ঢাকা, বুধবার, ২৯ মাঘ ১৪৩১, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২ শাবান ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

মিরাজ তত্ত্ব

সৈয়দ গোলাম মোরশেদ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৪৭ ঘণ্টা, জুন ২৯, ২০১১
মিরাজ তত্ত্ব

ইসলামি দর্শনে ‘মিরাজ তত্ত্ব’ একটি গভীর আধ্যাত্মিক তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় ও আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা। রজনীযোগে ভ্রমণ বিষয়টি পবিত্র কোরানে মিরাজসংক্রান্ত আয়াতে বর্ণিত হয়েছে।

নবুয়ত প্রকাশের দশম বছরে, রাসুলুল্লাহ (সা.) এর পঞ্চাশ বছর বয়সকালে, ২৭ রজব ওই অলৌকিক ঘটনা সংঘটিত হয়।

মিরাজ ঘটনা সংঘটিত হবার কয়েক মাস আগে প্রিয় নবী (সা.) এর একমাত্র আশ্রয়দাতা ও প্রাণপ্রিয় চাচা হযরত আবি তালিব (রা.) ও প্রাণপ্রিয় সহধর্মিণী বিবি খাদিজার (রা.) ইন্তেকালে প্রিয় নবী (সা.) কিছুটা মুষড়ে পড়েছিলেন। এ অবস্থায় মহিমাময় আল্লাহ তাঁর বেদনাহত শোকাতুর প্রিয় হাবিবকে (সা.) স্বীয় সন্নিধ্যে নিয়ে যান।  

মিরাজতত্ত্ব নিয়ে মুসলিম দার্শনিক, তত্ত্বজ্ঞানী, ধর্মবিষয়ক লেখকরা আলোচনায় খুব একটা প্রবৃত্ত হয়েছেন বলে মনে হয় না। সাহাবিদের কিছু কিছু বর্ণনা কাহিনী আকারে হাদিস গ্রন্থগুলোতে দেখা যায়। এ বিষয়ে তাত্ত্বিক মতামত, গবেষণা, পর্যালোচনা নেই বললেই চলে। কোনো কোনো লেখক সাহাবিদের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, ‘যেহেতু এটি আমলি বিষয় নয় সেহেতু এ বিষয়ে চিন্তা করা বা এর কোনো মর্ম বা তাত্ত্বিক আলোচনার দরকার নেই। ’ অথচ মিরাজ ঘটনাটি ইসলামকে মহিমান্বিত করেছে, প্রিয় নবীকে (সা.) শ্রেষ্ঠত্বের আসনে অসীন করেছে, ইসলামের আধ্যাত্মিক দিক উন্মোচন করেছে, সর্বোপরি মহিমান্বিত আল্লাহর সাথে তাঁর প্রিয় হাবিব (সা.)-এর মহা মিলন ঘটিয়েছে, যা অন্য কোনো নবীর বেলায় ঘটেনি। এমনি এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের মর্ম, গুরুত্ব, দর্শন ও তাত্ত্বিক আলোচনা, গবেষণা এড়িয়ে যাওয়া ইসলামের আধ্যাত্মিক জ্ঞানের দৈন্য ও বিমুখতা ছাড়া অন্য কিছু নয়। মানব-ইতিহাসে মানব জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সফলতা হচ্ছে ওই মিরাজুন্নবী (সা.) । মূলত মানবাত্মা এবং পরমাত্মার মহা মিলন সংক্রান্ত ঘটনাবলিই হচ্ছে মিরাজ। মিরাজ সম্পর্কে কোরানের আয়াতগুলো নিম্নরূপ :

পরম পবিত্র ও মহিমাময় তিনি, যিনি তাঁর বান্দাকে রজনীযোগে ভ্রমণ করিয়েছেন মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসায়। যার পরিবেশ আমরা করেছিলাম বরকতময়, তাঁকে আমাদের নিদর্শনসমূহ দেখাবার জন্য, নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা [১৭:১] ।

