ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

উপকূল থেকে উপকূল

জলবায়ু পরিবর্তনে ওলট-পালট জেলে জীবন

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১১৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০১৪
জলবায়ু পরিবর্তনে ওলট-পালট জেলে জীবন ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে দারিদ্র্যের শেকলে বাঁধা উপকূলের জেলে জীবন। সমুদ্রে দস্যু আর দুর্যোগের আতংক কাটিয়ে কিনারে ফিরতে না ফিরতেই পড়তে হয় দাদনদারদের রোষানলে।

হিসেব বুঝিয়ে দিতে হয় কড়ায়-গণ্ডায়। শুন্য হাতেই ফিরতে হয় ঘরে। দিনে আনা দিনে খাওয়া জেলে পরিবারের অবস্থা বদলায় না। জীবনভর জেলে পেশায় থেকেও এক টুকরো সম্পদ গড়তে পারে না। উপকূল ঘুরে জেলেজীবনের এইসব অনুসন্ধান করেছে বাংলানিউজ। ‘জেলেজীবনে দুঃখ গাঁথা’ শীর্ষক সাত পর্বের ধারাবাহিকের পঞ্চম পর্ব

উপকূল অঞ্চল ঘুরে এসে: জলবায়ু পরিবর্তন ওলট-পালট করে দিচ্ছে উপকূলের জেলেদের জীবন। ক্রমাগত পরিবর্তন সরাসরি তাদের জীবিকায় প্রভাব ফেলছে। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের তাণ্ডব, জোয়ারের তীব্রতা, নদী-ভাঙন, নদীতে মাছ কমে যাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে বহু জেলে পেশা ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। অথচ এই পেশা জেলেদের জীবিকার একমাত্র অবলম্বন। বিকল্প জীবিকা কিংবা এদের নিরাপত্তায় বিশেষ কোনো ব্যবস্থা নেই।

ভোলা, লক্ষীপুর, নোয়খালী, পটুয়াখালীর নদী ও সাগর মোহনায় মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহকারী জেলেদের সঙ্গে কথা বলে তাদের সংকটের চিত্র উঠে আসে। জেলেদের সঙ্গে আলাপে বাংলানিউজ জানতে পারে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে মাছধরার ওপর নির্ভরশীল এই পরিবারগুলো প্রতিনিয়ত তাদের অবস্থান বদল করছে। কখনো নদীর ভাঙনে, আবার কখনো ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে এদেরকে বাড়িছাড়া হতে হয়। নদীর তীরে বসবাসকারী অধিকাংশ জেলে পরিবার বছরে একাধিকবার বসতি বদলাতে বাধ্য হয়।

একাধিক প্রতিষ্ঠানের গবেষণা তথ্যে জানা যায়, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে জেলেদের জীবিকার ওপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে। দুর্যোগ এবং নদীতে মাছের অপ্রতূলতার কারণে জেলেরা উপার্জনে অক্ষম হয়ে পড়ে। অনেক সময় ঝড়ের কবলে পড়ে জাল-নৌকা সবই হারিয়ে ফেলে তারা। অথচ অনেকে এই জাল-নৌকা সংগ্রহ করেছেন ধারদেনা করা টাকায়। ফলে এদের ঋণের বোঝাও বাড়ছে।

নোয়াখালীর হাতিয়া বাজার থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে টাংকিঘাটের জেলে ইউসুফ আলী বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে জীবিকার ধরণ বদলে গেছে। ঝড়-বন্যায় এখন আর নদীতে বেশি সময় মাছ ধরা যায় না। ঝড়ের সিগন্যাল পেলে মাছধরা ফেলে কিনারে চলে আসতে হয়। আবার কখনো কখনো নিম্ন চাপের সংকেত রয়েছে বলে জাল-নৌকা নিয়ে নদীতে যাওয়া সম্ভব হয় না।

একই এলাকার জেলে মোহাম্মদ আলী জানালেন, ঝড়-জলোচ্ছাসে নদীর পাড়ে বাসবাসকারী এই জেলের জীবন ওলট-পালট করে দেয়। বাড়িঘরে পানি ওঠে। প্রবল বাতাসে ঘর উড়িয়ে নেয়। তখন মাছধরা তো দূরের কথা, ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র ছুটতে হয়। তাছাড়া নদীতে মাছও আগের চেয়ে অনেক কমে গেছে।

নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার বয়ারচরের টাংকিঘাট। মেঘনার তীরে ঝড়-ঝঞ্জা বিক্ষুব্ধ জনপদে শত শত জেলের বসবাস। মেঘনা নদী আর সমুদ্রে জাল ফেলা, জালে ওঠা মাছ বাজারে বিক্রি করা, এভাবেই চলে জীবিকা। পরিবার পরিজন নিয়ে বছরের পর বছর তারা এভাবেই জীবিকা নির্বাহ করছে। জলবায়ু পরিবর্তনে নানামূখী দুর্যোগে স্বাভাবিক জীবিকায় সংকট দেখা দিয়েছে।

