ঢাকা, বুধবার, ২৮ মাঘ ১৪৩১, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২ শাবান ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

জঙ্গল কাইটা এই অঞ্চল ‘স্বাধীন’ করছি : নিজাম ডাকাত

রহমান মাসুদ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৪৩ ঘণ্টা, মার্চ ১৫, ২০১২
জঙ্গল কাইটা এই অঞ্চল ‘স্বাধীন’ করছি : নিজাম ডাকাত

চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, ফেনী, লক্ষ্মীপুর ও ভোলার বিস্তীর্ণ চরাঞ্চল। দেশের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন এক জনপদ।

প্রকৃতির খেয়ালের ওপর ভর করে চলে এখানকার মানুষের জীবন-জীবিকা। তার ওপর জলেস্থলে দস্যুদের অতর্কিত হানা এখানকার মানুষকে রাখে চরম অনিরাপত্তায়। পুরোটাই এক সন্ত্রাসের উপকূল। এই বিস্তীর্ণ চরাঞ্চলে এক পক্ষকাল চষে বেড়িয়েছেন বাংলানিউজের সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট রহমান মাসুদ ও ফটো করেসপন্ডেন্ট উজ্জ্বল ধর। সেখান থেকে তুলে এনেছেন সন্ত্রাসের ওই জনপদের অনেক সচিত্র কাহিনী। আজ তার প্রথম কিস্তি.... 

জঙ্গল কাইটা এই অঞ্চল ‘স্বাধীন’ করছি : নিজাম ডাকাত

পুরো নাম নিজাম চৌধুরী। চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, ফেনী, লক্ষ্মীপুর ও ভোলার বিস্তীর্ণ চরাঞ্চল, উদার মেঘনার বিশাল সীমারেখা ছাড়িয়ে গভীর বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়া ত্রাসের এক নাম ‘নিজাম ডাকাত’।

টানা ১৪ দিন চরাঞ্চলে ঘুরে তিনদফা শিডিউল করেও শেষ পর্যন্ত নিজাম চৌধুরীর সঙ্গে কথা হয় টেলিফোনে। তবে সেটি নিজামের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড বাহার কেরানীর মোবাইল ফোনে। এর আগে সেকেন্ড ইন কমান্ড বাহার কেরানী ও থার্ড ইন কমান্ড করিম ফিটার বাংলানিউজের এই প্রতিবেদককে ঘুরিয়ে দেখান নিজাম চৌধুরীর বিশাল ‘সাম্রাজ্য’।      

নিজাম চৌধুরী বলেন, ‘আমরা জঙ্গল কাইটা এ অঞ্চল স্বাধীন করছি। ’

শুরুতেই তিনি স্মরণ করেন তার নেতা বাসার মাঝির কথা। তিনি বলেন, বাসার মাঝি আমাদের মুরুব্বি ছিলেন। তিনি এ অঞ্চলের ভূমিহীনদের চরে আশ্রয় দিছিলেন। চরের নোনাবন, ক্যাপড়া (কেওড়া), গোয়া (গেওয়া) কাইটা এ অঞ্চলে মানুষের শাসন প্রতিষ্ঠা করছি। সুদিনে (শুকনা সময়) এইহানে অনেকে আয় (আসে) যায়। কিন্তু দুর্দিনে (বর্ষাকালে) এইহানে কেউ আয় না (আসে না)।

বাসার মাঝি ভূমিহীনদের একদাগ কইরা (১৬০ শতাংশ) জমি দিয়েছিলেন জানিয়ে নিজাম অভিযোগ করে বলেন, ‘হাতিয়ার এমপি আজিম সাব (ফজলুল আজিম), নোয়াখালির এমপি একরামুল হক চৌধুরী ও হাতিয়ার উপজেলা চেয়ারম্যান অলি মিয়া র‌্যাব দিয়া বাসার মাঝিরে খুন করাইছে। ’