অন্তগামী নক্ষত্রের শপথ, তোমাদের সাথী বিভ্রান্ত নন, পথভ্রষ্টও নন এবং  তিনি স্বীয় প্রবৃত্তি থেকে কোনো কথা বলেন না । এটা তো ওহি যা তাঁর প্রতি প্রত্যাদেশ হয়েছে। মহাশক্তিধর তাঁকে শিক্ষা দিয়েছেন। চিরপ্রকাশমান শক্তিধর, কাজেই তিনি পূর্ণতা লাভ করলেন। যখন তিনি সর্বোচ্চ দিগন্তে ছিলেন এবং এরপর নিকটবর্তী হলেন এবং অতি নিকটবর্তী । ফলে তাঁদের মধ্যে দুই ধনুকের ব্যবধান রইল, অথবা তার চেয়েও কম। তিনি তাঁর বান্দার প্রতি যা ওহি করার করলেন। তিনি যা দেখলেন তাঁর অন্তকরণ তা অস্বীকার করেনি। তিনি যা দেখেছেন সে সম্পর্কে কি তোমরা তাঁর সঙ্গে বিতর্ক করবে? নিশ্চয়ই তিনি তাঁকে আর একবার দেখেছিলেন প্রান্তবর্তী বদরি বৃক্ষের কাছে, যার নিকটেই জান্নাতুল মাওয়া। যখন বৃক্ষটি আচ্ছাদিত হলো, যদ্ধারা আচ্ছাদিত হবার কথা। তখন তাঁর দৃষ্টি বিভ্রান্ত হয়নি। নিশ্চয়ই তিনি তাঁর প্রভুর শ্রেষ্ঠ নিদর্শনসমূহ দেখেছিলেন। [৫৩:১-১৮]

‘মিরাজ’ শব্দটি পবিত্র কোরানে নেই। এফ স্টেইন গাসের আরবি-ইংরেজি অভিধানে মিরাজ শব্দের অর্থ লেখা হয়েছে  Stairs, Ladder, Ascension অর্থাৎ সিঁড়ি, মই বা উন্নতি লাভের সিঁড়ি বা আরোহণ। মিরাজ বলতে যা বোঝানো হয়েছে তাতে তা উন্নতি লাভের সোপান হিসেবেই বেশি প্রযোজ্য। তবে অধিকাংশ তফসিরকারক ‘মিরাজ’ অর্থ ঊর্ধ্বগমন বা ঊর্ধ্ব-আরোহণ বুঝিয়েছেন । মহিমান্বিত আল্লাহ ঊর্ধ্বলোকে তথা সপ্তাকাশের ওপরে কোনো একটি নির্দিষ্ট স্থানে বসবাস করেন, এমন ধারণার বশবর্তী হয়ে ঊর্ধ্বারোহণ বা ঊর্ধ্বগমন বুঝিয়েছেন বলে মনে হয়। অথচ আল্লাহ পাক মানুষের নফসের সাথে মিশে আছেন, আল্লাহ মানুষের শাহ-রগের চেয়েও নিকটবর্তী, আসমান ও জমিনব্যাপী আল্লাহর সিংহাসন, যেদিকেই মুখ ফেরানো হোক না কেন সেই দিকেই আল্লাহর দর্শন করা যায় ইত্যাদি আরো অনেক আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহপাক স্পষ্টভাবে তাঁর অবস্থান সম্পর্কে আমাদের বার বার জানান দেওয়ার পরও আমরা আল্লাহকে ঊর্ধ্বাকাশের কোনো একটি স্থানে অবস্থান করছেন বলে কল্পনা করতে খুবই ভালোবাসি। আল্লাহ কোথায় অবস্থান করেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে হজরত আলী (রা.) বলেন ,‘যদি কেউ বলে তিনি (আল্লাহ) কি, তাহলে সে জেনে রাখুক, তিনি সবকিছুকে ধারণ করে আছেন। যদি কেউ বলে তিনি কিসের ওপর আছেন, সে জেনে নিক, তিনি নির্দিষ্ট কোনো কিছুর ওপর নেই । যদি কেউ তাঁর অবস্থান নির্দিষ্ট কোনো স্থানে মনে করে তাহলে সে কিছু স্থানকে আল্লাহবিহীন মনে করল...। ’[ নাহজ আল বালাঘা]

