ঢাকা, বুধবার, ২৮ মাঘ ১৪৩১, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২ শাবান ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

জলদস্যু সম্রাট এখন পৌর মেয়র, এমপিপুত্র বাহিনী প্রধান

রহমান মাসুদ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৫১ ঘণ্টা, মার্চ ১৮, ২০১২
জলদস্যু সম্রাট এখন পৌর মেয়র, এমপিপুত্র বাহিনী প্রধান

চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, ফেনী, লক্ষ্মীপুর ও ভোলার বিস্তীর্ণ চরাঞ্চল দেশের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন এক জনপদ। প্রকৃতির খেয়ালের ওপর ভর করে চলে এখানকার মানুষের জীবন-জীবিকা।

তার ওপর জলে-স্থলে দস্যুদের অতর্কিত হানা এখানকার মানুষকে রাখে চরম অনিরাপত্তায়। পুরোটাই এক সন্ত্রাসের উপকূল। এই বিস্তীর্ণ চরাঞ্চলে এক পক্ষকাল চষে বেড়িয়েছেন বাংলানিউজের সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট রহমান মাসুদ ও ফটো করেসপন্ডেন্ট উজ্জ্বল ধর। তুলে এনেছেন সন্ত্রাসের ওই জনপদের অনেক সচিত্র কাহিনী। রোববার চতুর্থ কিস্তি ....

সন্দ্বীপের বর্তমান পৌর মেয়র জাফর উল্লাহ টিটু এক সময় জলদস্যু বাহিনীর (টিটু বাহিনী) প্রধান ছিলেন। র‌্যাবের হাতে নিহত জলদস্যু সম্রাট বাসার মাঝি ছিল টিটুর নৌকার মাঝি। বর্তমান জলদস্যু সম্রাট নিজাম মাঝির সঙ্গেও সুসম্পর্ক আছে তার।

অভিযোগ আছে সন্দ্বীপের অনেক বন্দির মুক্তি ও মুক্তিপণ লেনদেনের মধ্যস্থতা করেন পৌরমেয়র। এছাড়া মেয়র ও তার ভাই আকতার হোসেন বাবুর বিরুদ্ধেও আছে আলমগীর পাহলবীকে প্রকাশ্য দিবালোকে গুলি করে খুন করার অভিযোগ। আকতার হোসেন বাবু বর্তমানে সন্দ্বীপের ডিস ব্যবসার নিয়ন্ত্রক।

স্থানীয়দের মতে নিজাম বাহিনীর অধিকাংশ অস্ত্রের যোগান দাতা এই পৌর মেয়র। এছাড়াও তার কাছে এখনো প্রচুর অস্ত্র আছে বলেও সাধারণ মানুষের ধারণা।

স্থানীয়দের অনেকেই বাংলা নিউজকে জানান, বর্তমানে জলদস্যুতার কাজ আর তেমন প্রকাশ্যে করেন না মেয়র জাফর উল্লাহ টিটু। তবে টিটুর নিয়ন্ত্রণে এখনো রয়েছে সন্দ্বীপের ৫টি মাছঘাট। গত তিন বছর তিনি বিনা টেন্ডারে এসব ঘাট চালাচ্ছেন বলে অভিযোগ আছে। এছাড়া সন্দ্বীপের মাছ পরিবহন, খেয়া ঘাট, বোট ও দাদন ব্যবসারও নিয়ন্ত্রক এই পৌর মেয়র।

অন্যদিকে স্থানীয় বিএনপি নেতা এবং সংসদ সদস্য মোস্তফা কামাল পাশার এক ছেলে আরিফ বিল্লাহ এখন রহমতপুর এলাকার জলদস্যু বাহিনীর প্রধান।

তবে এ বিষয়ে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করেছেন মেয়র জাফর উল্লাহ টিটু।

বাংলানিউজকে তিনি বলেন, ‘এ সব ধারণাপ্রসুত বর্ণনা। এর কোনো প্রমাণ নেই। ’

তিনি বলেন, ‘এক সময় জেলে নৌকা আটক হলে সবাই আমার কাছে আসত। আমি জলদস্যুদের ফোন করে বলতাম- ভাই গরিব মানুষ। এদের ছেড়ে দাও। এতে কাজ হতো। তারা ছেড়ে দিত। ’