‘র‌্যাব বাসার মাঝিরে জীবিত ধরছিল। তারে তাজা নিতে চাইছিল। ৫০/৬০ হাজার মানুষ বাসার মাঝিরে ছাড়াইয়া আনতে গেছিল। কিন্তু আজিম সাব এবং একরাম চৌধুরী অনেক কিছু ফাঁস হয়ে যাওয়ার ভয়ে বাসার মাঝিরে র‌্যাবরে দিয়া গুলি কইরা মারছে’, বলেন নিজাম চৌধুরী।

তিনি বলেন, শেষ জীবনে বাসার মাঝি ভালো হইয়া গেছিলেন। তিনি কোন রাজনৈতিক নেতারে পাত্তা দিতে চাইতেন না। তিনি ভূমিহীনদের সমাজ গড়ে তুলছিলেন। পাঁচটা চরে ৪৫টি স্কুল, ৪৫টি মাদ্রাসা ও ৪৫টি মসজিদ গড়ে তুলছিলেন। বাথানখালিতে একটি হিন্দু মহল্লা গইড়া তুলছিলেন। মন্দির বানাইয়া দিছিলেন। এসবই করেছেন নিজের টাকায়। আমরা এখন এইগুলা নিজের টাকায় চালাইতাছি। ’

‘বাসার মাঝি খুন হওয়ার পর নাসির কেরানী (এক সময় বাসার মাঝির সেকেন্ড ইন কমান্ড) আজিম সাব, একরামুল হক চৌধুরী, অলি মিয়া ও মওদুদ আহমেদের মদদে চরে খুন, গুম, ডাকাতি, ধর্ষণ, লুট, ও নারী নির্যাতনের মাধ্যমে অস্থির অবস্থা শুরু করে। এ অবস্থা দেখে আমি (থার্ড ইন কমান্ড) নাসিরের কাছ থেকে দূরে সরে আসি এবং নাসিরের অন্যায়ের প্রতিবাদ করি। এ সময় সন্দ্বীপের খোকা বাহিনীকে সাহায্য করেন মওদুদ আহমদ। খোকা মওদুদকে ধর্মের বাপ বলে। খোকা এবং নাসিরকে সাহায্য করে সন্দ্বীপের এমপি মোস্তফা কামাল পাশা। নাসিরের সহায়তায় খোকা উড়িরচরে ঘাঁটি গাড়ে,’ বলতে থাকেন নিজাম।

তিনি বলেন, ‘এ দুই বাহিনীর অত্যাচারে মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে আমার হাতে অস্ত্র তুলে দেয়। আমি এমনি এমনি শখ কইরা অস্ত্র হাতে নেই নাই। আপনারা সাধারণ মানুষরে জিজ্ঞেস করেন, কেউ আমারে ডাকাত বলবে না। সাধারণ মানুষ এখন ভালো আছে। শান্তিতে আছে। ’

নিজাম চৌধুরী বলেন, ‘নাসির কেবল অত্যাচারই করত না। বাসার মাঝির বানানো স্কুল, মাদ্রাসা, মসজিদেও তালা দেয়। হাজার হাজার শিশু পড়া ছাইড়া বাড়িতে বইসা থাকত। ’

‘আমি কোনো রাজনৈতিক নেতারে সালাম দেই না, তাই তারা আমারে বাহিনী প্রধান বা ডাকাত বলে সাব্যস্ত করে। এই কথাডা কেউ তুলে ধরে না, লিখে না। সবাই আমারে ডাকাইতই বলে। রাজনৈতিক নেতারা আমার কাছে টাকা চায়। মাসোয়ারা চায়। আমি টাকা পাই কই! আমি গরীব মানুষের নেতা। ভূমিহীনদের বন্ধু। সাধারণ মানুষ আমার হাতে অস্ত্র তুলে দিছে। আমি সেই অস্ত্র তাদের জানমালের নিরাপত্তায় ব্যবহার করছি। ’