উপরোক্ত যুক্তির ভিত্তিতে ‘মিরাজ’ অর্থ উন্নতির সোপান বলেই অধিক যুক্তিগ্রাহ্য বলে মনে হয়। সুরা বনি ইস্রাইলের প্রথম আয়াতে বলা হয়েছে , ‘ আল্লাহ তাঁর প্রিয় রসুলকে (সা.) মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসায় রজনীতে ভ্রমণ করিয়েছেন’। মসজিদুল হারাম বলতে পবিত্র কাবা শরিফকেই যে বুঝানো হয়েছে এতে কারো দ্বিমত নেই । পবিত্র কাবাঘরকে পবিত্র কোরানে মসজিদুল হারাম বলে একাধিকবার (২:১৪৪,২:১৪৯,২:১৫০,৯:১৯,৯:২৮,২২:২৫,৪৮:২৫) উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু বায়তুল মুকাদ্দেসকে মসজিদুল আকসা বলে পবিত্র কোরানে কোথাও উল্লেখ করা হয়নি। হজরত সোলায়মান (আ.) কর্তৃক নির্মিত মসজিদটি বায়তুল মুকাদ্দেস হিসেবে ইসলাম-পূর্ববর্তী সময় পর্যন্ত পরিচিত ছিল। এখন এটি বায়তুল মুকাদ্দেস ও মসজিদুল আকসা উভয় নামেই পরিচিত। মসজিদুল আকসা অর্থ দূরবর্তী মসজিদ। অথচ পবিত্র মক্কা নগরী থেকে বায়তুল মুকাদ্দেস খুব একটা দূরে নয়। সুতরাং মসজিদুল আকসা বলতে তফসিরকারকরা যে বায়তুল মুকাদ্দেসকে বুঝিয়েছেন, তা মানতে মন সায় দেয় না । তাছাড়া পবিত্র কোরানের আয়াতদৃষ্টে মনে হয় নবী করিমকে (সা.) উন্নত থেকে উন্নততর স্থানে বা অবস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সুতরাং হজরত আদম (আ.) এবং পরবর্তীকালে হজরত ইব্রাহিম (আ.) ও হজরত ইসমাইল (আ.) কর্তৃক আল্লাহর নির্দেশে নির্মিত পৃথিবীর আদি মসজিদ মসজিদুল হারাম (যা প্রিয় নবী সা. এবং তাঁর উম্মতের কাবা) থেকে হজরত সোলায়মান (আ.) কর্তৃক নির্মিত বায়তুল মুকাদ্দেস কীভাবে উন্নততর হলো তা মোটেই বোধগম্য হয় না। পবিত্র কোরানে মসজিদুল আকসা বলতে বায়তুল মামুরকেই বুঝানো হয়েছে বলে মনে হয়। কবি গোলাম মোস্তফা তাঁর বিখ্যাত ‘বিশ্বনবী’ গ্রন্থেন ১৫৬ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন , ‘দূরতম মসজিদ’ বলতে বায়তুল মামুরকে গ্রহণ করলে মিরাজের দার্শনিক তাৎপর্য বুঝতে সহজ হয়। মক্কার কাবা হচ্ছে বস্তুজগতের কাবা আর বায়তুল মামুর হচ্ছে আধ্যাত্মিক বা ধ্যানজগতের কাবা। কাজেই কাবা থেকে বায়তুল মামুরে নেওয়া হয়েছে এ কথার দ্বারা বোঝা যায় যে , ‘বস্তুজগৎ থেকে রাসুলুল্লাহকে (সা.) উচ্চতর আধ্যাত্মিক বা ধ্যানজগতে নেওয়া হয়েছিল’ । সুরা নজমের ৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘মহাশক্তিধর’  তাঁকে শিক্ষা দিয়েছেন। এখানে মহাশক্তিধর বলতে তফসিরকারকরা জিব্রাইলকে বুঝিয়েছেন। ‘মহাশক্তিধর’ শব্দটির জন্য পবিত্র কোরানে যে শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে তা হলো ‘শাদিদুল কুওয়া’।   পবিত্র কোরানে এ শব্দ আরো অনেক জায়গায় আল্লাহর গুণবাচক নাম হিসেবে একমাত্র আল্লাহরই জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন- শাদিদুল ইকবা,  কুওয়াতিল মাতিন। এসব জায়গায় তফসিরকারকরা এ শব্দগুলোকে আল্লাহর নামবাচক হিসেবেই লিখেছেন। সুরা নজমে এসে যখন রাসুলুল্লাহকে (সা.) শিক্ষা দেওয়ার প্রশ্ন এলো, তখনি তা আল্লাহর পরিবর্তে জিব্রাইল হয়ে গেল। এটাই হয়তো তাদের ধারণা হবে যে, আল্লাহ কেন মুহাম্মদকে (সা.) শিক্ষা দিতে যাবেন? আরো অধস্থন  কারো কাছ থেকে শিক্ষার ব্যবস্থা করাই বুঝি ভালো হয়! অথচ তারা ভুলে গেছেন যে, আল্লাহপাক নিজেই মানুষের মহান শিক্ষক। আসমাসমূহ (নামসমূহ) স্বয়ং আল্লাহপাকই হজরত আদমকে (আ.) শিক্ষা দিয়েছিলেন, আর আদমই (আ.) তা ফেরেস্তাদের শিক্ষা দিয়েছিলেন, যেখানে হজরত জিব্রাইলও (আ.) ছিলেন। সুতরাং আদমই ফেরেস্তাদের শিক্ষক। আদমের এই শ্রেষ্ঠত্বের জন্য ফেরেস্তারা আল্লাহর হুকুমে আদমকে (আ.) সিজদা করেছিলেন। এ কথা পবিত্র কোরানেরই কথা । সুতরাং পবিত্র কোরানের দলিল অনুযায়ী জিব্রাইল (আ.) কস্মিনকালেও প্রিয়নবীকে (সা.) শিক্ষাদানের যোগ্যতা ও অধিকার রাখেন না ।

