ঢাকা, বুধবার, ২৯ মাঘ ১৪৩১, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২ শাবান ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

ইভিএম: ডিজিটাল যাত্রার আরও এক ধাপ

রহমান মাসুদ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭২৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ১, ২০১১
ইভিএম: ডিজিটাল যাত্রার আরও এক ধাপ

ঢাকা: ডিজিটাল বাংলাদেশের আরও এক ধাপ অগ্রগতির স্মারক হিসেবে অভিহিত করা যায় ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) ব্যবহারকে। এই প্রথম অপেক্ষাকৃত বড় পরিসরে ইভিএম ব্যবহৃত হলো নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন (নাসিক) নির্বাচনে।

অনেক আলোচনা, সমালোচনা ও বিতর্কের পর ও নির্বাচন কমিশন ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেনি। তার ফলাফল ও পেয়েছে নারায়ণগঞ্জবাসী।

ইভিএম ব্যবহারে শুরু থেকেই তেমন বড় কোনো গোলযোগ হয়নি। তবে পোলিং এজেন্টদের বারবার রিপ্লাই করতে গিয়ে কোনো কোনো কেন্দ্র ভোট শুরু করতে ৫ থেকে ১০ মিনিট দেরি হয়েছে। তবে ইভিএমে ভোট হওয়া ৯টি ওয়ার্ডের ৫৮টি কেন্দ্রের ৪৫০টি ভোট কক্ষের প্রায় দেড় লাখ ভোটারের রায় কিন্তু সবার আগেই আসতে শুরু করে রিটার্নিং কর্মকর্তার মনিটরিং সেলে।

নারায়ণগঞ্জে ইভিএমের সফল ব্যবহার বড় পরিসরে যাত্রার পথ সুগম করলো বলেই সংশ্লিষ্টদের ধারণা। এ ধারণা নাসিকের ভোটারদেরও। ভোটের আগের দিনে নারায়ণগঞ্জে গিয়ে দেখা গেছে নতুন এ প্রযুক্তিকে স্বাগত জানিয়ে ইতিহাসের সাক্ষ্মী হতে মুখিয়ে আছে মানুষ।

তবে প্রথমবারের মতো এ প্রযুক্তি ব্যবহারের আগে সচেতনতামূলক প্রচারণা ও প্রশিক্ষণের প্রয়োজন ছিল বলে মন্তব্য করেছেন সাধারণ ভোটাররা।

রোববার সকাল আটটা থেকে বিকাল চারটা পর্যন্ত একটানা ভোট চলে নতুন এ সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে। ১৬৩টি কেন্দ্রের মধ্যে সদর, বন্দর ও সিদ্ধিরগঞ্জের নয়টি ওয়ার্ডের ৫৮ কেন্দ্রে ইভিমে ভোট হয়। এ নির্বাচনের মাধ্যমে নারায়ণগঞ্জবাসী তাদের প্রথম মেয়র, ২৭ জন কাউন্সিলর ও ৯ জন সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর বেছে নেন।

আটটায় শুরু হয়ে ভোট চলে চারটা পর্যন্ত। সন্ধা সোয়া ছয়টা নাগাদ শুরু হয় রিটানিং কর্মকর্তার মনিটরিং সেল থেকে বেসরকারিভাবে ফলাফল ঘোষণা। কেন্দ্রভিত্তিক এ বেসরকারি ফল ঘোষণা চলে মধ্যরাত অবধি। প্রথমেই ইভিমে ভোট হওয়া কেন্দ্রের ফলাফল ঘোষণা করা হয়। প্রথম ঘোষিত কেন্দ্র হলো ওয়ার্ড নম্বর ১৮, কেন্দ্র নম্বর ১১৯ ।

নাসিকে ব্যাপক হারে ইভিএম ব্যবহার করে ইতিহাসের সাক্ষ্মী হয়ে থাকলেন ঢাকা বিভাগিয় নির্বাচন কমিশনার, নির্বাচন কমিমনের যুগ্ম-সচিব ও নাসিক নির্বাচনের রিটানিং কর্মকর্তা বিশ্বাস লুৎফর রহমান। বহু বছর পদোন্নতি বঞ্চিত এ কর্মকর্তা গত মাসেই যুগ্ম-সচিব হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছেন। তার চাকরির মেয়াদও শেষ পর্যায়ে, মাস তিনেক পরেই তিনি যাচ্ছেন অবসরে। আর তার আগেই এমন একটা অবাধ নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু প্রযুক্তি নির্ভর নির্বাচন উপহার দিলেন তিনি।

নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার  নিয়ে বাংলানিউজের কাছে সন্তোষ ও প্রকাশ করেন এ রিটার্নিং কর্মকর্তা। তিনি জানান, নারায়ণগঞ্জে সফল হয়েছে এ প্রযুক্তির ব্যবহার। সবার কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়াও পাওয়া গেছে।

ফল ঘোষণায় দেরি
ভোট শেষ হলো চারটায় ১ ঘণ্টার মধ্যেই শেষ হয়ে গেলে ৯ ওয়ার্ডের ৫৮ কেন্দ্রের গণনার কাজ। কিন্তু রিটানিং কর্মকর্তা ফল ঘোষণা শুরু করেন সোয়া ছয়টায়। এর কারণ কি? জবাবে নারায়ণগঞ্জ জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা ও সহকারি রিটার্নিং কর্মকর্তা ফরহাদ হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, ‘নিয়ন্ত্রণকক্ষে ভোট শেষের দুই ঘণ্টা পরে ফল ঘোষণা শুরু হয়। ফলাফল কেন্দ্রে এসে পৌঁছাতে সময় লাগে। কিন্তু কেন্দ্রভিত্তিক ফল প্রিজাইডিং কর্মকর্তা খুব দ্রুতই দিয়েছেন। ’

তিনি বলেন, ‘চার টায় ভোট শেষ হওয়ার পরই এজেন্টদের সঙ্গে নিয়ে অনন্ত ৪৫ মিনিটের মধ্যেই ইভিএমের সব কেন্দ্রে গণনা শেষ হয়। সঙ্গে সঙ্গে ফলও জানিয়ে দেওয়া হয়ে।

তিনি জানান, কেন্দ্রে ফল প্রস্তুতের পর প্রয়োজনীয় মালামাল সংগ্রহ করে সংশ্লিষ্টদের নিয়ে নিরাপত্তা প্রহরায় রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ের নিয়ন্ত্রণ কক্ষে আসতে সময় লেগেছে। নারায়ণগঞ্জ সদরে ফল নিয়ন্ত্রণকক্ষে ছয়টা থেকে আসতে শুরু করলেও বন্দর ও সিদ্ধিরগঞ্জের ফল আসতে দেরি হয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা ও নিরাপত্তার বিষয়টিও মাথায় নিয়ে কাজ করতে হয়। এটা সবাইকে মানতে হবে, সহযোগিতা করতে হবে।

ইভিএমের পক্ষে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এটিএম শামসুল হুদার যুক্তি, ‘নির্বাচনী ব্যবস্থাপনাকে সহজতর, ফল ঘোষণা তাড়াতাড়ি করা, নির্বাচনোত্তর সহিংসতা কমানো, নির্বাচন পরিচালনা ব্যয় কমানো ও প্রশাসনিক জটিলতা কমানোসহ আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য এ উদ্যোগ। ’
দেশের প্রথমবারের মতো ইভিএমে ভোট হয় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের একটি ওয়ার্ডের ১৪টি কেন্দ্রে।

ইভিএম স্বাগত
দশ নম্বর শীতলক্ষ্ম্য সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী কামরুল হাসান মুন্না ইভিএমে তার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বলেন, ওই কেন্দ্রে চারটায় ভোট শেষ হওয়ার আধ ঘণ্টা মধ্যেই ফল ঘোষণা করতে পেরেছেন প্রিজাইডিং কর্মকর্তা।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইভিএম উদ্ভাবক ড. লুৎফুল কবির এ বিষয়ে বলেন, ‘যারা ইভিমে ভোট দেওয়ার মহড়ায় অংশ নিয়েছিলো তাদের ভোট নিতে কোনো সমস্যা হয়নি। কিন্তু যারা ভোটের আগে মহড়ায় যায়নি, দিনমজুর খেটে খাওয়া মানুষ তাদের সমস্যা হয়েছে। ’

বুলবুল নামের একজন এজেন্ট জানান, ভোট কক্ষের বাইরে ইভিএমে ভোট দেওয়ার পদ্ধতি সম্বলিত পোস্টার দেখিয়ে, যান্ত্রিক সুবিধা ও পদ্ধতি বুঝিয়ে অনেকের ভোট নিতে হয়েছে। প্রশিক্ষণ না থাকায় ভোট শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও অনেক এজেন্টও ছিল অনভিজ্ঞ।

