ঢাকা: সরকারি কর্পোরেশনগুলোতে কর্মচারীদের চেয়ে ৪০ শতাংশ কম মজুরি পাচ্ছেন শ্রমিকরা। একই বেতন-ভাতা পাওয়ার কথা থাকলেও এভাবে প্রায় ২০ মাস ধরে কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের মাসিক বেতনের এ বৈষম্য পরিলক্ষিত হচ্ছে।
২০০৯ সালের জুলাই মাসে ঘোষিত পে-কমিশনের আওতায় বেতন পাচ্ছেন রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ছয় কর্পোরেশনের কর্মচারী। অন্যদিকে শ্রমিকরা এখনো মজুরি পাচ্ছেন ২০০৫ সালে ঘোষিত সরকারি গেজেট অনুযায়ী।
শ্রমিক নেতাদের অভিযোগ, একই গ্রেডে থেকেও বেতনের এ বৈষম্য অমানবিক। আর জাতীয় মজুরি কমিশন গঠন করেও তা কার্যকর না হওয়ায় শ্রমিকরা চরম বৈষম্য ও অবহেলার মধ্যেই থেকে যাচ্ছেন।
এর প্রতিবাদে শিগগিরই শ্রমিকরা নতুন করে আন্দোলনে নামতে পারেন বলেও বাংলানিউজকে জানান শ্রমিক নেতারা।
প্রসঙ্গত, রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের মজুরি কাঠামো নির্ধারণে ‘জাতীয় মজুরি ও উৎপাদনশীলতা কমিশন-২০১০’ গঠনের পর পাঁচ মাস পার হলেও এখনো কাজই শুরু করতে পারেনি তারা।
মজুরি নির্ধারণ তো দূরের কথা গত পাঁচ মাসে একটি সভা পর্যন্ত করতে পারেনি এ কমিশন।
রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ছয় শিল্প কর্পোরেশনের শ্রমিক ও কর্মচারীদের মধ্যকার বেতন বৈষম্য নিরসনে শ্রমিকদের দীর্ঘদিনের দাবির মুখে শ্রমিকদের নতুন মজুরি কাঠামো নির্ধারণে গত বছরের ২৪ মে ‘জাতীয় মজুরি ও উৎপাদনশীলতা কমিশন-২০১০’ গঠনের জন্য গেজেট প্রকাশ করে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়।
পরে সাবেক শ্রমসচিব মাহে আলমের নেতৃত্বে ১৭ সদস্যের একটি কমিশন গঠিত হয়। কমিশনকে চার মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়।
এদিকে ২০০৯ সালের জুলাইয়ে সরকার ঘোষিত পে-স্কেলের বদৌলতে ছ’টি শিল্প কর্পোরেশনে কর্মচারীদের অবস্থার পরিবর্তন হয়।
এ ছয় শিল্প কর্পোরেশন হলো- বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশন, বাংলাদেশ পাট কল কর্পোরেশন, বাংলাদেশ বস্ত্র শিল্প কর্পোরেশন, ইস্পাত ও প্রকৌশল শিল্প কর্পোরেশন, বাংলাদেশ রাসায়নিক শিল্প কর্পোরেশন ও বাংলাদেশ বনজ শিল্প উন্নয়ন কর্পোরেশন।
ফলে ২০০৫ সালের গেজেট অনুযায়ী যেখানে একজন চতুর্থ শ্রেণীর শ্রমিক ২৪৫০ টাকা পাচ্ছেন সেখানে কর্পোরেশনের একজন চতুর্থশ্রেণীর কর্মচারী পে-কমিশন অনুযায়ী ৪১০০ টাকা বেতন পাচ্ছেন। যা একই গ্রেডে ১৬৫০ টাকার বেতন বৈষম্য সৃষ্টি করছে।
উল্লেখ্য, ১৯৮৫ সালের পর থেকে এসব প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী এবং শ্রমিকরা একই পরিমাণ বেতন পেলেও কর্মচারীরা কিছুটা বেশি হারে ইনক্রিমেন্ট পেতেন।
বিগত সময়ে সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত মালিকানাধীন শিল্প প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী ও শ্রমিকদের জন্য একই সঙ্গে যথাক্রমে পে কমিশন ও মজুরি কমিশন গঠনের ঘোষণা দেয়।
