ঢাকা, বুধবার, ২৯ মাঘ ১৪৩১, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২ শাবান ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

দিন-দুপুরে মানুষ জবাই: বুড়িগঙ্গা পাড়ের আতঙ্ক ‘রতনের খামার’

আহ্সান কবীর, কান্ট্রি এডিটর ও <br>শেখ সালাহ্উদ্দিন বাচ্চু, ঢাকা দক্ষিণ প্রতিনিধি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮২৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৪, ২০১১
দিন-দুপুরে মানুষ জবাই: বুড়িগঙ্গা পাড়ের আতঙ্ক ‘রতনের খামার’

ঢাকা: সন্ধ্যা হয়ে গেছে। তবুও ছেলে ঘরে ফেরেনি।

একপর্যায়ে রাত বারটা বেজে গেল। সেলফোনে সম্ভাব্য সব জায়গায় খোঁজ নেওয়া হয়ে গেছে। নেই, কোনও খোঁজ নেই।

এরপর প্রতিটি মুহূর্ত যেন বছরের দৈর্ঘ্য নিয়ে পার হতে থাকে। রাতজাগা শেয়ালের প্রহর ঘোষণার ভয়ার্ত ডাকের সমান্তরালে সন্তানের অশুভ পরিণতির আশংকায় গুমড়ে গুমড়ে বিলাপ করছেন মা। করুণ সেই বিলাপের আবেশে পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে। একসময় মুয়াজ্জিনের আজানের সুরে ভর করে ভোর হয়। মায়ের সঙ্গে সারারাত না ঘুমানো বাবা সকালে আবার প্রস্তুতি নিতে থাকেন ছেলেকে খুঁজতে বেরোবার।

এসময় পাশের বাড়ির কিশোর ছেলেটির মারফতে জানা যায়- রতনের খামারে গলাকাটা লাশ পড়ে আছে।  

দিশেহারা বাবা সৃষ্টিকর্তার দরবারে হাত উঠিয়ে কায়মনোবাক্যে বিড় বিড় করেন- ওই লাশটি যেন তার সন্তানের না হয়।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়- আশপাশের কোনও গ্রামের কিশোর-তরুণের লাশ পাওয়া যায় রতনের খামারে। কখনো দেখা যায়, লাশটি অজ্ঞাত পরিচয় কারো। অর্থাৎ অন্য কোনও এলাকা থেকে নিয়ে এসে হত্যা করে ফেলে রাখা হয়েছে। নিহতদের মধ্যে নারী-পুরুষ উভয়ই থাকে।

একেবারে রাজধানী ঢাকার কাছেই, কেরানীগঞ্জ উপজেলার মডেল থানার কালিন্দি ইউনিয়নের দিঘীরপাড় গ্রামের রতনের মৎস্য খামার নামের ওই এলাকায় এ ধরনের ঘটনা হরহামেশাই ঘটে চলেছে। শুধু একটি পরিসংখ্যানেই রতনের খামারের ভয়াবহতা পরিষ্কার হয়ে ওঠে- চলতি বছরের জানুয়ারির প্রথম থেকে ১১ অক্টোবর পর্যন্ত পাওয়া হিসাবে এখানে ১৮ টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এ তথ্য পুলিশ সূত্রে পাওয়া। স্থানীয়দের মতে, এটা প্রকৃত সংখ্যা নয়।

কেউ কিছু জানে না!
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, ঢাকার কেরানীগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা ও মডেল থানার পাশের দীঘিড়পাড় গ্রামের রতনের খামার নামে পরিচিত বিশাল দীঘি ও আশাপাশের এলাকায় দিন-দুপুরেও মানুষ পা ফেলতে ভয় পান। আশপাশের অধিকাংশ বাসিন্দা সংখ্যালঘু নিম্নবিত্ত হিন্দু। আর তাই অনেক ঘটনাই জানার পরেও নিজেরাও একই ঘটনার শিকার হওয়া থেকে বাঁচতে মুখে তালা দিয়ে থাকেন তারা।

