুদ শোধের লাগ্যা বেশি বেশি কিস্তি (ঋণ) লিয়ে ঠ্যালায় পইর‌্যাছি। ’

বৃহস্পতিবার সকালে হরিপুর গ্রামে গিয়ে নাসিমা বেগমের (৩০) বাড়ি ঘিরে ২৫/৩০ জন ক্ষুব্ধ নারী-পুরুষের ভিড় দেখা যায়। নাসিমার স্বামী মৃত উম্মত আলী। গত ৫ বছরে নাসিমা গ্রামীণ ব্যাংক থেকে বেশ কয়েক দফা ঋণ তুলে তা পরিশোধও করেন। সুদ-আসলে গ্রামীণের ঋণ শোধ করতে তিনি আশা, ঠেঙ্গামারা ও ব্র্যাক থেকেও আলাদাভাবে ঋণ নেন। এখন সব মিলিয়ে নাসিমা বেগমের ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে লক্ষধিক টাকা। প্রতি সপ্তাহে তার কিস্তি বাবদ জোগাড় করতে হয় তিন হাজার ২শ’ টাকা।

নাসিমার প্রতিবেশী সুফিয়া বেগম জানান, পরপর দুই সপ্তাহ নাসিমা কিস্তির টাকা দিতে না পারায় গ্রামীণব্যাংকের ম্যানেজার, মাস্টার সবাই তার বাড়িতে চড়াও হয়ে কিস্তি পরিশোধের জন্য চাপ দিতে থাকেন। নিরুপায় নাসিমা বেগম ১০/১২ দিন আগে ঘরবাড়ি সব ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। নাসিমা নেই, তবু গ্রামীণ ব্যাংকের কিস্তি আদায়কারীরা দিন-রাতে ৪/৫ বার হাজির হচ্ছেন, খোঁজাখুঁজি করছেন। নাসিমার ঘর-বাড়ি বিক্রি করে কিস্তি আদায় করা হবে কিনা এ সিদ্ধান্ত নিতেই বৃহস্পতিবার সকালে তার উঠানে সবাই হাজির হয়েছিলেন।

আরও যারা গ্রামছাড়া

একা নাসিমা নন, কিস্তি পরিশোধের ব্যর্থতা ও ব্যাংক কর্মচারীদের অব্যাহত চাপের মুখে দিশেহারা অবস্থায় ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেছেন বেড়পাড়া গ্রামের ফুলী বেগম (৩৫) ও তার স্বামী ভাদু মিয়া। গ্রামীণব্যাংকের কিস্তি আদায়কারী কর্মকর্তারা পাওনা আদায়ের জন্য ফুলী বেগমের বাড়ি চড়াও হন। তারা অন্য সদস্যদের সহযোগিতায় তার ঘরের টিনের চালা খুলে নিয়ে ৬ হাজার টাকায় বিক্রি করে দেন। ফুলী বেগমের মতো আরো যারা গ্রামছাড়া তাদের মধ্যে আছেন সোনাইকান্দি গ্রামের মৃত টুকু মিয়ার স্ত্রী লতিফা বেগম (৩০), সালেক মিয়ার স্ত্রী জরিনা খাতুন (৩২), হরিপুরের আশরাফ আলীর মেয়ে রীতা বেগম (২৫), পিতা বকুল মিয়ার কিশোরী মেয়ে ববিতা আক্তার (১৬)।

কিস্তি পরিশোধে ঝামেলার কারণে বকুল মিয়া তার স্ত্রী সেলিনা বেগমকে (৪০) পিটিয়ে বাড়িছাড়া করে তালাক দেন বলেও এলাকাবাসী জানিয়েছেন। মায়ের অনাদায়ী কিস্তির কারণে তাদের কিশোরী মেয়ে ববিতাকেও পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে।

হরিপুরের ব্যবসায়ী মামুন মিয়া, ইউপি সদস্য মেকাইল হোসেন, স্কুলশিক্ষক তবিবুর রহমানসহ কয়েকজন বাংলানিউজকে জানান, কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থতার জন্য প্রতিটা গ্রামেই ৫/৭ টা করে পরিবার গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে এমন নজির আছে। গ্রামীণের কিস্তি আর ঋণের চড়া সুদ এখন তাদের গলায় ফাঁস হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বাংলাদেশ সময় ১৮১০, ডিসেম্বর ০৯, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।