ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

ভূমিহীন হয়েও ‘আইনি জালে’ বাঁধা সরকারি সহায়তা!

শফিকুল ইসলাম খোকন, উপজেলা করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৫৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৫, ২০২২
ভূমিহীন হয়েও ‘আইনি জালে’ বাঁধা সরকারি সহায়তা!

পাথরঘাটা (বরগুনা): সারিবদ্ধ বসত ঘর। শিশুরা খেলাধুলা করছে সমানতালে।

গৃহিনীরা সংসারের কাজে ব্যস্ত। আছে পুকুর, জামে মসজিদ, তারপরও যেন কিছুই নেই। ভূমিহীন হয়েও বর্তমান সরকারের সহযোগিতা পাচ্ছেন না তারা।  

‘আইনি জালে’  বাঁধা থাকায় সরকারি সহায়তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে পদ্মা গ্রামের জেলে পল্লীর যমযম আবাসনের ২৪ পরিবার।  

ওই আবাসনে গিয়ে দেখা যায়, ২০০৭ সালে সিডরে ভূমিহীন হয়ে পড়া ৩৫ পরিবারকে এক একর ৭০ শতাংশ জমিতে পুনর্বাসন করা হয়। আর ৩০ শতাংশ জমি জামে মসজিদের নামে দেওয়া হয়। বরগুনা জেলার পাথরঘাটা উপজেলার পদ্মা এলাকায় ‘ডিসকভার ইসলাম সেন্টার বাহরাইন’ এর সহযোগিতায় ‘যমযম বাংলাদেশ, সিলেট’ কর্তৃক নির্মিত ‘শেখ আব্দুর রহিম আল-কুহাজী’ গ্রামে শর্ত সাপেক্ষে ওই প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব প্যাডে এ বরাদ্দ দেওয়া হয়। সেই থেকেই ভূমিহীন পরিবারগুলো বসবাস করতে থাকে। এখানে প্রতি পরিবার প্রধান মৎস্য শ্রমিক (জেলে)। তবে পরে ১১টি পরিবার অন্যত্র চলে গেছে। এখন ২৪ জেলে পরিবার এখানে থাকে।  

এখানকার ঘরগুলো জরাজীর্ণ হয়ে বসবাসের অনুপযোগী পড়েছে। ওই প্রতিষ্ঠানের দেওয়া শর্তানুযায়ী মেরামতসহ সব কাজের দায়িত্ব উপকারভোগীদের। ফলে বরাদ্দ দেওয়ার পর থেকে সংস্কারের দিকে কর্তৃপক্ষের কোনো‌ নজর নেই। আবার ঘর মেরামত বা নতুন করে গড়ার সামার্থ্য নেই দরিদ্র জেলেদের। একটি ঘর দুই পরিবারের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়। নতুন ঘর পেয়ে গৃহহীন মানুষগুলো স্বাভাবিক জীবন-যাপন শুরু করলেও সেসব ঘর এখন বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। কারো ঘরে টিনের চালা ফুটো, কারো বা দরজা জানালা ভাঙা। এসব ঘর সংস্কার না হওয়ায় বর্ষায় পানি পড়ে আর শীতের সময় ঠাণ্ডা বাতাসে কষ্ট পেতে হচ্ছে, পাশাপাশি জোয়ারের পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।

বাসিন্দা সোহরাব শিকদার বলেন, আমরা এমনিতেই ভূমিহীন, সিডরের আগে থেকেই ভূমিহীন হওয়ায় এ আবাসনের আমাদের থাকতে দিয়েছে। কিন্তু আইনগতভাবে আমাদের নামে কোনো দলিল নেই। যার কারণে এ জমির বিপরীতে সরকারি কোনো সহায়তা পাচ্ছি না। আগে অনেকের কাছে গেলেও আইনের জটিলতা দেখিয়ে অপারগতা প্রকাশ করেন তারা।

তিনি আরও বলেন, আমরা সবাই জেলে, খুব গরিব। ঘড়গুলো খুবই জরাজীর্ণ। শীতেও কষ্টে দিন কাটাতে হয়। বহু বছর ধরে জরাজীর্ণ ঘরে বসবাস করছি, মেরামত করার সামর্থ্য আমাদের নেই। সরকার বর্তমানে যে পাকা ঘর দিচ্ছে, এসব ঘর আমাদের দেওয়া হলে একটু ভালোভাবে থাকতে পারতাম।

মুজিববর্ষে আশ্রয়ণ:
মুজিববর্ষে “বাংলাদেশের একজন মানুষও গৃহহীন থাকবে না” প্রধানমন্ত্রীর এ নির্দেশনা বাস্তবায়নে আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের সকল ভূমিহীন ও গৃহহীন মানুষের বাসস্থান নিশ্চিতকল্পে সেমিপাকা একক গৃহ নির্মাণের কর্মসূচি হাতে নেয়া হয় । সমগ্র দেশের সকল ভূমিহীন-গৃহহীন মানুষকে মুজিববর্ষে জমিসহ সেমিপাকা ঘর দেয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়।

এ কর্মসূচির উপকারভোগী:
‘ক‘ শ্রেণির পরিবারঃ সকল ভূমিহীন, গৃহহীন, ছিন্নমূল, অসহায় দরিদ্র পরিবার।
‘খ‘ শ্রেণির পরিবারঃ সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ জমির সংস্থান আছে কিন্তু ঘর নেই এমন পরিবার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অঙ্গীকার অনুযায়ী, "বাংলাদেশে কেউ গৃহহীন, ভূমিহীন এবং ঠিকানাবিহীন থাকবে না। " উপকূলীয় বরগুনা জেলাও এর বাইরে নয়।