বিরাজমান এমনই এক আতংকজনক আবহের সুযোগে স্থানীয় গডফাদার আর পেশাদার সন্ত্রাসীরা নির্বিঘ্নে মানুষ হত্যা করার এবং লাশ ফেলে রাখার নিরাপদ স্পট হিসেবে বেছে নিয়েছে রতনের খামারকে। এখানে লাশ ফেলে রাখার সুবিধা অনেক। কারণ, আশপাশে লোকালয় থাকলেও রতনের খামার এলাকাটি কিছুটা দুর্গম। পুলিশ সাধারণত এলাকায় আসে না। লাশ পড়ে আছে জানিয়ে কেউ সাহস করে খবর দিলেও থানা নানান অজুহাতে এড়িয়ে যায়। প্রায়ই বলা হয়, এলাকাটি এ থানার আওতায় নয়।

স্থানীয়দের মতে- রতনের খামারের ভূত যে কোন সরিষায় আছে তা নিয়ে ব্যাপক অনুসন্ধান প্রয়োজন। সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে প্রশ্ন করলেই কেরানীগঞ্জ মডেল থানা আর দক্ষিণ কেরাণীগঞ্জ থানার কর্মকর্তারা প্রায়ই অবাক হয়ে পাল্টা প্রশ্ন করেন- এটা আবার কি?

গত ৩ অক্টোবর মডেল থানা এলাকার বন্ধ ডাকপাড়ার (কদমতলীর পাশে) এক লন্ড্রি ব্যবসায়ী মাসুম (২৬) নিখোঁজ হন। এখনও তার খোঁজ পাওয়া যায়নি। জানা গেছে, মাসুম স্থানীয় মাদকসন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায় তাকে অপহরণ করা হয়েছে। আশংকা করা হচ্ছে, তাকে হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনায় মাসুমের বাবা নূরু মিয়া মডেল থানায় একটি জিডি দায়ের করেছেন।

যোগাযোগ করা হলে কেরানীগঞ্জ মডেল থানার সেকেন্ড অফিসার সাজ্জাদ রোমান বাংলানিউজকে জানান, এরকম কোনও তথ্য তার জানা নেই। জিডির বিষয়টিও তিনি জানেন না বলে জানান।

তবে পরিচয় গোপনের শর্তে থানার একটি সূত্র জানায়- হ্যাঁ, ৩ তারিখের ঘটনায় সত্যি জিডি হয়েছে।

কিন্তু সেকেন্ড অফসার তাহলে কেন এমন বললেন? ওসি মাঈন উদ্দিন খানের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি জানালেন, তিনি নতুন এসেছেন। পরে জানাতে পারবেন।

সাধারণত রতনের খামার নিয়ে যখনই পুলিশে যোগাযোগ করা হয়, এ ধরনের উত্তরই দেওয়া হয়।

বর্তমান কর্মকর্তারা কেউ কথা না বলতে চাওয়ায় শেষ পর্যন্ত কেরানীগঞ্জ থানায় সাম্প্রতিক ৩ বছর দায়িত্ব পালন করে গেছেন এমন একজন পুলিশ কর্মকর্তা (বর্তমানে সাভারে কর্মরত) আসাদুজ্জামানের সঙ্গে সেলফোনে যোগাযোগ করা হয় এই আশায় যে তিনি হয়তো কিছু জানাতে পারবেন। কিন্তু তিনিও অবাক কণ্ঠে বললেন, `রতনের খামার! ভাই এই নাম তো এই প্রথম শুনলাম আপনার কাছে। `

জায়গাটা কেরানীগঞ্জ মডেল থানায় কালিন্দি ইউনিয়নে... নিয়মিত লাশ পড়ে ওখানে। এ বছরের শুরু থেকে চলতি মাসের ১১ তারিখ পর্যন্ত পুলিশের হিসেবেই সেখানে ১৮টি লাশ পাওয়া গেছে।

: ওখানে রতন বলে আমি একজনকে চিনতাম। কিন্তু...