এ বিষয়ে কমিশনের শ্রমিক পক্ষের প্রতিনিধি শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদের সমন্বয়কারী ডা. ওয়াজেদুল ইসলাম খান বাংলানিউজকে বলেন, ‘কমিশন গঠনের সময় সরকারের পক্ষ থেকে চার মাসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়। শ্রমিকদের মজুরি ও ভাতা পরীক্ষা করে এ প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই শ্রমিকদের মজুরি কাঠামো তৈরির কথা। ’
তিনি বলেন, ‘দুঃখজনক হলেও সত্য, কমিশন গঠনের প্রায় পাঁচ মাস হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত একটি সভাও হয়নি। ’
শ্রমিক ও কর্মচারীদের বেতন বৈষম্য সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘একই প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের বেতন দুই-আড়াই বছর আগে বাড়ল আর শ্রমিকদের বেতন রয়ে গেলো সাত বছর আগের কাঠামোতে, এটি অমানবিক। এরকম বৈষ্যম্যমূলক আচরণ হতে পারে না। ’
কমিশনের অপর শ্রমিক প্রতিনিধি ও জাতীয় শ্রমিক লীগের সভাপতি আব্দুল মতিন মাস্টার বলেন, ‘দু’মাসের মধ্যে এই কমিশন রিপোর্ট দেবে। রিপোর্ট দিলে ২০০৯ সালের জুলাই মাস থেকে বর্ধিত মজুরি কার্যকর হবে। ’
সরকারি মিল-কারখানায় ইতিমধ্যে ২০ শতাংশ মহার্ঘ ভাতা কার্যকর করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রতি মাসে তারা অগ্রীম এক হাজার করে টাকা পাচ্ছে। ’
এ বিষয়ে কমিশনের চেয়ারম্যান মাহে আলমও কমিশনের কাজের অগ্রগতি না থাকার কথা স্বীকার করেন।
বাংলানিউজকে তিনি বলেন- ‘গত ৮ ডিসেম্বর দায়িত্ব নেওয়ার পর কিছু কাজ করেছি মাত্র। কিন্তু প্রয়োজনীয় জনবল না থাকায় কমিশনের তেমন কোন অগ্রগতি সম্ভব হয়নি। ’
তবে মে দিবসের পর সরকারের পক্ষ থেকে জনবল কাঠামো দেওয়া হতে পারে বলেও জানান তিনি।
এদিকে জনবলের পাশাপাশি অবকাঠামো গত সুযোগ-সুবিধার অভাবও কমিশনের কাজ শুরুর অন্তরায় বলে জানিয়েছে একটি সূত্র।
এ পরিস্থিতিতে দাবি বাস্তবায়নে আবার আন্দোলনে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে এসব প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক সংগঠনগুলো।
বাংলাদেশ চিনিকল শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল হক বাংলানিউজকে বলেন, ‘মে মাসের মধ্যে দাবি মানা না হলে আমরা কঠোর আন্দোলনে যাবো। ’
তিনি বলেন, ‘গত বছর শিল্পমন্ত্রীর সঙ্গে এ বিষয়টি নিয়ে কথা বললে তিনি চার মাসের মধ্যে নূন্যতম মজুরি কাঠামো ঘোষণা করা হবে আমাদের আশ্বস্ত করেন। কিন্তু তার ঘোষণার পর প্রায় সাত মাস পার হলেও এ ব্যাপারে কোনো অগ্রগতি নেই। ’
তিনি বলেন, ‘শিল্পমন্ত্রীর আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে দাবি আদায়ে ধর্মঘটসহ যেসব কর্মসূচি দেওয়া হয়েছিলো তা স্থগিত রাখা হয়েছিলো। কিন্তু মে মাসের মধ্যে যদি মজুরি কাঠামো ঘোষণা না করা হয় তবে পূর্ববর্তী কর্মসূচিসহ আরো কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। ’
উল্লেখ্য, গত ৩০ সেপ্টেম্বরে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে অবিলম্বে মজুরি কমিশন গঠনের দাবি জানান বাংলাদেশ চিনিকল শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশন।
একই দাবিতে ঐদিন কর্মবিরতি, ধর্মঘটসহ আন্দোলন কর্মসূচিরও ঘোষণা দেয় ফেডারেশন।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৩৭ ঘণ্টা, এপ্রিল ৩০, ২০১১