মুফতি সফি তার মাআরেফুল কোরানের প্রথম খণ্ডের ১৯ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘রাসুল (সা.) উম্মি (নিরক্ষর) ছিলেন, লেখাপড়া চর্চা করতেন না, এমন অবস্থায় কোরান যদি একসাথে একেবারে তাঁর উপর নাজিল হতো, তবে তা স্মরণ রাখা বা অন্য কোনো পন্থায় তা সংরক্ষণ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হতো না। অপরপক্ষে মুসা (আ.) লেখাপড়া জানতেন, সেজন্য তাঁর প্রতি তাওরাত একসাথে নাজিল হয়েছিল। কারণ তিনি তা লিপিবদ্ধ আকারে সংরক্ষণে সমর্থ ছিলেন। ’ হায়রে তফসির ! হায়রে মুসলমান !! তার এ রকম মন্তব্য কিছুতেই সমর্থন করা যায় না। এ ধরনের মন্তব্য হযরত মুহাম্মদকে (সা.) যোগ্যতার দিক থেকে হজরত মুসা (আ.) থেকে নিম্নতর নবী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার অপপ্রয়াস ছাড়া অন্য কিছু নয়। তাদের জানা উচিত ‘উম্মি’ শব্দের অনেক অর্থের মধ্যে একটি হচ্ছে ‘মূল’ বা উৎস। ‘নবী উল উম্মি’-- ইহ ও পারলৌকিক যাবতীয় এলমকে জমা বা একত্র করলে যে অবস্থার সৃষ্টি হয় তাকে ‘উম্মি’ বলা হয়। আর প্রিয় নবী (সা.) হচ্ছেন সমস্ত জ্ঞান-বিজ্ঞানের মূলাধার। আর তাঁকেই বলা হচ্ছে নিরক্ষর, অশিক্ষিত ইত্যাদি। এ লজ্জা রাখি কোথায়!  এসব তফসিরকারক কোনো দার্শনিক দৃষ্টিসম্পন্ন লোক নন, নিছক দু কলম আরবি জানা লোক । আহাদ থেকে আহমদের বিচ্ছুরণে নূরে মুহাম্মদীর (সা.) প্রকাশ, এ বিকাশের দার্শনিক তত্ত্ব বুঝতে না পেরে মহানবীকে (সা.) তাদের মতো মানুষ মনে করে বিভ্রান্তিকর আকিদা পোষণ করেন।