না আসাদ ভাই। এই রতন তো খুন হয়েছে ১৯৯৬ সালে।

: ও তাহলে এটা অন্য ঘটনা। আমি এ ব্যাপারে কিছু জানি না ভাই। আমি তো সেখান থেকে চলে এসেছি।

তাহলে এ ব্যাপারে কে বলতে পারে? কারণ বিষয়টা খুবই উদ্বেগের। আমরা এ নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করছি। রতনের খামার পুলিশ, প্রশাসন, এলাকা, মিডিয়া, সরকার সবার বদনাম ছড়াচ্ছে। একের পর এক মানুষের লাশ পাওয়া যাচ্ছে সেখানে।

এ পর্যায়ে আসাদুজ্জামান কেরানীগঞ্জ ডিবি’র পরিদর্শক আবুল বাশারের নাম্বার দেন। আবুল বাশারের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি জানালেন, তিনি নতুন এসেছেন। রতনের খামার শুনে তিনিও অবাক হলেন। এ বিষয়ে কিছু জানেন না জানিয়ে  বললেন, ‘এ ব্যাপারে মডেল থানার ওসির সঙ্গে যোগাযোগ করুন। তিনি বিষয়টি ভালো বলতে পারবেন। ওটা তার এলাকা। ’

কিন্তু এর আগেই সেই ওসি মাঈন উদ্দিন খানের সঙ্গে কথা হয়েছে আমাদের এবং তিনি জানিয়েছেন- তিনিও নতুন এসেছেন। সুতরাং...

আমরা কথা বলেছিলাম কেরানীগঞ্জ এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত এএসপি জাকারিয়ার সঙ্গে। তিনিও কিছু জানেন না বলেই বাংলানিউজকে জানান। রতনের খামার নিয়ে তার কিছু জানা নেই।  

এটাও সত্য, লোকবল আর যানবাহন সংকট পুলিশকে ওখানে যাওয়ার ক্ষেত্রে অনেক সময়েই নিরুৎসাহিত করে। তবে স্থানীয়রা বলেন, সমাজ বিরোধীদের পোষা নীতিহীন অর্থলোভী পুলিশ কর্মকর্তারা জায়গাটিকে কৌশলে পুলিশি কর্মকাণ্ডের আওতামুক্ত রেখেছেন।

মাসাধিককাল পড়েছিল লাশ
ওই এলাকার ভয়াবহতা নিয়ে জাতীয় দৈনিকের একজন সাংবাদিক বাংলানিউজকে তার অভিজ্ঞতার কথা  বলতে গিয়ে জানান, ২০০৮ সালের বর্ষার সময়ে স্থানীয় লোক মারত খবর পেলেন সেখানে পানিতে এক নারীর লাশ পড়ে আছে প্রায় মাসাধিককাল। বিষয়টি প্রথমে অবিশ্বাস্য ঠেকে তার কাছে। পরে সূত্রের পীড়াপীড়িতে ঘটনাস্থলে গিয়ে রীতিমত চোখ ছানাবড়া। কালো বোরখা ও হলুদ শাড়ী পড়া এক নারীর লাশ ঠিকই ভাসছে ছোট একটি পুকুরে। তবে তার মস্তকটি নেই।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেল- মস্তকটি একসময়ে খসে পড়েছে। অফিসকে বিষয়টি জানানোর পর তিনি পড়েন আরও অস্বস্তিতে। কারণ, মফস্বল এডিটর বিষয়টি বিশ্বাসই করছিলেন না। এর পেছনে যুক্তিও ছিল। এটা তো অসম্ভব! ঢাকা শহরের একেবারে কাছে এভাবে লাশ পড়ে থাকবে মাসাধিককাল!

