রাজশাহী সীমান্ত থেকে ফিরে: ঋণের কিস্তি ফাঁস হয়ে বসেছিলো গলায়। চালের টিন, ঘরের হাড়ি-বাসন আর ভিটে বিক্রি করে ঋণের অধিকাংশ টাকাই তুলে নিয়েছিলো এনজিওর লোকজন।
তাই পালিয়েছিলেন নিজের বসত ভিটে আর গ্রাম ছেড়ে। কিন্তু রেহাই মেলেনি তাতেও। এখন রাজশাহী নগরীতে ঠিকা ঝিয়ের কাজ করে গ্রামীণ ব্যাংকের কিস্তি দিতে হচ্ছে বেড়পাড়ার অভাগী ফুলীকে। আর ঋণ-কিস্তি দুর্ভাগ্যের সঙ্গী হতে হয়েছে তার ১০ বছর বয়সের শিশু সন্তান সাজেমুলকে। এটুকু বয়সেই সাজেমুল মোটর গ্যারেজের ফুট-ফরমায়েশ খেটে তার মাসিক বেতনের ৫শ’ টাকাই মায়ের কিস্তির যোগান হিসেবে দিচ্ছে। মা-ছেলে মিলে প্রতি মাসে আয় করছে দুই হাজার টাকা। তা থেকেই কিস্তি দিতে হচ্ছে ১২শ’ টাকা।
রাজশাহীর দাসপুকুর মহল্লায় সপরিবারে আশ্রয় নেওয়া ফুলী বেগম বাংলানিউজকে জানান, কিস্তি আদায়কারীদের সীমাহীন চাপের মুখে নিজ গ্রাম ছেড়ে সপরিবারে পালাতে হয় তাকে। দু’বছর আগে তার পরিবারের উপর ঘটে যাওয়া কিস্তির নির্মমতার কথা মনে করে আজও কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন ফুলী। সেদিন গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণগ্রহীতারা তার বাড়িতে চড়াও হয়ে খুলে নেয় চালের টিন। তারা ঘরের হাড়ি-পাতিল, বাসন-পেয়ালা, আসবাবপত্র সব লুটে নিয়ে আদায় করে সুদের পাওনা। এক দিনের মধ্যেই বাড়ির ভিটে-মাটি বিক্রির মাধ্যমে ব্যাংকঋণেরও আংশিক আদায় করে নেওয়া হয়। এতেও ক্ষ্যান্ত হননি এনজিও’র পাওনাদাররা। বাকি টাকা পরিশোধের জন্যও ফুলীর উপর মাত্রাতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি ও পীড়াপীড়ি চলতে থাকে। তখনও তার মাথার উপর গ্রামীণ ব্যাংকের ১০ হাজার, আশা সমিতির ১০ হাজার ও ঠেঙ্গামার সমিতির ১৫ হাজার টাকা ঋণের বোঝা, এর সঙ্গে যোগ হয়েছে চড়া সুদ।
বিপর্যয়ের মুখে স্বামী ও তিন সন্তানকে নিয়ে ফুলী বেগম রাতের আঁধারে পালিয়ে যান শহরে। কিন্তু তাতেও রেহাই মেলেনি, সেখানেও হাজির হন কিস্তি আদায়কারীরা। তার উপর আবার শুরু হয় কিস্তি শোধের চাপ, চলে ভয়ভীতি প্রদর্শন।
ফুলী বেগম বাংলানিউজকে বলেন, ‘কিস্তির ডরে পাইল্যা গেছি শহরে, একজনার বাড়িতে তার দয়ায় আশ্রায় পাইয়্যেছি। এখানেও তাইড়্যা চইলা আইসছে কিস্তির মাস্টাররা-কোন্ঠে যাবো বুলেন তো?’
কিস্তি আদায়কারীরা ফুলীর কাছে বকেয়া ১০ হাজার টাকার জন্য বেপরোয়া চাপাচাপি শুরু করেন। উপায়ন্তরহীন অবস্থায় তিনি ছয় মাসের মধ্যে কিস্তিতে পাওনা পরিশোধের অঙ্গীকার করে তবেই রেহাই পান। কিন্তু শহরে আশ্রয় নিয়ে স্বামীর রিক্সা চালানোর আয়ে পরিবারের ৫ সদস্যের মুখের আহার জোটানোই কষ্টকর, আবার কিস্তির টাকা যোগাড় হবে কোত্থেকে ? বাধ্য হয়েই ফুলী বেগম শহরের বাসা-বাড়িতে ঠিকা ঝিয়ের কাজ শুরু করেন। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত তিনটি বাসায় কাজের বিনিময়ে দেড় হাজার টাকা পান তিনি। পাশাপাশি নিজের নাবালক শিশুপুত্র সাজেমুলকে (১০) একটি মোটর গ্যারেজের কাজে লাগিয়ে দেন। গ্যারেজের ধোয়া-মোছা, ফুট ফরমায়েশের কাজে সাজেমুল প্রতি মাসে পায় ৫শ’ টাকা বেতন।
ফুলী বেগম বলেন, ‘ব্যাটা (সাজেমুল) আমার কষ্ট বুঝে, বেতনের একটা টাকাও লষ্টো করে না-সব টাকা আইন্যা আমার হাতে দেয়। মা-ব্যাটা’র টাকায় মাসে মাসে কিস্তি চালাছি। ’
তিনি জানান, এভাবে সব ঋণই প্রায় পরিশোধ করা হয়েছে। আর কিছুদিন কিস্তি দিতে পারলে গ্রামীণের ঋণও পুরোপুরি পরিশোধ হয়ে যাবে। কঠোর পরিশ্রমে সব ঋণ তার শোধ করা হবে ঠিকই, কিন্তু নিজের জন্মভূমি, বসতি গ্রামে আর কোনোদিনই তার ফিরে যাওয়া হবে না। গ্রামে ফেরার কথা বলতেই লজ্জা, অপমান, পালানোর নির্মমতা, কষ্ট-যন্ত্রণার কথা মনে করে নুয়ে পড়েন ফুলী বেগম, দু’চোখ বেয়ে শুধু অশ্রু গড়িয়ে পড়ে তার।
ফ্যাশ ব্যাক...
