ঢাকা: কর্মজীবনে সিএম কয়েস সামি এর আগে এবি ব্যাংক, ডাচ-বাংলা ব্যাংক ও ওরিয়েন্টাল ব্যাংকে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন। সম্প্রতি তিনি প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের একই দায়িত্ব পেয়েছেন।
বিশিষ্ট ব্যাংকার সিএম কয়েস সামির মতে, অর্থনীতির উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে ভাগ করে দুটি পৃথক প্রতিষ্ঠান করা উচিত উচিত। দেশের অর্থনীতিতে সচল রাখতে হলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা দরকার। আমি বিশ্বাস করি, এদেশের রাজনীতিবিদরা নিজের জীবন, দলীয় আর্দশের চেয়ে দেশকে বেশি ভালোবাসেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভাজনের ব্যাপারে সিএম কয়েস সামি ব্যাখ্যা করে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের কাজ দুই ভাগে ভাগ করতে হবে। এ জন্য এ কেন্দ্রীয় ব্যাংককে দুটি প্রতিষ্ঠানে ভাগ করে দুইজন নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ করতে হবে। একটি প্রতিষ্ঠান হবে, ফাইনানসিয়াল সার্ভিসেস অথরিটি (যুক্তরাজ্যের ব্যাংকিং নীতিমালার অনুকরণে, যার মূল লক্ষ্য হবে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর নিয়ন্ত্রণ ও সম্প্রসারণে সহযোগিতা করা) গঠন করা। আরেকটির নাম বাংলাদেশ ব্যাংকই থাকবে, তবে এর কাজ হবে মুদ্রানীতি প্রণয়ন (মনিটারি পলিসি এবং সার্কুলেশন অব ব্যাংক নোটস অ্যান্ড কারেন্সি)। এই পদ্ধতি অনুসরণ করলে প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়ক ভুমিকা রাখবে বলে তিনি বিশ্বাস করেন।
তিনি বলেন, এখনও পর্যন্ত দেশের মাত্র ১৫ শতাংশ লোক ব্যাংকিং সুবিধা নিচ্ছে। তবে বাংলাদেশে প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। সমবায় ব্যাংকগুলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আওতায় নিয়ে আসা উচিত। এটা করলে দেশের মানুষ উপকৃত হবে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও ব্যাংকিং খাত অনেক ভুমিকা রাখতে পারবে। এছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জনকল্যাণমূলক কাজের ওপর আরও জোর দিতে হবে। নতুন নতুন উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি প্রবাসীদের অর্থ দেশে আনতে আরও সহজ পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য নতুন পথ খুঁজতে হবে।
দেশের আর্থিক উন্নয়নে ব্যাংকিং খাতের ভূমিকা তুলে ধরে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ‘দেশে অনেকেই মনে করে আর্থিক খাতের উন্নয়নে নতুন কোনো ব্যাংকের প্রয়োজন নেই। কিন্তু আমি এর বিরোধী। নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দিলে পুরনোদের সমস্যা হয়, এ বিষয়টি আমাদের বিবেচনা করে দেখতে হবে। ’
তিনি আরও বলেন, বাস্তব কথা হচ্ছে নতুন ব্যাংক আসলে প্রতিযোগিতা বেড়ে যাবে। একই সঙ্গে নতুন ব্যাংকের কারণে ঢাকা ও এর বাইরের মানুষ আরও বেশি সুবিধা পাবে। সুদের হারও কমে যাবে।
প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের মাধ্যমে দেশের উন্নয়নের কথা তুলে ধরে বিশিষ্ট এই ব্যাংকার বলেন, গ্রামীণ মানুষের কল্যাণ ও উন্নয়নে প্রাবসীদের আর্থিক সুবিধা দিয়ে থাকে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক। এ জন্যই বিদেশ থেকে দেশে ফিরে ব্যবসা বাণিজ্য অথবা খামার করা ও মৎস্য চাষসহ যে কোনো কাজের জন্য প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক ঋণ দিয়ে থকে। আমাদের কাজই হচ্ছে প্রবাসীদের আত্মনির্ভরশীল করে তোলা।
বর্তমান দেশের আর্থিক খাতের পরিস্থিতি তুলে ধরে সি এম কয়েস সামি বলেন, আগামী দুই বছর যদি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকে তাহলে দেশের অর্থনীতি আরও চাঙ্গা হবে। সামনের দিকে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ। আর যদি রাজনৈতিক পরিস্থিতি সংঘাতময় হয়, তাহলে অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তবে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে বিদেশি রেমিটেন্সের ওপর প্রভাব পড়বে বলে আমি মনে করি না।