সুরা নজমের ৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘চিরপ্রকাশমান শক্তিধর কাজেই তিনি পূর্ণতা লাভ করলেন’।   তফসিরকারকরা এ আয়াতে ‘তিনি’ বলতে জিব্রাইলকে (আ.) বুঝিয়েছেন। অথচ এ সর্বনামে প্রিয় নবীকেই (সা.) বুঝানো হয়েছে। জিব্রাইল-এর (আ.) পূর্ণতা হাসিলের কিছুই নেই। ফেরেস্তাদের আল্লাহপাক যেটুকু জানান , কেবল সেটুকুই তাঁরা জানতে সক্ষম। এর বাইরে কোনো এলম বা যোগ্যতা বা পূর্ণতা হাসিলের কোনো প্রচেষ্টাই তাঁরা করতে অক্ষম। একমাত্র মানুষেই পারে সাধনাবলে যোগ্যতার শ্রেষ্ঠতম আসনে অসীন হতে। সপ্তম, অষ্টম ও নবম আয়াতে বলা হয়েছে, ‘যখন তিনি সর্বোচ্চ দিগন্তে ছিলেন এবং নিকটবর্তী হলেন, অতিনিকটবর্তী, ফলে তাঁদের মধ্যে রইল দুই ধনুকের ব্যবধান অথবা তার চেয়েও কম’। এখানেও তফসিরকারকরা ‘তিনি’ বলতে জিব্রাইলকে টেনে এনেছেন। এবং ‘তাঁদের’ বলতে জিব্রাইল ও মুহাম্মদকে (সা.) বুঝিয়েছেন। হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে, প্রিয় নবী (সা.) যেন জিব্রাইলের সাথেই মিরাজ করার জন্য ঊর্ধ্বগমন করেছিলেন। মহিমাময় আল্লাহ এখানে একেবারেই অনুপস্থিত!

কবি গোলাম মোস্তাফা তার ‘বিশ্বনবী’তে উল্লেখ করেছেন,“ ‘তিনি’ হলেন মুহাম্মদ (সা.) এবং ‘তাঁদের’ বলতে আল্লাহ ও রাসুলকেই (সা.)  বুঝানো হয়েছে। দশম আয়াতে এ কথার যথার্থতা পাওয়া যায়, কারণ এখানে আল্লাহ লেখা হয়েছে। ” ত্রয়োদশ আয়াতে বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয় তিনি তাঁকে আর একবার দেখেছিলেন’। এখানেও তফসিরকারকরা ‘তিনি’ বলতে মুহাম্মদ (সা.) এবং ‘তাদের’ বলতে জিব্রাইল ও মুহাম্মদকেই (সা.) বুঝিয়েছেন।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, তফসিরকারকরা আল্লাহর সাথে প্রিয় নবীর (সা.) সাক্ষাৎ করাতে নারাজ। তাই জিব্রাইলকে বার বার টেনে নিয়ে আসা। অথচ তারা এ কথা বেমালুম ভুলে গেছেন যে,জিব্রাইল তো শুরু থেকেই প্রিয় নবীর (সা.) সাথে আছেন। সুতরাং তাকে (জিব্রাইল) আবার নতুন করে দেখার এবং তার কাছ থেকে শিক্ষা নেওয়ারই বা কী আছে?  

মিরাজের আয়াতসমূহের সারকথা হলো, মহিমান্বিত আল্লাহর সাথে তাঁর প্রিয় হাবিব (সা.)-এর মুলাকাত বা দিদার। এ দিদার লাভ কেউ বলেন আধ্যাত্মিকভাবে আবার কেউ বলেন সশরীরে  হয়েছে। আমরা কোনোটাকেই অসম্ভব বলে মনে করি না। ইমাম গাজ্জালী (রহ.) তাঁর ‘কিমিয়ায়ে সাদাআত’-এ উল্লেখ করেন, ‘মুহাম্মদ (সা.) মিরাজে বেহেস্তের অবস্থা দর্শন করেছেন বলে যে সংবাদ প্রদান করেছেন তা কেবল জিব্রাইলের মুখে শুনে নয়, বরং তিনি তা স্বচক্ষে দেখেছেন। তিনি চাক্ষুস দৃষ্ট ঘটনা জগতে প্রকাশ করেছেন। ইহ জগৎ থেকে কেউ বেহেস্তের অবস্থা জানতে পারে না, এ কথা সত্য কিন্তু রাসুল (সা.)-এর দৃষ্টি এ জগৎ অতিক্রম করে পরলোক পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল। তাঁর এ অবস্থাকে দ্বিবিধ মিরাজের এক প্রকার মিরাজ বলা যায়। জীবাত্মার মৃত্যুতে মানবাত্মার মিরাজ হয় অথবা জীবাত্মা দুর্বল হলে মানবাত্মার মিরাজ সংঘটিত হয় ’।