ফুলী বেগম বাংলানিউজকে জানান, গ্রামীণব্যাংক ও আশা সমিতির ঋণ খেলাপী হওয়ার কারণেই তার উপর নেমে আসে সীমাহীন নির্মমতা। রাজশাহীর পবা থানাধীন হরিপুর ইউনিয়নের বেড়পাড়া গ্রামে তার বাড়ি ছিল। স্বামীর নাম ভাদু মিয়া। স্বামীর রিক্সা চালানো আয়ের উপর নির্ভর করে তিন সন্তানসহ ৫ সদস্যের সংসারের চাকা যেন ঘুরতে চাইতো না। এ জন্য পাঁচ বছর আগেই ফুলী বেগম গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণ গ্রহিতার তালিকায় নিজের নাম লেখান। সেখান থেকে ঋণ তুলে হাঁস-মুরগি পালন শুরু করেন, দ্বিতীয় দফা ঋণের টাকায় গাভী কেনেন তিনি। তিন বছরের মধ্যেই মোটামুটি স্বচ্ছল হয়ে উঠে ফুলীর সংসার।
ফুলী জানান, দু’বছর আগে একটা অটো রিকসা (মিশুক) কেনা থেকেই তার দুর্ভাগ্যের যাত্রা শুরু। গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ২৫ হাজার টাকা ও আশা সমিতি থেকে ২০ হাজার টাকা ঋণ তুলে, তা থেকে ৩৭ হাজার টাকা দিয়ে পুরনো মিশুক কেনেন। স্বামীকে রিক্সা চালানোর কঠোর পরিশ্রম থেকে সরানোসহ একটু বেশি আয়ের আশাতেই ফুলীর এ মিশুক কেনা। কিন্তু পুরনো মিশুকটি ঘন ঘন বিকল হওয়ায় আয় দূরের কথা, দফায় দফায় তা মেরামত করতেই জমানো টাকা শেষ হতে থাকে। ৬ মাস পর ৩৭ হাজারে কেনা মিশুকটি মাত্র ১৫ হাজার টাকায় বিক্রি করতে বাধ্য হন তিনি। ততদিনে গ্রামীণের ‘কিস্তি খেলাপি’ হিসেবে নাম উঠে তার। ব্যাংক কর্মকর্তাদের অব্যাহত পীড়াপীড়িতে কিস্তি শোধ না করে আর উপায় থাকে না। এ কারণে ফুলী বেগম ঠেঙ্গামারা সমিতি থেকে ১০ হাজার টাকা ঋণ তুলে গ্রামীণ ব্যাংক ও আশা সমিতির কিস্তি শোধ করতে থাকেন।
২০০৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে তিনটি সংস্থা ও গ্রামীণ ব্যাংকের দুই সদস্যার কাছ থেকে চড়া সুদে নেওয়া ঋণের সাপ্তাহিক কিস্তির পরিমাণ দাঁড়ায় ৪ হাজার ২শ’ টাকা। অল্পদিনেই সর্বশান্ত হয়ে পড়েন ফুলী।
ঘরে খাবার নেই, এরই মধ্যে গ্রামীণ ব্যাংকের মাঠ কর্মীরা ৫০/৬০ জন মহিলা সদস্যসহ হাজির হন তার আঙ্গিনায়। তারা কিস্তি খেলাপের কারণে ফুলী বেগমের হাড়ি-পাতিল থেকে শুরু করে পুরনো কাপড় চোপড় পর্যন্ত লুটে নিয়ে যায়। চালের টিন, ঘরের খুঁটি, দরজা-জানালা কোনো কিছুই আর অবশিষ্ট থাকে না। বাড়ির ভিটেও মাত্র ২০ হাজার টাকায় বিক্রি করতে হয়। ভিটে বিক্রির ১০ হাজার টাকা গ্রামীণ ব্যাংক ও বাকি ১০ হাজার আশা সমিতি নিয়ে নেয়। পরদিনই ছিল ঠেঙ্গামারা সমিতির কিস্তি দেওয়ার দিন। তাই রাতেই স্বামী ও তিন সন্তানকে নিয়ে ফুলী বেগম গ্রাম ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন।
বাংলাদেশ সময় : ২১৩০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৭, ২০১০