টিটু বলেন, ‘এরপর শতশত মানুষ আমার কাছে আসতে থাকে এবং বাইরে প্রচার হতে থাকে আমিও জলদস্যু। ’

এ দিকে সন্দ্বীপ পৌরসভা এলাকাকে জলদস্যু ও সন্ত্রাসীদের আস্তানা হিসেবে অভিযোগ করেছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য মোস্তফা কামাল পাশা।

বাংলানিউজকে তিনি বলেন, ‘উপজেলা চেয়ারম্যান ও স্থানীয় উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি তার আত্মীয় ও একজন জলদস্যু সম্রাটকে (টিটু বাহিনীর প্রধান জাফর উল্লাহ টিটু) সাজানো নির্বাচনের মাধ্যমে পৌর মেয়র নির্বাচিত করেছেন। ’

তিনি বলেন, ‘আমরা রাজনীতিবিদরা নিজেরা মাফিয়াচক্রে জড়িয়ে গেছি। বিবেক সোজা করে দাঁড়াতে পারছি না। প্রশাসনকে কিছু বলতে পারছি না। ওসি সাহেব, এসপি সাহেব, ডিসি সাহেব কথা বললেই বিব্রত বোধ করেন। ’

এ বিষয়ে মেয়র জাফর উল্লাহ টিটু বলেন, ‘ওনার (এমপি কামাল পাশা) সঙ্গে তো আমার সব সময় দেখা হয়। কথা হয়। তিনি প্রমাণ সহকারে বলুক। ’

সন্দ্বীপের উপজেলা চেয়ারম্যান মাস্টার শাজাহান মিয়া এ বিষয়ে বাংলানিউজকে বলেন, ‘এমপি সাহেবের চারদলীয় শাসন আমলে সন্দ্বীপে কোনো আওয়ামী লীগের মানুষ থাকতে পারেনি। এখন তারা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করছে। এখানে কোনো সন্ত্রাসী নাই। ’

এছাড়াও সন্দ্বীপে বর্তমানে অবস্থান করছেন জাসু ওরফে জাইস্যা নামের এক কুখ্যাত জলদস্যু। যে এক সময়ে নাসির কেরানীর কমান্ডার হিসেবে কাজ করত।

তবে এখন সন্দ্বীপের বাহিনীগুলোকে খেয়ে ফেলেছে নিজামবাহিনী। সন্দ্বীপের মাকসুদ বাহিনী মীর সরাইয়ের ডোম খাল এলাকা থেকে বিপুল অস্ত্র ও লোকবল জোগাড় করে জাহাইজ্জার চর দখলে আসে। এ সময় নিজাম বাহিনী চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে মাকসুদসহ ৪৬ জনকে খুন করে ও অস্ত্র লুট করে।

তবে স্থানীয় সাংবাদিকদের দাবি এখানে ঘটে যাওয়া ৯০ শতাংশ সংবাদই থাকে গণমাধ্যমের আড়ালে। নিজের জীবন বাঁচাতেই গণমাধ্যমকর্মীরা হজম করে ফেলেন এসব সংবাদ। আবার কখনো কখনো গহীন জঙ্গল ও জনমানবহীন সমুদ্রের বুকে ঘটে যাওয়া ঘটনার সংবাদ থেকে যায় অজানাই।

সন্দ্বীপের বাংলাবাজার এলাকার ধূপের খাল এখন দখলে আছে কুখ্যাত দিদার বাহিনী ও আকবর বাহিনীর। চট্টগ্রাম থেকে এ এলাকায় অবাধে ড্রাগ পরিবহন হয়।

মাইটভাঙ্গা এলাকার জলদস্যুদের নিয়ন্ত্রণ করে স্থানীয় চেয়ারম্যান মিজান ও বাউরিয়া এলাকা নিয়ন্ত্রণ আছে বাইস্যা রহিমের।

রহমতপুরে আছে বাইন্যে টিটু, মাইন উদ্দিন প্রকাশ মাইন্যে, ফোকরান উদ্দিন রিজভী, সাবেক স্বারাষ্ট্রমন্ত্রী খ্যাত রহমত পুরের বর্তমান চেয়্যারম্যান মামুন, বর্তমান সংসদ সদস্য কামাল পাশার মেজ ছেলে আরিফ বিল্লাহ।