পড়ে ওই রিপোর্টার ঘটনাস্থল থেকে মোবাইল ফোনে তুলে আনা ছবি প্রিন্ট করে দেখান মফস্বল সম্পাদককে। এবারও বিষয়টি নিয়ে সন্দেহ দেখা দেয়। বলা হলো- এটি বড় আকারের কোনও পুতুলও তো হতে পারে।

রিপোর্টার বলেন, ‘এ পর্যায়ে আমি নিজেও বিভ্রান্তিতে পড়ে যাই। পরে মফস্বল সম্পাদক বিষয়টির সুরাহা করতে অপর একজন রিপোর্টারকে সেখানে পাঠান। তিনি আরও ভাল করে খোঁজ খবর নিয়ে পাক্কা খবর জানালেন- অজ্ঞাত পরিচয় ওই নারীর লাশ সত্যি সত্যি মাসাধিককাল ওই পুকুরে পড়ে আছে। তবে কোনও কারণে লাশটি পচে যায়নি। ’

পরদিন এ বিষয়ে ওই পত্রিকায় রিপোর্ট ছাপা হওয়ার পর পুলিশ লাশটি উদ্ধার করে সৎকারের ব্যবস্থা করে।  

খুনের আদর্শ স্পট!   
কোনও মতেই নাম ঠিকানা প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয়রা জানান, লাশ পড়ে থাকার ঘটনায় নানাভাবে দেন দরবারের পর কখনো প্রশাসনের পক্ষ থেকে পুলিশ আসে- তবে লাশ উদ্ধার করেই দায়িত্ব শেষ তাদের।

আর মৃতদেহ পচে-গলে সনাক্তকরনের অযোগ্য অবস্থায় উদ্ধার করার ফলে এ নিয়ে আর তেমন কোনও তৎপরতা চালানো হয় না। আঞ্জুমানে মুফিদল ইসলামকে লাশ সৎকারের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে আর অজ্ঞাত পরিচয় লাশ উদ্ধারের নথিপত্র পূরণের আনুষ্ঠানিকতা শেষে সবকিছু ভুলে যায় সবাই।


 রতনের খামারে একের পর এক লাশ পাওয়া যাচ্ছে আর এলাকার মানুষের আতঙ্কও বাড়ছে। জনপ্রতিনিধিরা সব জানেন, তবে নানান কারণে কেউ তেমন একটা গা করেন না।

`পুলিশের সঙ্গে সম্পর্ক রেখেই এসব করে!`
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে কালিন্দি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ফজলুর রহমান প্রথমে কিছু বলতে চাননি। একপর্যায়ে এ জনপ্রতিধি বলেন, এটা পুলিশই বন্ধ করতে পারে। খুন-খারাবীর সঙ্গে জড়িতরা মাদক ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত। এক শ্রেণির অসাধু পুলিশের সঙ্গে সম্পর্ক রেখেই তারা এসব করে।

পাশের শুভাড্যা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ইকবাল হোসেনও একই কথা বললেন। তিনি জানান, খুন-খারাবির বিষয়ে পুলিশ মুখ বন্ধ করে রাখে।  

বর্ষায় রতনের খামারের আশপাশের এলাকা পানিতে ডুবে থাকে প্রায় ৪মাস। স্থানীয়রা জানান, বর্ষা চলে যাওয়ার পর জমিতে কাজ করতে গিয়ে অনেক সময়ে পাওয়া যায় মানুষের কংকাল। এনিয়ে থানা-পুলিশেও কেউ যায় না অহেতুক হয়রানি এড়াতে।  

আর তাই, রতনের খামারে লাশ গুম বন্ধ করতে প্রশাসনিক বা স্থানীয় উদ্যোগ নেই বললেই চলে। স্থানীয়দের ধারণা, সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন এলাকা থেকে নিখোঁজ বা গুম হয়ে যাওয়া অনেকের শেষ পরিণতি এই রতনের খামারেই হয়ে থাকতে পারে।

কালভার্ট ভেঙ্গে রাখা
রতনের মৎস্য খামার নিয়ে আছে নানান গল্প-কাহিনি। নাম-পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয়রা জানান- সেখানে শুধু রাতের অন্ধকারেই নয়, মানুষ হত্যার ঘটনা ঘটে দিনে-দুপুরেও।