কৃষি খাতের উন্নয়নের বিষয়গুলো তুলে ধরে তিনি বলেন, প্রবাসীদের কৃষি ঋণ দেওয়া হচ্ছে। দেশের কোনো এলাকায় একাধিক প্রবাসী সংঘবদ্ধ হয়ে কোনো কৃষি খামার বা অন্য কোনো উন্নয়নমূলক কাজ করলে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক তাদের প্রয়োজনীয় সহায়তা দেবে। কারণ আমরা গ্রামীণ উন্নয়নের জন্য যে কোনো প্রকল্পকেই বেশ গুরুত্ব দিয়ে থাকি।
এসএমইর উন্নয়নের কথা উল্লেখ করে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, আমরা কোনো বড় লোন দিচ্ছি না। ছোট ছোট ঋণ দিচ্ছি। চেষ্টা করছি, প্রবাসীরা ভাল কিছু করুক। তারা যদি উন্নয়নমূলক কিছু করতে পারে তাহলেই সেখানে আমাদের সার্থকতা।
শেয়ারবাজার কেলঙ্কারির কারণ ও এর ভবিষ্যৎ তুলে ধরে কয়েস সামি বলেন, এ বিষয়টি যারা দেখছেন তাদের অজ্ঞতার কারণেই এ সমস্যার সৃষ্ট হয়েছে। তবে পুঁজিবাজারের বিদ্যমান সমস্যা কেটে যাবে।
দেশের আর্থিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে নতুন ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স দেয়ার প্রসঙ্গে সি এম কয়েস সামি বলেন, বর্তমানে নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়া উচিত। তবে ঐ সব প্রতিষ্ঠানের উদ্যেক্তা নির্বাচনের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তপক্ষকে বিবেচনা করতে হবে। সম্ভব হলে নতুন ব্যাংকগুলোর প্রধান কার্যালয় বিভাগীয় শহরে করা উচিত।
প্রবাসীদের সামগ্রিক সুবিধার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, দক্ষ-অদক্ষ মিলিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ৭০ লাখ বাংলাদেশি বিদেশে রয়েছে। এদের কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা আমাদের মোট জাতীয় উৎপাদনের ১৫ ভাগেরও বেশি। যা পোশাক শিল্পের প্রায় দিগুণ, বৈদেশিক বিনিযোগের প্রায় ১৫ গুণ, শিল্প উন্নয়নের চেয়ে প্রায় দশ গুণ।
প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের কার্যক্রম সর্ম্পকে তিনি বলেন, বিদেশে জনশক্তি রপ্তানিতে সহায়তা ও অভিবাসী বাংলাদেশিদের ব্যাংকিং সেবা প্রদান, বিদেশ গমনেচ্ছুদের জামানতবিহীন অভিবাসন ঋণ সহায়তা দেওয়া হয়। ঋণ বিতরণের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, কৃষি ঋণ, মাঝারি ধরনের কৃষি নির্ভর শিল্প ঋণ, মুরগির খামার প্রকল্প ঋণ, মৎস্য চাষ, বায়োগ্যাস প্লান্ট প্রকল্প, তথ্য প্রযুক্তি নির্ভর উদ্যোক্তা ঋণ, ‘এক বাড়ি এক খামার’ প্রকল্প, নারী উদ্যোক্তাদের জন্য ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প প্রকল্প, গরু মোটা-তাজাকরণ প্রকল্প ও দুগ্ধ উৎপাদনকারী খামার প্রকল্পে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক ঋণ দিচ্ছে।
ঋণের ওপর সুদের হারের কথা তিনি বলেন, বিদেশে যাওয়ার জন্য সুদ নেওয়া হয় ৯% ও পুর্নবাসন ঋণের জন্য নেয়া হয় ১২% সুদ।
ব্যাংকের শাখা খোলার বিষয় কয়েস সামি বলেন, আমাদের ব্যাংকের বয়স মাত্র সাড়ে তিন মাস। আমরা দ্রুত গতিতেই কাজ করছি। আমাদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য আগামী ছয় মাসের মধ্যে বিভাগীয় শহরে শাখা খোলার পরিকল্পনা নিয়েছি।
প্রবাসীদের পরিবারের কল্যাণের কথা তুলে ধরে সি এম কয়েস সামি বলেন, আমরা প্রবাসীদের পরিবারের সামগ্রিক কল্যাণের জন্য সহযোগিতা করার চিন্তা ভাবনা করছি। এ ব্যাপারে আগামী ২/৩ মাসের মধ্যে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছাবো।
তিনি বলেন, আমাদের চিন্তা হচ্ছে গ্রামকে উন্নয়ন করা। পল্লী অঞ্চলকে উন্নত করতে পারলে দেশের অর্থনীতিতে এর প্রভাব পড়বে। ফলে দেশ এক সময় উন্নয়নশীল দেশের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারবে।
সহজে দেশে প্রবাসীদের টাকা পাঠানোর ব্যাপারে ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, প্রবাসীরা যাতে সহজ উপায়ে কম খরচে দেশে টাকা পাঠাতে পারে সেজন্য প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক সৌদি আরব, দুবাই, কুয়েত, সিঙ্গাপুর, মালেয়শিয়া এবং ওমানে খুব শিগগিরই এক্সচেঞ্জ হাউজ খোলা হবে। কারণ প্রতি বছর বিদেশ থেকে প্রবাসীরা ৭৭ হাজার কোটি টাকা পাঠান। গত ৬ মাসে বাংলাদেশে এসেছে ৩৮ হাজার কোটি টাকা। এ টাকার পরিমাণ আরও বাড়াতে পারলে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক ব্যাপক উদ্যোগ নেবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৮০৯ ঘণ্টা, আগস্ট ১০, ২০১১