সারিকাতের সোহরাব বাহিনী নিয়ন্ত্রণ করে সন্দ্বীপের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল।

এসব বাহিনী কেবল সমুদ্র বা উপকূলে তাদের তাণ্ডব চালিয়েই ক্ষান্ত হয় না। প্রবাসী অধ্যুষিত এ দ্বীপ উপজেলায় ব্যবসা-বাণিজ্য, পরিবহনসহ সকল কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। এদের অত্যাচারে সন্দ্বীপের কোনো মানুষই এখন আর তাদের সন্তান-সম্পত্তি সন্দ্বীপে রাখতে চান না। যেতেও চান না প্রিয় মাতৃভূমিতে।

এমনকি এদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে মুখ খুলতে নারাজ স্থানীয় বাসিন্দারাও। তাদের অভিমত, মুখ খুললেই রাতের আঁধার, এমনকি দিনের আলোতেও অত্যাচার, খুন, গুম, ধর্ষণ, নারী নির্যাতনের মতো ঘটনা ঘটায় দস্যুরা।

স্থানীয়রা জানায়, সন্ত্রাসী ও জলদস্যুরা সন্দ্বীপ এবং এর উপকূলীয় এলাকায় অপরাধের ঘটনা ঘটিয়ে চলে যায় ১৮ কিলোমিটার দূরের উড়িরচরে। এখানকার কিছু অঞ্চল নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের অংশ হওয়ায় নির্বিঘ্নে গা ঢাকা দেওয়া সহজ হয়। তাছাড়া উড়িরচরের খোকা বাহিনীর প্রধান খোকাসহ প্রায় সবাই সন্দ্বীপের কালাপানিয়া ইউনিয়ন ও ভেঙে যাওয়া আমিরাবাদ ইউনিয়নের বাসিন্দা হওয়ায় এখানে আশ্রয় নেওয়াও সহজ।

মুক্তি চায় সন্দ্বীপবাসী
দেশের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপ উপজেলা সন্দ্বীপের জনসংখ্যা প্রায় ৫ লাখ। এর প্রায় দুই লাখই প্রবাসী। যার সিংহভাগই ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত রাষ্ট্র ও যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী। নদী ও সাগরের ভাঙন-প্রবন এ দ্বীপের অধিকাংশই এখন সাগরের জলে হারিয়ে গেছে। তবু অদম্য মানুষগুলো সব হারিয়েও বাঁচার আশা ছাড়েনি। তারা পাড়ি জমিয়েছে চট্টগ্রামের হালিশহর, ঢাকাসহ দেশের নানা প্রান্তে। এসব মানুষ শিকড়ের টানে ফিরতে চায় প্রিয় মাতৃভূমিতে। কিন্তু সন্ত্রাস আর জলদস্যুর উৎপাতে তারা অসহায়।

সন্দ্বীপের সংসদ সদস্যের ভাষ্যমতে,  দেশে প্রবাসীদের কাছ থেকে যে রেমিট্যান্স আসে তার ১১ ভাগই আসে সন্দ্বীপে। অথচ এখানকার মানুষ সবদিক থেকে অবহেলিত।

কয়েকজন স্কুলশিক্ষক জানালেন, একদিকে প্রকৃতি যেমন গ্রাস করছে সন্দ্বীপকে, অন্যদিকে জলদস্যুতা ও সন্ত্রাস ম্রিয়মান করে দিচ্ছে সন্দ্বীপবাসীর সাফল্যের ইতিহাস।

বাংলাবাজার এলাকার পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধে আশ্রয় নিয়েছে সাগরে বসতবাড়ি হারানো দেড় হাজার জেলে পরিবার। গভীর সাগরের বুকে মাছ ধরাই তাদের একমাত্র পেশা। কিন্তু গত দেড় মাস ধরে তারা সাগরে যেতে পারছে না জলদস্যুর ভয়ে। এমনকি সন্দ্বীপে প্রবেশের ঘাটগুলোর নিয়ন্ত্রণ ও এসব সন্ত্রাসী জলদস্যুর হাতে। এখন নতুন ব্যাধি হিসেবে দেখা দিয়েছে মাদকের ব্যবহার। ধুপেরখাল ঘাট, সোয়াখালি ঘাট, গুপ্তচরা ঘাট দিয়ে অবাধে আসছে হেরোইন, ফেনসিডিল, মদ ইত্যাদি।