ঢাকা-বান্দুরা প্রধান সড়কের কেরানীঞ্জের ভাগনা চিতাখোলা রাস্তা থেকে দেড় কিলোমিটার ভেতরের ওই খামারে যাওয়ার আগে একটি বক্স কালভার্ট পড়ে। কালভার্টটির কিছুটা অংশ সব সময়েই থাকে ভাঙ্গা। এটা সন্ত্রাসীদের কারসাজি বলে মনে করেন তারা।

খোঁজ খবরে জানা গেছে- জরুরি প্রয়োজনেও পুলিশ বা প্রশাসনের গাড়ি সেখানে দ্রুত পৌঁছাতে পারে না।  

১৯৯৬ সালের এক ঘৃণ্য ঘটনার পর...
ভয়ঙ্কর এ জায়গাটিতে দিনেও মানুষজন আসে না। বর্ষায় নৌকা দিয়ে পাশের জলাভূমি পাড় হয়ে নেমেই দেখা যাবে রাস্তার দু-ধারে ছোট ছোট লতা-গুল্ম আর বড় বড় ঘাসে ঢেকে রেখেছে পথ। একটু এগিয়ে গেলেই রতনের মৎস্য খামার। খামারের চার পাশে ঝোপ-জঙ্গল।

রতনের খামার ও আশপাশের ডোবাগুলোতে হত্যাকাণ্ড শুরুর বিষয়ে লোকমুখে যে কাহিনিটি প্রচলিত রয়েছে তা ভয়াবহ অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ আর নির্মমতার উদাহরণ হয়ে আছে।

স্থানীয় শ্যাম কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ ও খামারের মালিক এনামুল হক রতনকে নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যার মধ্য দিয়ে কুখ্যাত রতনের খামার আখ্যানের শুরু বলে স্থানীয় প্রবীণরা জানান।   তারা বলেন, তবে যে অপরাধের জের ধরে রতনকে হত্যা করা হয়েছে তা তারচেয়েও ভয়াবহ আর ঘৃণ্য।

সেটি ছিল ১৯৯৬ সালের নভেম্বরের এক বিকেল। বাবা-মার সঙ্গে রতনের খামারের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন এক তরুণী। এসময় সেখানে আড্ডারত কালিন্দি ইউনিয়নের চড়াইল হাজীবাড়ির বাসিন্দা রতন তাদের আটক করে। পরে বাবা-মাকে গাছের সঙ্গে বেঁধে তাদের সামনেই মেয়েটিকে ধর্ষণ করে।

এ ঘটনার পর সন্ধ্যার দিকে পাশের আব্দুল্লাহপুর (মেয়েটির বাড়ি ওই এলাকায়) এলাকার বিক্ষুব্ধ লোকজন এসে রতনকে পাকড়াও করে ঘটনাস্থলেই পিটিয়ে-কুপিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে লাশ ফেলে রেখে যায়। এরপর থেকে এলাকাটি সম্পর্কে ভীতি ছড়িয়ে পড়ে জনমনে আর সন্ত্রাসীদের অপকর্মের নিরাপদ স্পটে পরিণত হয় এটি।

এ ব্যাপারে রতনের পরিবারের লোকজন অবশ্য মুখ খুলতে চায় না। কথা বলতে চাইলে রতনের ভাই স্বপন ও লিটন জানান, বাড়ি থেকে বের হয়ে বিকালে খামার দেখতে গেলে সন্ত্রাসীরা রতনকে কুপিয়ে হত্যা করে। এর বেশি কিছু তারা বলতে চান না।

দশ মাসে ১৮ খুন!
চলতি বছরের জানুয়ারির প্রথম থেকে ১১ অক্টোবর পর্যন্ত পাওয়া হিসাবে রতনের খামারে ১৮ টি লাশ পাওয়া গেছে। একের পর এক মানুষ খুন করার এ চক্রটি মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত রয়েছে বলে জানা যায়।