‘দেখেন আমরা আওয়ামী লীগ করি। বিএনপির শাসনামলে আমরা এ এলাকার নাম- মুজিব বাজার, হাসিনা বাজার রাখি।   বর্তমানে মুজিব বাজারে মুজিবনগর উপজেলা করার দাবি জানিয়েছি। বিএনপির অত্যাচার সহ্য করছি। তারা আমাদের অমানুষিক অত্যাচার করছে। এখন আমাদের দল ক্ষমতায়। এখনো আমরা অত্যাচারিত। যখন তখন র‌্যাব-পুলিশ চরে হানা দিয়ে আমাদের অত্যাচার করে। ঘরবাড়ি ভাইঙ্গা দেয়, পুড়াইয়া দেয়। চরের সাধারণ ভূমিহীনদের ধইরা বাহিনীর সদস্য বইলা মারধর করে। ’

তবে চরাঞ্চলের সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেলো ভিন্ন এক চিত্র। তারা জানালেন-

নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার সন্ত্রাসের জনপদে বর্তমান একাধিপতি নিজাম বাহিনীর প্রধান এই নিজাম ডাকাত।

বিচ্ছিন্ন চরাঞ্চলসহ মেঘনায় এ অববাহিকায় নিজাম বাহিনীর বন ও জলদস্যুপনায় জনজীবনে চরম ভোগান্তি নেমে এসেছে। সন্দ্বীপ ও হাতিয়ার চরাঞ্চলে দুই সপ্তাহের সরেজমিন অনুসন্ধানে দেখা গেছে নিজাম বাহিনীর উৎপাতে জেলে পারিবারসহ সাধারণ মানুষ দিশাহারা।

মেঘনার ‘জলদস্যু সম্রাট’ জাহাঙ্গীর মাঝি, নব্বা চোরা, বাশার মাঝি, মুন্সিয়া চোরা, কালা বাদশা, ইব্রাহীম ডাকাত, জয়নাল স্পিকার, সুমন বাহিনী, পিচ্চি খোকা, নাছির বাহিনী, মিয়া শিকদার ও গেস্যা ডাকাত অধ্যায় শেষ হওয়ার পরপরই নতুন করে শুরু হয়েছে নিজাম বাহিনীর এ অধ্যায়। এ বাহিনীর আধিপত্য শুধু হাতিয়া নয় মনপুরা, সন্দ্বীপ, লক্ষ্মীপুরের রামগতিসহ বিস্তীর্ণ উপকূলীয় এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে।

স্থানীয় জনগণের অভিযোগ, নোয়াখালী জেলার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তা ও গডফাদার হিসেবে পরিচিত আওয়ামী লীগ নেতা সাবেক সংসদ সদস্য মোহাম্মদ আলীই এখন দেখভাল করেন নিজাম বাহিনীকে।

জেলেদের অভিযোগ এ বাহিনীর হামলা, লুটপাট, হত্যা, চাঁদাবাজি, নির্যাতন, ডাকাতি ও জিম্মি করে মুক্তিপণ, নারী ধর্ষণ, চরদখলসহ নানা কর্মকাণ্ডে উপকূলীয় জেলে সম্প্রদায় ও সাধারণ ভূমিহীনরা এখন নিজাম বাহিনীর কাছে জিম্মি।

স্থানীয় জেলে ও ভূমিহীনরা জানায়, গত এক মাসে জলদস্যুরা এ অঞ্চল থেকে অন্তত শতাধিক ট্রলারসহ ৫ শতাধিক মাঝিমাল্লাকে চাঁদার দাবিতে অপহরণ করে পরে মুক্তিপণের বিনিময়ে ছেড়ে দেয়। আবার অনেককেই হত্যা করে নদীতে নিক্ষেপ করে। যার সংবাদ অজানাই থেকে গেছে দেশবাসীর।

হাতিয়া উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মাহিদুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, ‘৯০ দশকের প্রথম দিকে নদীভাঙনের কারণে হাতিয়া উপকূলে বয়ারচর, নলেরচর, ঢালচর, ক্যারিংচর, নঙ্গলীয়ারচরসহ বহু নতুন নতুন চর জেগে ওঠে। বনবিভাগ সেখানে ম্যানগ্রোভ বনায়ন করে। সে সময়ে ওই বনাঞ্চল দখল করে নেয় জল ও বনদস্যুরা। ম্যানগ্রোভ বন দখল করে সবুজ বেষ্টনী নিধন করে ভূমিহীনদের কাছে জমি বিক্রি শুরু করে দস্যুরা। এভাবে সৃষ্টি হয় উপকূলে দস্যু রাজত্ব। ’