নোয়াখালীর হাতিয়া বাজার থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে টাংকিঘাট। মেঘনা থেকে ছোট্ট খাল ঢুকেছে ঘাটের কিনার ঘেঁসে। পড়ন্ত বিকেলে মাছধরা নৌকাগুলো খালের ভেতরে অলস পড়ে রয়েছে। জেলেরা এই সময় জাল মেরামতসহ দরকারি কাজগুলো সেরে নিচ্ছেন। এখানে অনেক জেলে জানান, নদীতে মাছ ধরতে এখন পদে পদে বিপদ। জীবিকা নির্বাহ করাই কষ্টকর হয়ে পড়েছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রবল জোয়ার ও জোয়ারের উচ্চতা বেড়েছে বলে লক্ষ্য করেন ভোলার দৌলতখান, লালমোহন ও বোরহানউদ্দিনের জেলেরা। মেঘনা তীর ধরে তাদের লণ্ডভণ্ড বসতি দেখেই তা স্পষ্ট বোঝা যায়। বারবার মেঘনা থেকে উপচে পড়া জোয়ারের পানি বাঁধ লাগোয়া জেলে বসতির জীবনধারা বদলে দিচ্ছে।

জেলেরা জানান, দিনে দিনে পানির চাপ বাড়ছে, সেই সঙ্গে বাড়ছে পানি জমে থাকার স্থায়িত্বকাল। জোয়ারের পানির প্রবল চাপে ভাঙণের তীব্রতা যেমন বাড়ছে, তেমনি নতুন নতুন নালা তৈরি করে গ্রামের পর গ্রাম প্লাবিত করছে। যেসব গ্রামে আগে কখনো পানি ঢুকেনি সেসব স্থানে পানি ঢুকছে অনায়াসে।

সূত্রগুলো বলছে, জোয়ারের পানি বৃদ্ধি ও ঘন ঘন জলোচ্ছ্বাসের কারণে এলাকার অন্তত লক্ষাধিক মানুষ পেশা বদলাতে বাধ্য হয়েছে। গত বছরের মে মাস থেকে জোয়ারের চাপ বেড়েছে। জোয়ারের পানি ঢুকে তা বাড়িঘর, ফসলি মাঠ, স্কুলের আঙিনা, ডোবা নালায় জমে থাকে দীর্ঘদিন। ফলে জোয়ার শেষ হলেও মানুষের দুর্ভোগ শেষ হয় না।      

পায়ে হেঁটে মেঘনা তীরের ধ্বংসপ্রায় বেড়িবাঁধ দিয়ে দৌলতখান উপজেলার ভবানীপুর থেকে সৈয়দপুর যেতে বিপন্ন চিত্র চোখে পড়ে। প্রায় তিন কিলোমিটারের এই পথে মানুষের দুর্ভোগের শেষ নেই। জোয়ারে পানিতে নতুন এলাকা প্লাবিত হওয়ার কথা জানালেন এলাকার প্রবীণ ব্যক্তিরা। তাদের মতে, আগে জোয়ার এলেও তাতে এতটা সমস্যা সৃষ্টি করেনি। এখন জোয়ারই প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরসঙ্গে ভাঙন তো রয়েছেই।

গত বছর ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার বড় মানিকা ও পক্ষিয়া, দৌলতখানের সৈয়দপুর এবং ভোলা সদরের ধনিয়া, কাচিয়া ও পূর্ব ইলিশা ইউনিয়নের প্রায় ৩ লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি ছিল প্রায় ৪ মাস। এসময় মানবেতর জীবন কেটেছে জোয়ার কবলিত এলাকার মানুষদের। বোরহানউদ্দিন উপজেলার অনেক অংশ নতুন করে প্লাবিত হয়।

এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, লাগাতার জলাবদ্ধতা ও জোয়ার-ভাটার কারণে ভাঙন এলাকায় নতুন খালের সৃষ্টি হয়েছে। বোরহানউদ্দিনের বড় মানিকা ৭ নম্বর ওয়ার্ডের বাদশা মিঝির ছেলে আবদুল মান্নান জানান, গত বছর মে মাসের পূর্ণিমার জোয়ারে একদিনে আলিমউদ্দিন বাজারের দক্ষিণ পাশের জমির উপর দিয়ে প্রায় ২০০ গজ প্রশস্ত আধা কিলোমিটার লম্বা একটি খালের সৃষ্টি হয়েছে। দিনের পর দিন খালটি দীর্ঘায়িত হচ্ছে। ভোলা সদরের কাছিয়া ঘাটের পূর্বদিকে সরু একটি নালা খালের রূপ নিয়েছে। এরকম অসংখ্য নতুন নতুন খালের সৃষ্টি হয়েছে এলাকায়।

দৌলতখান ও ভোলা সদরের কয়েকটি এলাকার লোকজন জানান, জোয়ার আর ভাঙনে জেলেসহ বহু মানুষ পেশা বদল করতে বাধ্য হয়েছে। বহু মানুষ কাজের সন্ধানে শহরে ছুটেছে। নদীভাঙন নিয়ে কর্মরত বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কোস্ট ট্রাস্টের দাবি, ভাঙন এলাকায় অন্তত লক্ষাধিক লোকের পেশা বদল হয়েছে। এরা এলাকার বিভিন্ন বেড়িবাঁধে আশ্রয় নিয়েছে কিংবা বাইরে কোথাও কাজের সন্ধানে গেছে।

সিরিজের পরবর্তী পর্ব:
ছয়: বিধবা জেলে বঁধূদের জীবনে নেমে আসে অন্ধকার;
সাত: জেলে পরিবারের শিশু, ষোলতেই দক্ষ মাঝি 

বাংলাদেশ সময়: ০১৩৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।