খুনিচক্র আশপাশের উঠতি বয়সের যুবকদের দিয়ে মাদক বিক্রয় ও অন্যান্য অপরাধ সংঘটন করে থাকে। পরিচয় গোপন রাখার শর্তে একটি সূত্র জানায়, এখানে নিহতদের বেশিরভাগই ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় মাদকচক্রের সঙ্গে যুক্ত ছিল। কেউ শক্তিশালী ওই সিন্ডিকেটের  অবাধ্য হলেই তাকে হত্যা করা হয় রতনের খামারে নিয়ে।

আশপাশের এলাকার স্বজনহারারা ভয়ে মুখ খুলতে চায় না। খুন-গুমের সঙ্গে জড়িত মাদক সন্ত্রাসী ওই গ্র“পটি এত ভয়ঙ্কর যে যাদের হত্যা করা হয়েছে তাদের বাড়িতে কারা আসা যাওয়া করছে সে খোঁজখবর রাখার জন্য তাদের সার্বক্ষণিক সোর্স রয়েছে।

সাম্প্রতিক সময়ে সেখানে নিহততের বাড়িতে গেলে কেউই কোনও তথ্য দিতে চাননি (করজোড়ে তাদের কাকুতি-মিনতির কারণে কার কার বাড়িতে আমরা গিয়েছিলাম- তাদের নামও উল্লেখ করা হলো না। )

৯ মাসে অপমৃত্যুর ৮৭ মামলা!
পাশাপাশি দু’টি থানা দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ আর কেরানীগঞ্জ মডেল থানা। এই দুই থানার সন্ত্রাসীদের মধ্যে রয়েছে মজবুত যোগসাজস।

থানা সূত্রে জানা যায়, দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ ও মডেল থানায় ২০১১ সালের ১ জানুয়ারি হতে ১১ অক্টোবর পর্যন্ত ৮৭ টি অপমৃত্যু মামলা হয়েছে। এর মধ্যে দক্ষিণ কেরানীঞ্জে ৫৪টি ও মডেল থানায় ৩৩ টি মামলা হয়। পুলিশ বাদী হয়ে এ মামলাগুলো অপমৃত্যু মামলা হিসেবে রুজু করেছে। মামলাগুলোকে পুলিশি ভাষায় ক্লু-লেস মামলা হিসেবে অভিহিত করা হয়। এর ফলে এ নিয়ে আর তেমন খোঁজ-খবরে যেতে হয় না কাউকেই।

মামলার তদন্ত না হওয়ায় খুনিরা বেপরোয়া
এলাকাবাসী জানান, এসব অপমৃত্যু মামলার তদন্ত না হওয়ায় দিন দিন অপরাধী চক্রটি আরো বেপরোয়া হয়ে উঠছে। কোনও ঘটনায় লাশ উদ্ধার হলেও পরে লাশের ময়না তদন্তের রিপোর্টের পর আর খবর থাকে না। এভাবে চাপা পড়ে যায় মামলা। তদন্ত আর হয় না। স্থানীয়দের অভিযোগ, খুনির এ চক্রটির সঙ্গে এক শ্রেণীর অসাধু পুলিশের আঁতাত রয়েছে।

এভাবে সন্ত্রাসীরা নির্বিঘ্নে চালিয়ে যায় তাদের অপকর্ম। অপরদিকে, একের পর এক মায়ের বুক খালি হয়।

এ অঞ্চলে হত্যা, ধর্ষণ, ডাকাতি দিন দিন বাড়ছে। ৪/৫ দিন পরপর বুড়িগঙ্গা নদীতে ভাসমান লাশ পাওয়া যাচ্ছে। রতনের খামারে গলাকাটা লাশ পাওয়া এখন সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। পুলিশ লাশ উদ্ধার করে  চলেছে। কিন্তু যারা একের পর এক জীবন্ত মানুষকে লাশে পরিণত করছে তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। তাদের নামও বলছে না কেউ।