ইমাম গাজ্জালী তাঁর এ গ্রন্থে আত্মদর্শন ও তত্ত্বদর্শন পর্বে মানুষের জীবাত্মা ও মানবাত্মার বিস্তারিত ব্যাখ্যাপূর্বক উভয় আত্মার কার্যাবলি সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। তিনি বলেন, মানুষ রাসুলের (সা.) কাছে আত্মা সম্পর্কে জানতে চাইলে মহিমান্বিত আল্লাহ বলেন, ‘বলে দিন ইহা আমার প্রভুর আদেশ’ (১৭:৮৫)। শরিয়তের এ গণ্ডীর কারণে রাসুলুল্লাহ (সা.) সাধারণ লোকের সম্মুখে ভাষার মাধ্যমে আত্মা ও রুহের ব্যাখ্যা দেননি। কিন্তু বিশেষ মানুষের জ্ঞানচক্ষু ফুটিয়ে দিয়ে আত্মার প্রকৃত স্বরূপ প্রত্যক্ষভাবে মানুষকে দেখিয়ে দিয়েছেন। ’ ইমাম গাজ্জালী আত্মাকে দুই ভাগে ভাগ করেছেন :  জীবাত্মা ও মানবাত্মা। তাঁর এ বিভাজন মুসলিম ও অমুসলিম সকল দার্শনিকের কাছে সমাদৃত হয়েছে। তিনি মানবাত্মা ও পরমাত্মার প্রতি অতি গুরুত্ব আরোপ করে বলেন যে, মানবাত্মা হলো বাদশা আর জীবাত্মা হলো তার উজির এবং বাহ্যিক অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো হলো লস্কর বা খেদমতগার। তাঁর মতে মানবাত্মার উৎকর্ষ সাধিত হলে মানুষের পূর্ণতা লাভ হয়।

যদি ধরা যায় যে, প্রিয় নবী (সা.) সশরীরে আল্লাহর সাথে দিদার করেছেন তাতেও আশ্চর্য হবার কিছুই নেই। প্রিয় নবী (সা.) হলেন নূরের তৈরি। তাঁর দেহ মোবারক দেখতে আমাদের মতো হলেও জড়ধর্মী ছিলো না। তাঁর দেহ মোবারকের ছায়া ছিলো না। তাঁর নূরানি পায়ের ছাপ কঠিন পাথর বুকে ধারণ করেছে (প্রমাণ কাবা শরিফে মকামে ইব্রাহিম)। তদুপরি একই উপাদানবিশিষ্ট বস্তুর মধ্যেও আকাশ-পাতাল পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। যেমন কয়লা থেকে হিরক হয়। তাই বলে কয়লা আর হিরক এক জিনিস নয়। সকল পদার্থের ধর্ম একই রকম হয় না। কাচ একটা জড়পদার্থ। জড়পদার্থের ধর্ম হচ্ছে চলাচলে বাধা সৃষ্টি করা। কিন্তু কাচ আলোকরশ্মিকে বাধা দিতে পারে না। আবার এক্স-রে  সহজেই অস্বচ্ছ পদার্থ ভেদ করতে পারে। নূরে মুহাম্মদী (সা.) হচ্ছেন সৃষ্টির আদি নূর, যাবতীয় সৃষ্টির অন্তর্নিহিত সত্তাসার। প্রিয় নবী (সা.) হচ্ছেন নূরুন আলা নূর। পবিত্র কোরানে আল্লাহপাক ঘোষণা করেন,‘নিশ্চয় তোমাদের কাছে এসেছে আল্লাহর নূর এবং সুস্পষ্ট কিতাব’ (৫:১৫)। তাছাড়া হাদিস শরিফে প্রিয় নবী (সা.) বলেছেন, ‘আনা মিন নূরিল্লাহ, অ কুল্লে শাইয়িন মিন নূরী’। অর্থাৎ আমি আল্লাহর নূর থেকে আর সমগ্র সৃষ্টি আমার নূর থেকে। সুতরাং পবিত্র কোরান ও কোরান সমর্থিত সহি হাদিসের আলোকে প্রিয় নবীর (সা.) মর্যাদা ও অবস্থান নির্ণয়সাপেক্ষে মিরাজের গূঢ়তত্ত্ব ও রহস্য উন্মোচন করার কাজে ব্রত হওয়া প্রত্যেক ইসলামি দার্শনিকের একান্ত কর্তব্য।