ফখর ইসলাম, মোহাম্মদ শাহাবুদ্দীন, সুফিয়ান, মহসিন, নাজিম উদ্দিন আলম, আজিজ সওদাগরদের মতো অনেকেই জানালেন, জেলেদের মধ্যেই আছে জলদস্যুদের এজেন্ট। এছাড়া সচ্ছল ব্যক্তি ও জনপ্রতিনিধিরাও কাজ করেন জলদস্যুদের এজেন্ট হিসেবে।

তারা বলেন, ‘কোস্টগার্ডকে এসব বললে কোনো কাজ হয় না। অনেক সময় কোস্টগার্ডের সামনেই নৌকা ধরে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটে। তখন কোস্টগার্ড উল্টো জেলে নৌকার লাইসেন্স পরীক্ষার নামে সময়ক্ষেপণ করে দস্যুদের পালিয়ে যেতে সহায়তা করে। ’

স্থানীয় সংসদ সদস্য মোস্তফা কামাল পাশা ও সন্দ্বীপ উপজেলা চেয়ারম্যান মাস্টার শাজাহানের অভিযোগ, ‘শুনেছি প্রশাসন ও কোস্টগার্ড জলদস্যুদের সহায়তা করে। ’

এ বিষয়ে কোস্টগার্ডের চট্টগ্রাম অঞ্চলের আঞ্চলিক প্রধান ক্যাপটেন জাবেদ ইকবাল বাংলানিউজকে বলেন, ‘এ অঞ্চলে কে জলদস্যু আর কে সাধারণ জেলে তা বোঝা খুব কঠিন। তাছাড়া সব সময় জেলেরাও সঠিক তথ্য দেয় না। জলদস্যুদের সনাক্ত করতেই লাইসেন্স পরীক্ষা করা হয়। ’

তিনি বলেন, ‘র‌্যাবকে যে ধরনের ক্ষমতা দেওয়া আছে তাতে তারা যেভাবে অভিযান চালাতে পারে, আমরা সেভাবে পারি না। তবে সমন্বিত অভিযানের মাধ্যমে জলদস্যু দমনের চেষ্টা চলছে। ’

তিনি বলেন, ‘কোস্টগার্ড অনেক সময় সোর্স ব্যবহার করে। সোর্স হয়ত জলদস্যু হতে পারে। কিন্তু তাদের নিয়ে যখন সবার সামনে যাওয়া হয়, তখন তো কেউ বিষয়টি নিয়ে মুখ খোলেন না। ’

এ বিষয়ে সকলের সাহযোগিতা চান তিনি।

অত্যাচারের কাহিনী প্রধানমন্ত্রীকে জানাতে পারেননি সন্দ্বীপবাসী
নিজেদের এ দুঃসহ জীবন যুদ্ধ ও অত্যাচারিত জীবনের কথা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জানাতে পারেননি সন্দ্বীপবাসী। ২২ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী সন্দ্বীপ এলে বিষয়টি তুলে ধরার কথা হয় শতধা বিভক্ত এ উপজেলা আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাদের মধ্যে। কিন্তু দলের স্থানীয় প্রভাবশালীরা এ বিষয়ে বিরোধী অবস্থান নেওয়ায় প্রধানমন্ত্রীর শোনা হয়নি এ দ্বীপবাসীর চাপা কান্না।

সন্দ্বীপ উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মাস্টার শাজাহান মিয়া বাংলানিউজকে বলেন, ‘এ বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীকে বলা হয়নি। ’

তিনি বলেন, ‘সব বিষয় কি প্রধানমন্ত্রীকে বলা যায়! তাছাড়া এখানে তো প্রধানমন্ত্রী থাকবেন না। তিনি বললেই তো সব কিছুর সমাধান হয় না। ’

উপজেলা চেয়ারম্যান বলেন, ‘জলদস্যুদের মূল আস্তানা জাহাইজ্জার চর ও উড়িরচর। এখানে বহিরাগতরাই দস্যুতা করে। ’

বাংলাদেশ সময় : ১৪১৭ ঘণ্টা, মার্চ ১৮, ২০১২

সম্পাদনা: জাকারিয়া মন্ডল, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।