ক্যারিং চরের স্থানীয় ভূমিহীনরা জানান, ২০১০ সালের ২২ নভেম্বর নঙ্গলীয়ারচরের ভূমিহীনরা ডাকাতিকালে নিজাম ডাকাত ও তার সহযোগী ৩৮ চিহ্নিত জলদস্যুকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করে। পুলিশ আটক জলদস্যুদের ওইদিন ভোররাতে জেলা সদর মাইজদি নেওয়ার পথে চরের চেয়ারম্যান ঘাটে এসে দস্যুদের ছেড়ে দেয়। তখন থেকে জলদস্যু নিজাম ডাকাতের উত্থান ঘটে।

হাতিয়ার সংসদ সদস্য ফজলুল আজিম এ বিষয়ে বাংলানিউজকে বলেন, ‘বর্তমান নোয়াখালির পুলিশ সুপার হারুন অর রশীদ হাজারী দস্যুদের ছেড়ে দেন। ’

বিষয়টি পুলিশ সুপার হারুন অর রশীদ মিথ্যা অভিযোগ হিসেবে উল্টো সংসদ সদস্যকে দস্যুতার জন্য দায়ী করেন।

তিনি বলেন, ‘সংসদ সদস্য রাজনীতির খাতিরে মিথ্যা তথ্য দেন। কিন্তু আমিতো সরকারের নিরপেক্ষ প্রশাসনের অংশ। কোনো কারণে কার ভোট কমবে এটা দেখার বিষয় আমার না। ’

নিজামের উত্থান

নিজাম ডাকাতের আদিনিবাস লক্ষ্মীপুর জেলার রামগতিতে। সে কয়েক বছর ধরে বসবাস করেছে হাতিয়ার বয়ারচরে। ২০০৩ সালে বন ও জলদস্যু নিধনের সময় সোলেমান কমান্ডারের দস্যুবাহিনীর সদস্য ছিল নিজাম ডাকাত। পরে নিহত চরের সম্রাট হিসেবে খ্যাত বাশার মাঝির সঙ্গে যোগ দিয়ে বিশ্বস্ততা  অর্জন করে। একপর্যায়ে নিজেই দস্যুদের দল গঠন করে। র‌্যাবের হাতে ২০১০ সালের ৬ জুন বাশার মাঝি নিহত হওয়ার পর ‘মুন্সিয়া চোরা’র সঙ্গে নিজামের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এ সময় নিজাম ডাকাতের সন্ত্রাসী কর্মকা-ের ব্যাপক প্রসার ও পরিচিতি ঘটে।

গত বছরের ৬ জুন নিজাম দলের ভাড়াটিয়া দস্যুদের হাতে নিহত হয় মুন্সিয়া চোরা। তারপর নিজাম ডাকাত মুন্সিয়া চোরার সহযোগীদের সংগঠিত করে ও তার বিপুল পরিমাণ অস্ত্রভাণ্ডার নিয়ে আরো শক্তিশালী হয়ে ওঠে। নিহত বাশার মাঝির কেরানি ও সেকেন্ড ইন কমান্ড তার প্রতিপক্ষ নাছিরকে সম্প্রতি চর এলাকা থেকে বিতাড়িত করে নিজেই দস্যুসম্রাট বনে যান নিজাম। পুরো চর ও নদী এলাকায় একক আধিপত্য কায়েম করে চরদখল ও চাঁদাবাজিসহ ব্যাপক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালাতে শুরু করে সে ও তার দল।

বাংলাদেশ সময়  : ১১৪৪ ঘণ্টা, মার্চ ১৫, ২০১২
সম্পাদনা: মাহমুদ মেনন, হেড অব নিউজ, চূড়ান্ত সম্পাদনা: জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।