আধুনিক থিওসফি দেহতত্ত্বের ওপর এক আলোড়ন সৃষ্টিকারী দর্শনের দিকনির্দেশনা দিয়েছে। থিওসফির জনক Annie Besant তার Man and his bodies গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, মানুষের জড় দেহ ছাড়াও তিন প্রকারের দেহ আছে। এগুলো হচ্ছে : ১. জ্যোতি দেহ (astral body), ২. মানস দেহ (mental body) ও ৩. নিমিত্ত দেহ (casual body)। আজকাল চিকিৎসাশাস্ত্রেও mental health নামে আলাদা একটা বিভাগ চালু হয়েছে। এ জড়দেহগুলোকে ইথারিক দেহও বলা হয়। জড়দেহ গঠিত হয় জড় উপাদান দিয়ে (যেমন- মাটি, বাতাস, আগুন, পানি)। আর ইথারিক দেহ গঠিত হয় ইথার বা জ্যোতি দিয়ে। আমাদের স্থূল দেহের সাথে ইথারিক দেহ মিশে আছে। দেহের আসল সত্তা হলো আত্মা বা রুহ। দেহ তার ঘর বা পোশাক। আত্মা প্রয়োজনবোধে ইথারিক দেহ ধারণ করে বস্তু বা আধ্যাত্মিক জগতে ঘুরে বেড়াতে পারে। এজন্য প্রয়োজন দেহের জৈবিক উপাদানগুলোকে দুর্বল করে ইথারিক উপাদানগুলোকে তেজস্বী করে তোলা।

