চরমোন্তাজ, রাঙ্গাবালী, পটুয়াখালী ঘুরে এসে: নদীভাঙ্গনে ম্যানগ্রোভ বনের বহু গাছ নদীগর্ভে হারাচ্ছে। সমুদ্রসহ সংশ্লিষ্ট নদীর পানিতে লবণের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় বনের গাছ লালচে রূপ নিয়েছে।
দেশের সর্বদক্ষিণে পটুয়াখালী জেলার দ্বীপ ইউনিয়ন চরমোন্তাজের সংরক্ষিত বনাঞ্চল রক্ষার চিত্রটা এমনই। নদীর বাঁকে বাঁকে লঞ্চ-ট্রলারে যেতে যেতে বাংলানিউজের চোখে পড়ে উপকূলে সবুজ প্রাকৃতিক প্রাচীর ধ্বংস হওয়ার নানান দৃশ্য। এলাকার মানুষ শঙ্কিত প্রলয়ঙ্করী দুর্যোগের কথা ভেবে। বন উজাড় হয়ে গেলে এই অঞ্চল বড় দুর্যোগের হাত থেকে বাঁচানো কঠিন হবে।
বন বিভাগের চরমোন্তাজ রেঞ্জের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে বন উজাড় হওয়ার দৃশ্য চোখে পড়ে। এই এলাকায় নতুন নতুন বাঁধ হয়েছে। সে বাঁধে লাগানো হয়েছে হাজার হাজার গাছের চারা। কিন্তু সেই চারা সংরক্ষণের উদ্যোগ খুব একটা চোখে পড়েনি। বন বিভাগের কর্মকর্তারা দাবি করেছেন বন রক্ষায় সর্বোচ্চ চেষ্টা অব্যাহত আছে। কিন্তু বনের গাছ কেটে এলাকার মানুষের ঘরে লাগানোর চিত্র দেখে তাদের সে চেষ্টা কতটা সফল হচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে।
সূত্র বলছে, অপ্রতিরোধ্য নদীভাঙ্গন আর পানিতে অতিমাত্রায় লবণের প্রভাবে সংরক্ষিত বনের গাছ মরছে। নদীভাঙ্গনের পাশাপাশি পানির উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে জমছে পলি। সাগরের লোনা পানি ও পলির প্রভাবে মরে যাচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ ও প্রাণী। দক্ষিণ উপকূলের সবুজ প্রাচীর এই ম্যানগ্রোভ বনের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়েছে। পরিবেশের এই পরিবর্তনে উপকূলের মানুষ আতঙ্কগ্রস্ত।
পটুয়াখালী বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে সোনারচর, চর কলাগাছিয়া, চর হাবাতিয়া, ফাতরার চর, খলিফার চর অবস্থিত। এসব বনাঞ্চলের অন্তত ১০০ হেক্টর জায়গায় সাগরের লোনা পানি ঢুকে তিন বছরে এক লাখেরও বেশি বিভিন্ন প্রজাতির গাছ মারা গেছে। এরমধ্যে কেওড়া ও কাঁকড়া প্রজাতির গাছের সংখ্যা বেশি। সাগরের লোনা পানির প্রভাবে নষ্ট হয়ে গেছে ২০০ প্রজাতির পাখি, প্রায় ১২ হাজার হরিণ, বানর, উদবিড়াল, সাপ ও শেয়ালসহ প্রায় ৫০ হাজার পশু-পাখির অবাসস্থল।
উপকূলের চরমোন্তাজ, আন্ডার চর, খলিফার চর এলাকার বাসিন্দারা বলেন, লোনা পানি ঢুকে আবাদি জমি কমে যাচ্ছে। জমির কৃষিবৈচিত্র্য বদলে যাচ্ছে। সেইসঙ্গে মরে যাচ্ছে সংরক্ষিত বনের গাছপালা। পরিবেশের বিরূপ প্রভাবে রাস্তাঘাটে পশু-পাখির সংখ্যাও আগের তুলনায় বাড়ছে। চরাঞ্চলের মানুষদের বাঁচিয়ে রেখেছে এই বন। বন না থাকলে আমরা তো বাঁচতে পারবো না।
চরবেষ্টিনের মোবারক হোসেন বলেন, দ্বীপে ঝুঁকির মুখে থাকা মানুষদের মায়ের মত ছায়া দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে যে বন, সে বন ফাঁকা হয়ে গেছে। ঝড় এলে আগে বাতাসের ঝাপটা লোকালয়ে আসতো না। এখন অনায়াসেই আসে। গাছে গাছে পাখিদের কিচিরমিচির শব্দ কমে গেছে। এই অঞ্চলের মানুষদের বাঁচাতে হলে বন বাঁচাতে হবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নদীতে অপরিকল্পিত বাঁধ দেওয়া, সাগরের লোনা পানি উপকূলে প্রবেশ, অস্বাভাবিকহারে পানির প্রবাহ বেড়ে যাওয়া এবং ডুবোচর জেগে ওঠার প্রভাব পড়ছে এই অঞ্চলের বনের ওপর। সমগ্র উপকূলেই এর প্রভাব পড়ছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে উপকূলে আরো বেশি গাছ লাগানো প্রয়োজন বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।
সংরক্ষিত বনাঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ব্যাপকভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে বলে উল্লেখ করেন চরমোন্তাজ রেঞ্জের দায়িত্বে থাকা রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. কামালুজ্জামান।
তিনি বলেন, সংরক্ষিত এ বনে অতিমাত্রায় লবণাক্ততার প্রভাব পড়েছে। নদীভাঙ্গনসহ নানা রোগবালাইয়ে বিশাল আকৃতির গাছ মরে যাচ্ছে কিংবা নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে।
তবে বন বিভাগের কর্মকর্তাদের যোগসাজসে গাছ চোরদের দৌরাত্মের কথা অস্বীকার করে তিনি বলেন, বনরক্ষায় আমাদের সব ধরণের উদ্যোগ রয়েছে।
** চরমোন্তাজ রেঞ্জে সংরক্ষিত বন উজাড়ের আরও খবর পরবর্তী প্রতিবেদনে
বাংলাদেশ সময়: ০৩০০ ঘণ্টা, মার্চ ২০, ২০১৪