বুলবুল বলেন,  ভোট গণনার সময় কেন্দ্রে প্রার্থীর প্রতিটি ভোট দেখতে না পাওয়ায় কয়েকজন এজেন্ট প্রশ্ন তুলেন। তারা সমষ্টিগত ভোটের চেয়ে ব্যালট পেপারের মতো পৃথক ভোট দেখতে চায়। যথাযথ প্রশিক্ষণ থাকলে হয়ত এমন প্রশ্নই রাখতো না এজেন্টরা মনে করেন বুলবুল।

এছাড়া প্রশিক্ষণ না থাকায় অনেকে ইভিএম মেশিনের বাটন এক সাথে কয়েকটি টিপ দিয়ে স্লো করে ফেলেছে বলে জানান লুৎফুল কবির। পরে তা ঠিক হয়ে যায় বলেও জানান।

নাসিক নির্বাচনের আগের দিন নারায়নগঞ্জে গিয়ে দেখা গেছে মানুষ  শুরু থেকেই ইভিএম গ্রহণে অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে।

নগরীর শহীদনগর, নলুয়া, জয়গোবিন্দ স্কুল, মার্গান স্কুল প্রভৃতি কেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেছে, সকাল ৬টা থেকে মানুষের অপেক্ষা। কিন্তু ৮টার আগে ভোট শুরু না হওয়ায় কাউকে ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি।

কেবল তাই নয়। জয় গোবিন্দ স্কুলে ভোট দিয়ে কিছুটা সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন সত্তরোর্ধ্ব জিন্না মিয়া। তিনি বলেন, ভোট দিতে তো ভালো লাগলো। কিন্তু যাকে দিলাম তার কাছে গেছে কি না, ভোট পাল্টে ফেলার সুযোগ রয়েছে কি না, বুঝতে পারছি না। দেখি ফল কী হয়! কিন্তু সোমবার তার সঙ্গে কথা বলে দেখা গেছে, ভোটের ফলাফলে সন্তোষ প্রকাশ করে ইভিএমের প্রতি আস্থা বেড়েছে এই বৃদ্ধের।

২৭টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৯টি ওয়ার্ডের (৭, ৮, ৯, ১৬, ১৭, ১৮, ২২, ২৩, ২৪) মোট ৫৮ কেন্দ্রের ৪৫০টি বুথে একটি করে ইভিএম ব্যবহার করা হয়।

আত্মবিশ্বাসী ইসি
নাসিকের নির্বাচনে ইভিএমের সফলতায় আত্মবিশ্বাস বেড়েছে ইসির। সিইসি বলেছেন, আমরা নারায়ণগঞ্জে ইতিবাচক সাড়া পেয়েছি।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিক্যাশন টেকনোলজি ও বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি ইভিএমের কারিগরি বিষয় দেখভাল করছে। ।

ইসির আইসিটি পরিচালক বলেন, ইসি খুবই সন্তুষ্ট। আগামীতে এ প্রযুক্তির ব্যবহারের পথ সুগম হলো এতে। নারায়ণগঞ্জের অভিজ্ঞতার বিষয়ে আইআইসিটি পরিচালক জানান, একটু বড় পরিসরে ইভিএম ব্যবহারে  ভোটার ও ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের বিষয়ে বেশ কিছু নতুন অর্জন হয়েছে। তবে নয়টি ওয়ার্ডে সফলভাবে ইভিমের ব্যবহার হওয়ায় সন্তোষ রয়েছে তাদের। মক ভোটিং ও ইভিএম নিয়ে প্রচারণা পর্যাপ্ত হয়নি বলে মনে করেন তিনি।

নারায়ণগঞ্জে ৬৯ দশমিক ৯২ শতাংশ ভোট পড়েছে। ইভিএম কেন্দ্রগুলোয়ও গড়ে ৭০ শতাংশ ভোট পড়েছে বলে জানান আইসিটি পরিচালক।

নির্বাচন কমিশন ইতিমধ্যে বলেছে, আগামী সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের সব প্রস্তুতি তারা রেখে যাবে। পরবর্তী নির্বাচন কমিশনই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ অধিকাশ রাজনৈতিক দল ইভিএমের পক্ষে। প্রধান বিরোধীদল ও তার শরিকরা এর বিরোধিতা করছে। রাজনৈতিক দলগুলোর এ বিষয়ে আস্থা তৈরির চেষ্টা করছে ইসি।

বাংলাদেশ সময়: ১৭১৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ০১, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।