ঢাকা: গুলশান ও বনানীর মতো অভিজাত এলাকার মাঝখানে কড়াইল বস্তি যেন এক বিষফোঁড়া। রাজধানীর অন্যসব বড় বড় বস্তির মতো গুলশান থানার এই বস্তিটিরও নামের সাথে সন্ত্রাস, মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, অপরাধীদের আশ্রয়স্থল, দখল ও পাল্টাদখলের বদনাম অঙ্গাঙ্গী হয়ে আছে।
রাজধানীর দরিদ্র মানুষদের আবাসস্থলে পরিণত হয়েছে এই বস্তি। এরা গার্মেন্টস শ্রমিক, দিনমজুর, গৃহপরিচারিকা, রিকশাওয়ালা সহ কায়িক শ্রমজীবী। বস্তিটি নগরীর শ্রমজীবী বহু মানুষকে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দিলেও অপরাধী, সন্ত্রাসীরাও সক্রিয় এখানে।
গুলশান সোসাইটির সভাপতি ড. সিএম শফি সামী বলেন, ‘অভিজাত এলাকার মাঝখানে কড়াইল বস্তি বিষফোঁড়া হিসেবে দেখা দিয়েছে। এটি অভিজাত এলাকার বাসিন্দাদের জন্য একটি বড় ধরনের সমস্যা। সরকারের উচিত ছিন্নমূল মানুষগুলোর মাথা গোঁজার বিকল্প ব্যবস্থা করে বস্তির সরকারি জমি উদ্ধার ও পরিকল্পিতভাবে এর ব্যবহার নিশ্চিত করা। প্রস্তাবিত আইটি পল্লী এবং গুলশান লেক উন্নয়ন প্রকল্পটি যত শিগগিরই সম্ভব বাস্তবায়ন করা উচিত। ’
তিনি বলেন,‘কিছু ব্যতিক্রম বাদে বিশ্বের অন্যত্র অভিজাত এলাকার পাশে এমন বস্তির নজির নেই। আমরা তাদের পুনর্বাসন চাই। সরকার এ ব্যাপারে বড় ধরনের প্রকল্প নিতে পারে। ’
ডিসিসির মেয়র সাদেক হোসেন খোকা বলেন, ‘আমরাতো চাই না কেউ বস্তিবাসী হোক। গুলশান বনানীর মতো এলাকার পাশে বস্তি-- এটা দেখে সবারই কষ্ট লাগে। আমরা বস্তিবাসীদের উন্নয়নে সর্বোচ্চ চেষ্টা কর্। ি সরকার বড় ধরনের পদক্ষেপ নিয়ে তাদের পুনর্বাসন করতে পারে। তারা লেকের পরিবেশ দূষণ করছে এটা সত্যি। কিন্ত নানাভাবেইতো দূষণ হচ্ছে। শিক্ষিত লোকরাও কম দূষণ করছে না। ’
রাজউকের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. নূরুল হুদা বলেন, ‘আমরা জানি কড়াইল বস্তিবাসী নানাভাবে গুলশান লেকের পরিবেশ নষ্ট করছে ও দূষণ ঘটাচ্ছে। গুলশান লেক উন্নয়নে সরকার একটি মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। তবে নানা কারণে এ এলাকায় উন্নয়ন প্রকল্প বাধাগ্রস্ত হয়। ’
কড়াইল বস্তিটির বনানী ও গুলশান সংলগ্ন এলাকা ১৯ ও মহাখালির দিকের অংশটি ২০ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্যে পড়েছে। ঘনবসতিপূর্ণ এই বস্তিতে কত লোক বাস করে তার সঠিক কোনও হিসাব নেই ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের কাছে।
১৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আ. ফ. ম. আবদুল আলিম নকী বাংলানিউজকে বলেন, ‘কড়াইল বস্তিও আশপাশ এলাকায় প্রায় ৫০ হাজারের বেশি মানুষ বাস করে। তাদের অধিকাংশই নিম্নবিত্ত। গুলশান বনানীর অভিজাত এলাকার পাশে এ ধরনের বস্তির ব্যাপারে অনেক অভিযোগ থাকবে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু তাদের পুনর্বাসন করতে হবে। ’
২০ নম্বর ওয়ার্ড কমিশনার আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘প্রভাবশালী লোকজনের ছত্রছায়ায় এখানে নানা অপরাধ হয়। এই চক্রটি গরিব মানুষদের ব্যবহার করছে। সত্যিকারের নিরীহ ও নিম্নবিত্তরা যদি এই বস্তিতে ঘর তুলে বিনা ভাড়ায় বসবাস করতো তাহলে সেটা ভিন্ন ব্যাপার হত। কিন্ত এখানে ঘর ভাড়া করে থাকার প্রচলন হয়েছে। নানা ধরনের দলাদলির কারণে এখানে নানা সমস্যা সত্ত্বেও সমাধান হচ্ছে না। আমাদের হাতে এ ব্যাপারে তেমন কিছুই করার নেই। ’
