ঢাকা, বুধবার, ২৮ মাঘ ১৪৩১, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২ শাবান ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

অনুসন্ধান-১

রাজশাহীতে গ্যাস্টারের ভেজাল সারে কৃষকের সর্বনাশ!

সাঈদুর রহমান রিমন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৪২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৪, ২০১০
রাজশাহীতে গ্যাস্টারের ভেজাল সারে কৃষকের সর্বনাশ!

রাজশাহী থেকে ফিরে: নর্থবেঙ্গল গ্যাস্টার কেমিক্যাল ইন্ডাষ্ট্রিজ নামের একটি কারখানার বিরুদ্ধে নকল সার প্রস্তুত ও বাজারজাত করে হাজার হাজার কৃষকের সর্বনাশ ঘটানোর অভিযোগ উঠেছে। তবে অভিযোগ উপেক্ষা করেই কারখানাটি ভেজাল সার তৈরি করে তা বাজারে ছাড়ছে।

কোনরকম অনুমোদন ছাড়াই এক যুগেরও বেশি সময় ধরে নকল সার-কীটনাশক উৎপাদন করে অপেক্ষাকৃত সস্তায় তুলে দিচ্ছে গরীব চাষীদের হাতে।

বেশ কয়েক দফা প্রশাসনিক অভিযানে গ্যাস্টার কোম্পানির ভেজাল সার আটক, নকল সার তৈরির সরঞ্জামাদি জব্দ এমনকি মোবাইল কোর্টে শাস্তি দেওয়ার পরেও এই চক্রের জালিয়াতি থামছে না। বরং অভিযোগ রয়েছে স্থানীয় পর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তা, থানা-পুলিশসহ অন্যান্য সংস্থায় মাসোহারা দিয়ে চক্রটি তার ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে।

আর এ সার ও কীটনাশক ব্যবহার করে কপাল পুড়ছে কৃষকের।

রাজশাহী মহানগরের মধ্যেই এ কারখানায় চায়না কে পাউডারের সঙ্গে মাটি-বালু-পাথরকুচি, লবন আর রঙ মিশিয়েই তৈরি হচ্ছে ১০ প্রকার সার। বাংলানিউজের অনুসন্ধানে ভেজাল সার চক্রটির নানা কাহিনী বেরিয়ে এসেছে।

কারখানাটির অবস্থান রাজশাহী মহানগরীর মঠপুকুর এলাকায়। রাস্তা সংলগ্ন দু’টি স’মিল ও ঝুপরি বস্তির কর্দমাক্ত ঝোপ পেরিয়ে তবেই কারখানাটির কাছে পৌঁছানো যায়। ভেজাল সার উৎপাদন ও সরবরাহের লাখ লাখ টাকার ব্যবসা করে গেলেও এর জন্য ট্রেড লাইসেন্স পর্যন্ত করা হয়নি। কারখানার সামনে নেই কোনো সাইনবোর্ড।
 
স্থানীয় বাসিন্দা সুরমান আলী, আজমুল শেখ, জানে আলমসহ কয়েকজন বাংলানিউজের কাছে অভিযোগ করলেন, স্থানীয় পর্যায়ের কতিপয় কৃষি কর্মকর্তা ‘মাসোহারা’র বিনিময়ে ভেজাল সার কারখানাটি সচল রাখতে সহায়তা করেন। আর মাসোহারা বকেয়া পড়লেই পুলিশ নিয়ে তারা লোক দেখানো অভিযানও চালান। ’

স্থানীয়দের ভাষায়, অভিযানে অবৈধ ওই কারখানা থেকে নকল সার, সার প্রস্তুতের সরঞ্জাম ও প্যাকেট জব্দ হয়, যথারীতি মামলাও রুজু হয়। ব্যস ওই পর্যন্তই, চাহিদা মাফিক মাসোহারা পকেটস্থ হলে আবার সবকিছু ধামাচাপা পড়ে থাকে।