প্রক্রিয়ায় মুজিববর্ষে প্রথম পর্যায়ে ২০২১ সালের  ২১ জানুয়ারি  ৬৩ হাজার ৯৯৯ টি পরিবারকে  জমির মালিকানাসহ ঘর প্রদান করা হয় এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে ২০২১ সালের ২০ জু ৫৩ হাজার ৩৩০টি পরিবারকে অনুরূপভাবে গৃহ প্রদান করা হয়। বর্তমানে তৃতীয় পর্যায়ে নির্মাণাধীন রয়েছে আরো ৬৫ হাজারেরও অধিক ঘর। মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে এখন পর্যন্ত ১ লাখ ৮৩ হাজার ৩টি পরিবারকে জমিসহ সেমিপাকা একক ঘর প্রদান করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর দৃঢ় প্রত্যয়ের প্রমাণ রেখেছেন। ভূমিহীন ও গৃহহীনদের জমি ও গৃহ প্রদান ইতিহাসে প্রথম ও সর্ববৃহৎ উদ্যোগ। রাষ্ট্রের পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীকে মূলস্রোতে তুলে আনার জন্য সম্পূর্ণ বিনামূল্যে বাসগৃহ নির্মাণ করে জমির চিরস্থায়ী মালিকানা দেওয়া হচ্ছে। জমি কেনার জন্য স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়ার উদাহরণ বিশ্বে কয়েকটি দেশে পাওয়া যায়, কিন্তু বিনাম্যল্য ঘরসহ জমির মালিকানা দেয়ার ঘটনা বাংলাদেশেই প্রথম।

প্রকল্পের আওতায় ২০২১-২০২২ পর্যন্ত ১ লাখ ৮৫ হাজার ১২৯টি বাড়ি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। প্রথম পর্যায়ে ২০২১ সালের ২৩ জানুয়ারি, ৬৩ হাজার ৯৯৯ গৃহহীন ও ভূমিহীন পরিবার তাদের মাথার উপর ছাদ পায়। আর গত বছরের ২০ জুন আশ্রয়ণ প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ে ৫৩ হাজার ৩৩০টি পরিবার ঘর পায়।  

আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের তৃতীয় পর্যায়ে সরকার ঘরগুলোকে অধিকতর টেকসই ও জলবায়ু সহিষ্ণু করে গড়ে তুলতে ঘরগুলোর নকশা পরিবর্তন করেন। এতে ঘরগুলোর নির্মাণ খরচ বেড়ে যায়। আর এজন্যই এখন গৃহহীন ও ভূমিহীন মানুষরা দুই শতাংশ জমির ওপর আরও উন্নতমানের টিন-শেডের আধা-পাকা ঘর পাবে।

ঘরগুলোকে অধিকতর টেকসই করে গড়ে তোলায় প্রতিটি ঘরের নির্মাণব্যায় ১ লাখ ৯১ হাজার টাকা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২ লাখ ৫৯ হাজার ৫০০ টাকায় উন্নীত করা হয়। সরকার ঘরগুলোকে অধিকতর টেকসই করে নির্মাণ করতে মজবুত কড়ি কাঠ, পাথরের সর্দল ও রি-ইনফোর্স কংক্রিট কলাম (আরসিসি) পিলার ব্যবহার করা হয়েছে।

এদিকে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলা বরগুনায় জলবায়ু পরিবর্তন ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলছে। ঘন ঘন দুর্যোগের সম্মুখীন হচ্ছেন এ জেলার মানুষ। বঙ্গোপসাগরের উপকূল ঘেঁষে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এ সংকটকে আরও ঘনীভূত করছে। নদী ভাঙা, গড়া, পানির লবণাক্ততাও প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। উপকূলের অনেক এলাকা এখন এ সমস্যায় আক্রান্ত। অতিরিক্ত গরম ও জলবায়ু পরিবর্তনের আরেক ধরনের প্রভাব। এতে মানুষের জীবন-জীবিকা সংকটের মুখে পড়েছে। এসব লোকালয়ের শিশুদের পাশাপাশি বড়দেরও ঝুঁকি বেশি।  

পাথরঘাটা সদর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য আবু বকর সিদ্দিক বলেন, নদীর পাড়ের অসংখ্য মানুষ ভূমিহীন। কিছু ভূমিহীনকে পুর্নবাসন করা হয়েছে। তবে যমযম আবাসনের বাসিন্দারা আইনি জটিলতার কারণে সরকারি সহায়তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। আমরা চেষ্টা করছি, তাদের প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর দিতে।

পাথরঘাটা সদর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আলমগীর হোসেন বলেন, এ জমি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নামে হওয়ায় জটিলতা রয়েছে, ওই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে লবিং করার চেষ্টা করছি, যাতে অন্তত মানবিক কারণে সরকারি ঘর পেতে পারেন ভূমিহীনরা।

পাথরঘাটা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোস্তফা গোলাম কবির বলেন, আইনি জটিলতা কাটিয়ে উঠতে পারলে তাদের পুনর্বাসন করা সম্ভব।

এ বিষয়ে বরগুনা জেলা প্রশাসক মো. হাবিবুর রহমান বলেন, তারা যদি প্রকৃতপক্ষেই ভূমিহীন হন, তাহলে তারা অবশ্যই পুনর্বাসনের সহায়তা পাবেন। তাদের পাথরঘাটা উপজেলা নির্বাহী অফিসারের (ইউএনও) কাছে আবেদন করতে বলেন, ইউএনও বিষয়টি আমাকে অফিসিয়ালি জানাবেন।

বাংলাদেশ সময়: ১৩৪৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৫, ২০২২
এসআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।