ভূমি অফিস ও ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের সাথে কথা বলে জানা যায়, কড়াইল বস্তি বর্তমানে প্রায় ৯০ একর জায়গাজুড়ে অবস্থিত। এটি রাজধানীর বৃহত্তম বস্তি হিসেবে পরিচিত। বস্তির জমির মালিকানা তিনটি প্রতিষ্ঠানের পিডব্লিউডি, বিটিসিএল ও বিজ্ঞান ও তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের। গুলশান থানার কড়াইল মৌজায় সরকারের অধিগ্রহণ করা ১১৬ দশমিক ৭৭ একরসহ ব্যক্তিগত অনেক জমির ওপর গড়ে ওঠে এই বস্তি।
এখানকার হাজার হাজার কোটি টাকার বিশাল সম্পত্তি একদিকে সরকারের কোনো কাজে আসছে না, অন্যদিকে অনেকে ব্যক্তিগত সম্পত্তি থেকে উচ্ছেদ হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। ৫৩ বছর ধরে অনেক চেষ্টা করেও অধিগ্রহণ করা অব্যবহৃত জমি অবমুক্ত করতে পারছেন না তাঁরা। কড়াইলের আদি বাসিন্দা মো. নিজাম উদ্দিন জানান, তাঁর দাদা আবদুস সোবহানের সাত বিঘা জমি ১৯৫৭ সালের দিকে অধিগ্রহণ করা হয়, যার বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ৭০০ কোটি টাকা। ভূমি অধিগ্রহণ আইনে অব্যবহৃত জমি প্রকৃত মালিকদের ফিরিয়ে দেওয়ার বিধান থাকলেও এ ক্ষেত্রে তা কার্যকর হয়নি।
কড়াইলের আদি বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন অভিযোগ করেন, তাঁদের কাছ থেকে জমি অধিগ্রহণ করলেও সরকার তা কাজে লাগায়নি, আবার ফেরতও দিচ্ছে না। ভূমি অফিস থেকে জানা যায়, সিএস ৩ থেকে ১৮ , ৩৩, ৩৪, ৪০ থেকে ৫৭, ৬১ থেকে ৭১ ও ৮১ দাগের ১১৬ দশমিক ৭৭ একর জমি ১৭/৫৭-৫৮ নম্বর মামলার মাধ্যমে সরকার অধিগ্রহণ করে।
জানা যায়. গুলশান থানার কড়াইল মৌজার ১১৬ দশমিক ৭৭ একর জমি পাকিস্তান আমলে টিঅ্যান্ডটি বোর্ডের বেতারকেন্দ্র নির্মাণের জন্য সরকার অধিগ্রহণ করে। কিন্তু পরে ওই কেন্দ্র নির্মিত না হওয়ায় সম্পূর্ণ জমিই অব্যবহৃত রয়ে যায়। দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত থাকার পর ওই জমিতে ধীরে ধীরে অবৈধ বসতি গড়ে ওঠে, যা কড়াইল বস্তি নামে পরিচিতি পায়।
পরিবেশ ও নগর পরিকল্পনাবিদসহ সচেতন মহল কড়াইল বস্তিবাসীকে অন্যত্র পুনর্বাসনের মাধ্যমে রাষ্ট্রের মূল্যবান সম্পদ উদ্ধার ও এখানে আইটি ভিলেজসহ সরকারের প্রস্তাবিত প্রকল্পগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন প্রয়োজন বলে মত প্রকাশ করেন।
নগর গবেষক ও ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান ও প্রখ্যাত শিল্প সমালোচক অধ্যাপক ড. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘কড়াইল বস্তির জনশক্তিকে কাজে লাগানোর ব্যবস্থা করতে হ্েব। আমি মনে করি বস্তিবাসীদের অবহেলার চোখে অনেকে দেখলেও বস্তির শ্রমজীবী মানুষেরা ঢাকার পাশাক শিল্প, পরিবহন শিল্প, ক্ষুদ্র ব্যবসা সহ নানা কাজের চাকা সচল রেখেছে। রাজনীতিকরা যদি উদ্যোগ নেন বস্তির নানা সমস্যার সমাধান হবে বলে আমার বিশ্বাস। ’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড. মুহাম্মদ সামাদ বলেন. ‘বস্তিবাসীদের পর্যাপ্ত নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করতে পারলে বস্তিবাসীদের নিয়ে বসবাস করতে কোনও অসুবিধার সৃষ্টি হবে না। এজন্য সরকার, এনজিও, স্থানীয় নেতা ও সাধারণ জনগণের মিলিত প্রচেষ্টায় কড়াইল বস্তি উন্নত নাগরিক সুবিধা দিতে পারে। ’
বাংলাদেশ সময়: ১৫২৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০১, ২০১১