এর আগে একাধিক বার ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে ভ্রাম্যমাণ আদালত ওই কারখানা সীলগালা করে দেয়, নকল সার জব্দ করে পাঠানো হয় পরীাগারে। কিন্তু ভ্রাম্যমাণ আদালতের লাগানো সীলগালা ভেঙ্গে চক্রটি আবার ভেজাল সার প্রস্তুতের অপকর্ম অব্যাহত রাখতে সম হয়। সীলগালা ভাঙ্গার অপরাধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পুনরায় সেখানে অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ ভেজাল সারসহ নানা উপকরণ জব্দ ও ফেরদৌস মিয়া (২৮) নামে কারখানার এক পরিচালককে গ্রেপ্তার করে জেলহাজতে পাঠায়।
এতকিছুর পরও গ্যাস্টারের ভেজাল সার তৈরির কাজ থেমে নেই।
চক্রটি প্রশাসনিক নজর এড়াতে এখন মূল কারখানার পরিবর্তে বিভিন্ন গ্রামে সার প্রস্তুতের উদ্যোগ নিয়েছে। অতিসম্প্রতি মোহনপুর থানার পুলিশ মৌগাছী গ্রামে এ ধরনের একটি কারখানার সন্ধান পায়। সেখানে অভিযান চালিয়ে পুলিশ বিপুল পরিমাণ ভেজাল সার আটক ও কারখানার কেয়ারটেকার আমজাদ হোসেনকে গ্রেপ্তার করে।

ভেজাল-জালিয়াতির নমুনা
সূত্র জানায়, গ্যাস্টার কোম্পানির ভূয়া কারখানায় শুরুতে দু’ ধরনের নকল সার তৈরি হলেও এখন ১০ রকমের সার ও কীটনাশক হয়। মৃত্তিকা প্রাণ সবুজ সার নামে যে প্রোডাক্টটি গ্যাস্টার বাজারজাত করে তাতে এক কেজি লবন আর সবুজ রঙ ছাড়া অন্য কিছুই থাকে না। মাত্র ১৬ টাকা খরচ করে তৈরিকৃত একেক প্যাকেট সবুজ সার বিক্রি করা হয় ৮০/৯০ টাকায়।

একইভাবে ভারতীয় সার ২০০ গ্রাম, শুকনো মাটি ও পাথরকুচি ৫০০ গ্রাম, চক পাউডার ১০০ গ্রাম এবং ক্যালসিয়াম পাউডার (যা প্রতি বস্তা মাত্র আড়াই’শ টাকা) ২০০ গ্রাম মিশিয়ে গ্যাস্টার কারখানায় তৈরি হয় এক কেজি ওজনের মিলি সালফার। প্রতি প্যাকেট মিলি সালফার তৈরিতে খরচ হয় মাত্র ৩৬ টাকা। অথচ এর প্যাকেটের গায়ে খুচরা বিক্রি মূল্য লেখা রয়েছে ২৩৫ টাকা। ডিলাররা মিলি সালফারের প্যাকেট ১০০ টাকায় কিনে তা কৃষকদের কাছে ২০০-২২০ টাকায় বিক্রি করে।
 
মৌগাছী’র গ্যাস্টার কারখানা থেকে গ্রেপ্তার হওয়া কেয়ারটেকার আমজাদ হোসেন মোহনপুর থানা পুলিশকে এসব তথ্য জানান। তার দেওয়া তথ্যমতে, মৃত্তিকা প্রাণ সবুজ সার ও মিলি সালফার ছাড়াও গ্যাস্টারের নকল কারখানায় প্রস্তুতকৃত সাদা দস্তা, বরুন সার, এসওপি, ফিস ম্যাজিক কার্ড, সুপার পাওয়ার হিট, ওয়াটার অক্সিজেন নামে ভেজাল সার ও কীটনাশক দেদারছে বাজারজাত হচ্ছে। ’

থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আহসান হাবিব বাংলানিউজকে জানান, কৃষকের সর্বনাশ ঘটিয়ে নকল সার বাজারজাতের মাধ্যমে গ্যাস্টার চক্রের সদস্যরা লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। তিনি বলেন, আমজাদ হোসেনের দেওয়া তথ্যের সূত্র ধরে ওই চক্রের রহমত আলী, আব্দুল কুদ্দুস ও ফেরদৌস মিয়াসহ মূল হোতাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

(ভেজাল সার কারখানার আরও তথ্য, কৃষি কর্মকর্তাদের বক্তব্য ও গ্যাস্টার মালিকের সাক্ষাৎকার নিয়ে তৈরি দ্বিতীয় কিস্তির প্রতিবেদন পড়তে চোখ রাখুন বাংলানিউজে)

বাংলাদেশ সময় : ১৪৩৩ ঘন্টা, ডিসেম্বর ২৪, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।