তবে বাংলানিউজের অনুসন্ধানে কয়েকটি নাম জানা গেছে যাদের প্রত্যেকের নামে কেরানীগঞ্জের দু’টি থানায়ই একাধিক মামলা রয়েছে। এরা হলেন- মোল্লা জুয়েল, ল্যাংড়া স্বপন, আশরাফউদ্দিন, নাঈম, নাসিম, রাশিয়ান পাপ্পু, ইয়াসীন প্রমুখ। জানা গেছে, এদের প্রত্যেকের নামে হত্যা ও মাদকের মামলা থাকা সত্ত্বেও পুলিশ তাদের ধরে না। আর নতুন অপরাধের ঘটনাগুলোয় তাদের নাম এলেও তদন্তে তাদের নাম বাদ দিয়ে পরবর্তী কার্যক্রম চালানো হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের একটি সূত্র জানায়, ঠিক রাজধানীর পাশেই খুন ও লাশ গুম করার তুলনামূলক নিরাপদ এই স্থানটি রাজধানীসহ বাইরের প্রভাবশালী দুর্বৃত্তরাও অনেক সময়ে ব্যবহার করে থাকে। পুলিশ কোনওমতেই মুখ খুলতে চায় না রতনের খামার নিয়ে এবং একই সঙ্গে এলাকাবাসীও জড়িতদের কারও নামই মুখে আনতে চায় না।     

স্থানীয়দের প্রশ্ন- ভয়াবহ এ অপরাধী চক্রটিকে কারা উৎসাহিত করছে? আর পুলিশের দায়িত্ব কি শুধু লাশ উদ্ধার করা!

যারা খুন হয়েছে তাদের স্বজনরা বাংলানিউজকে জানান, স্বজনহারার বেদনা শুধু তাদেরই। তবে তাদের কিছু করার নেই। মুখ খুললে তাদেরও লাশ হয়ে বিদায় নিতে হবে। এটাই নিশ্চিত। যার ফলে মামলা নিয়ে আর মাথা ঘামায় না কেউ।

এভাবেই কি চলতে থাকবে!
পুলিশ প্রশাসনের নির্লিপ্ততায় আর কত মায়ের বুক খালি হতে থাকবে কেরানীগঞ্জবাসী জানতে চায়। গত ২২ সেপ্টেম্বর খুন হয় রাসেল (২০)। এ ঘটনায় দায়ের করা মামলা নং- ২৮ (৯) ১১ মডেল থানা। সন্ত্রাসীরা রাসেলকে কুপিয়ে হত্যা করে ফেলে রেখে যায় রতনের খামারে।

এ ব্যাপারে প্রশ্ন করলে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাখাওয়াত হোসেন বাংলানিউজকে জানান, তিনি এ থানায় নতুন এসেছেন। রতনের খামারের বিষয়ে তার জানা নাই।

তিনি আরও জানান, অপমৃত্যু মামলাগুলোর ময়নাতদন্ত রিপোর্টে হত্যা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হলে সে মামলার অবশ্যই তদন্ত হয় এবং আসামি গ্রেপ্তারের জন্য পুলিশ চেষ্টা চালায়। তবে কিছু কিছু এলাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থা খারাপ থাকায় পুলিশের ওই স্থানগুলোতে যেতে সমস্যা হয়।

অপরদিকে, কেরানীগঞ্জ মডেল থানার ওসি মাঈন উদ্দিন খান বাংলানিউজকে জানান, তিনিও নতুন এসেছেন। পুরনো মামলাগুলো সবেমাত্র দেখা শুরু করেছেন। তবে কোনওভাবেই যেন তার থানায় আইন-শৃঙ্খলার অবনতি না হয় সে ব্যাপারে কঠিন পদক্ষেপ নেবেন বলে তিনি জানান।

তবে এ বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে পুলিশের ঊর্ধ্বতন মহলের এখনি কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত বলে মনে করছেন কেরানীগঞ্জের সচেতন মানুষ।

বাংলাদেশ সময়: ১৮১২ ঘণ্টা, ২৪ অক্টোবর, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।