জ্যোতিদেহ সম্বন্ধে Besant বলেন, জ্যোতিদেহ নিয়ে আধ্যাত্মিক জগতে কার্যক্ষম কোনো ব্যক্তি যদি পাওয়া যায় তবে দেখা যাবে, তাঁর স্থূল দেহ যখন ঘুমায় বা অচেতন হয় তখন তিনি যদি তাঁর জ্যোতিদেহ নিয়ে বেড়িয়ে পড়েন আসল মানুষটাই স্বজ্ঞানে আমাদের সম্মুখে প্রতিভাত হয়। জ্যোতিদেহ সে মানুষটির প্রতিকৃতি নিয়ে পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠে। মানুষ তখন সে দেহকে বাহন হিসেবে ব্যবহার করে। এ বাহন স্থূল দেহের বাহন অপেক্ষা অনেক বেশি শক্তিশালী ও সুবিধাজনক। এ অবস্থায় বিচ্ছিন্ন স্থূল দেহেরও কোনো অসুবিধা হয় না। জ্যোতিদেহের সাথে তার যোগাযোগ অক্ষুন্ন থাকে। এভাবে জ্যোতিদেহ নিয়ে মানুষ যে কোনো দূরবর্তী স্থানে, যে কারো সম্মুখে ভ্রমণ বা উপস্থিত হতে পারে। যার সম্মুখে প্রতিভাত হলো তার জ্যোতিদৃষ্টি যদি প্রখর হয়ে থাকে তবে তিনি তা অনায়াসে দেখতে পান। মানস দেহ জ্যোতিদেহ অপেক্ষা শক্তিশালী। মানসদেহ ধারণক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তি তাঁর মানসমূর্তিকে নিজের আকৃতিবিশিষ্ট করে নেয় এবং এ দেহ নিয়ে তিনি ত্রিভুবনে যদৃচ্ছভাবে বিহার করতে পারেন এবং সাধারণ সীমারেখার ঊর্ধ্বে চলে যান। এ উপায়ে তিনি জড়, কাল ও স্থানকে জয় করেন এবং তাঁর কাছে তখন পদার্থ, স্থান বা কালের কোনো বাধাবন্ধন থাকে না। [ সূত্র :- কবি গোলাম মোস্তাফা/ বিশ্বনবী/পৃষ্ঠা ৪৬৬-৪৬৯]। অলি-আউলিয়াদের অলৌকিক কর্মকাণ্ড বা কেরামত এ জ্যোতিদেহ ও মানসদেহরই ক্রিয়া। থিওসফির উপরোক্ত আলোচনাগুলো আধুনিক বিজ্ঞানেরই কথা। এখানে আমার ব্যক্তিগত জীবন থেকে একটি ঘটনা তুলে ধরা প্রাসঙ্গিকক্রমে প্রয়োজন মনে করছি। আমি তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। আমার বড় মামা একজন বড় আলেম ছিলেন। তিনি ইন্তেকাল করলে তাঁর জানাজায় যাওয়ার জন্য আমার হুজুর হজরত ফজলুল করিম (রা.)-এর অনুমতির জন্য তাঁর অবস্থানস্থলে যাই। সেখানে তিনি কয়েকজন ভক্ত পরিবেষ্টিত ছিলেন। আমি তাঁর অনুমতি চাইলে তিনি আমাকে অনুমতি প্রদান করে বললেন, ‘তুমি যাও, আমিও যাব। যদি সেখানে তুমি আমার দেখা পাও তাহলে আমার সাথে কথা বলার চেষ্টা করো না। ’ এ বলে তিনি আমাকে বিদায় দিলেন। আমি মামার জানাজা সম্পন্ন করে হঠাৎ দেখলাম কিছু দূরে একটি বটগাছের নিচে আমার হুজুর দাঁড়িয়ে আছেন। আমি তাঁর নির্দেশ ভুলে গিয়েছিলাম। আমি দৌড়ে হুজুরের কাছে আসতেই তিনি গাছের আড়াল এবং অদৃশ্য হয়ে গেলেন। পরে তাঁর সাথে অবস্থানরত ভক্তবৃন্দের কাছে জানতে পারলাম যে, তিনি ওই দিন অবস্থানস্থল থেকে কোথাও বের হননি।

মিরাজের সার্থকতা হচ্ছে স্থান, কাল ও গতির ওপর মানুষের যে অপরিসীম শক্তি ও অধিকার আছে, জড়শক্তিকে সে যে অনায়াসেই আয়ত্ত করতে পারে, এ মানুষেরই মধ্যে যে বিরাট এক অতি মানুষ ঘুমিয়ে আছে-- এ কথা প্রমাণ করা। প্রিয় নবী (সা.) যেমন আধ্যাত্মিক জগতে সর্বশ্রেষ্ঠ পূর্ণ মানব , তেমনিই মানবজাতির ইতিহাসেও তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ ইনসানে কামেল ও সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শ  হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। কীভাবে আত্মসাধনার দ্বারা মানুষ ইহ ও পরকালে শ্বাশত মহাকল্যাণের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হতে পারে, মানবজাতিকে তিনি তা হাতে কলমে শিক্ষা দিয়ে গেছেন। মিরাজের মাধ্যমে প্রিয় নবীর (সা.) ‘আহমদ ও মুহাম্মদের’ নামের যথার্থতা প্রমাণিত হয়েছে। তিনি একাধারে চরম প্রশংসাকারী ও চরম প্রশংসিত। মিরাজের ঘটনার মাধ্যমে তিনি মহিমান্বিত আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ লাভে ধন্য হয়ে চরম প্রশংসাকারী ও সৃষ্টিজগতের কাছে চরম প্রশংসিত সত্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। কোনো ফেরেস্তা ও কোনো পয়গম্বর যেখানে পৌঁছতে পারেননি, প্রিয় নবী (সা.) মিরাজের মাধ্যমে সেখানে পৌঁছেছেন এবং আল্লাহর দিদার ও সাক্ষাৎ লাভে সমগ্র মানবজাতিকে সুমহান মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছেন।

লেখক প্রাবন্ধিক ও গবেষক                                                                                    

বাংলাদেশ সময় ১৭৫৫ ঘণ্টা, জুন ২৯, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।