চরমোন্তাজ, রাঙ্গাবালী, পটুয়াখালী ঘুরে এসে: কৃষি জমিতে লবণের গ্রাস, ফসলশূন্য মাঠ। হাজারো নি:স্ব চাষি চলে যাচ্ছেন অন্য পেশায়।
দেশের সর্বদক্ষিণে সমুদ্রের মোহনায় জেগে থাকা পটুয়াখালী জেলার দ্বীপ ইউনিয়ন চরমোন্তাজের চিত্রটা এমনই। এলাকার চাষিদের অভিযোগের অন্ত নেই। চরমোন্তাজের নয়ারচর, বলইবুনিয়া, চর মর্গারেট, চর বেস্টিনে বহু জেলে, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আর দিনমজুরের দেখা মেলে, যারা আগে কৃষি জমি আবাদ করেই জীবিকা নির্বাহ করতেন।
সরেজমিনে পাওয়া তথ্যসূত্র বলছে, চাষাবাদের সুবিধার্থে এ এলাকায় বেড়িবাঁধ তৈরির সময় স্লুইজগেট নির্মাণ করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। কথা ছিল এসব স্লুইজগেট থাকবে চাষিদের নিয়ন্ত্রণে। চাষির প্রয়োজনে স্লুইজগেট দিয়ে পানি ওঠা-নামা করবে। এক সময় তেমনটাই ছিল। এর সুফলও পেয়েছিলেন চাষিরা।
কিন্তু সময়ের বিবর্তনে সেই স্লুইজগেট চাষিদের কাছ থেকে প্রভাবশালীদের দখলে চলে গেছে। এখন স্লুইজগেট দিয়ে পানির যাওয়া-আসা নির্ভর করে প্রভাবশালী চক্রের ইচ্ছা-অনিচ্ছায়। অন্যদিকে এলাকার মানুষের নিরাপত্তায় নির্মিত হয়েছিল যে বাঁধ, সেই বাঁধ কেটে প্রভাবশালী চক্র নিজেদের মতো করে লবণ পানি ওঠা-নামানোর ব্যবস্থা করেছে।
বাংলানিউজ সরেজমিনে মাঠে অবস্থানকালে বহু চাষি তাদের অভিযোগের কথা জানান। তবে প্রভাবশালীদের ভয়ে অনেকেই মুখ খুলতে সাহস পান না। আলাপেই চাষিদের আকুল আহাজারি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপকালে বলইবুনিয়া গ্রামের এক চাষি আঙ্গুল তুলে দেখাচ্ছিলেন তাদের সর্বনাশের চিত্র। ফসলের মাটিতে লালচে দাগ, কোথাও জমেছে লবণের স্তর। মাঠের ভেতরে ছোট ছোট খাল কাটা হয়েছে লবণ পানি ওঠা-নামার জন্য। স্লুইজগেটগুলোতে মাছ ধরার সকল আয়োজন রাখা হয়েছে। মাছের মৌসুম সামনে রেখে এখনই অনেক স্থানে লবণ পানি ভরানো শুরু হয়ে গেছে।
চরবেস্টিনের এক চাষি বলছিলেন, আমরা তো শেষ হয়ে গেছি। আগে জমিতে চাষাবাদ করে জীবন চলতো। পরিবার-পরিজন নিয়ে অনেক ভালোই ছিলাম। এখন সে অবস্থা নেই। কাজকর্ম নেই। এলাকায় কাজ নেই। কাজ খুঁজতে যেতে হয় বাইরে।
চরমোন্তাজের চারদিকে ৩৩ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ সরেজমিনে ঘুরে বাংলানিউজ দেখতে পায়, সরকারি স্লুইজগেট আর ব্যক্তিগতভাবে কাটা স্লুইজগেট দিয়ে লবণ পানি ঢোকানোর দৃশ্য। সরকারি পাঁচটি স্লুইজগেট আর ব্যক্তিগত ১৮টি স্লুইজগেট দিয়ে অনবরত লবণ পানি ঢোকানো হচ্ছে। উপকূলের এ ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে বাঁধ কেটে নিরাপত্তা বেস্টনি ধ্বংস করে ফেলা হচ্ছে। অথচ সরকারি বেড়িবাঁধ কেটে ব্যক্তিগতভাবে স্লুইজগেট তৈরির কোনো নিয়ম নেই।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, চরমোন্তাজের বেড়িবাঁধের চারপাশে সরকারি পাঁচটি স্লুইজগেট কোনো না কোনোভাবে প্রভাবশালী চক্রের দখলে রয়েছে। কুদ্দুস খান ও মোশারেফ খানের দখলে রয়েছে বলইবুনিয়া স্লুইজগেট। সেখানে স্লুইজগেটের দু’পাশে সরকারি বদ্ধ খাল দখল করে মাছ চাষ হচ্ছে। স্থানীয় ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু মিয়ার দখলে রয়েছে দাঁড়ভাঙ্গা স্লুইজগেট। চর মার্গারেট স্লুইজগেট দখলে রেখেছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা কাশেম মোল্লা ও দুলাই মোল্লা। চরমোন্তাজ চার নম্বর স্লুইজগেট স্থানীয় যুবলীগের নেতা মোশারেফ খানের দখলে। সংস্কার কাজের কারণে চর মন্ডল স্লুইজগেট অকেজো হয়ে আছে।
সূত্র বলছে, প্রভাব খাটিয়ে স্থানীয় ও বাইরের প্রভাবশালীরা মাছ চাষের সুবিধার্থে চরমোন্তাজের বেড়িবাঁধ কেটে স্লুইজগেট তৈরি করেছেন। ৩৩ কিলোমিটার বাঁধে এরকম অন্তত ১৮টি স্লুইজগেট রয়েছে।
অবৈধভাবে বাঁধ কেটেছেন এমন তালিকায় রয়েছেন, গলাচিপা-দশমিনা সংসদীয় আসনের বিএনপি নেতা প্রার্থী শাহজাহান খান, পটুয়াখালীর নিরালা মাছ ফ্যাক্টরির মালিক দেলোয়ার হোসেন, গলাচিপা পৌরসভার বর্তমান মেয়র আবদুল ওহাব খলিফা, গলাচিপার পানপট্টি ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান সিদ্দিকুর রহমান, সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর হোসেন, পাথরঘাটার সাংবাদিক নাজমুল হোসেন, স্থানীয় প্রভাবশালী জাহাঙ্গীর হোসেন মাস্টার, গোলাম মোস্তফা মাস্টার, নূরুল আমীন খলিফা, বাহাউদ্দিন খলিফা, স্থানীয় প্রভাবশালী দীপ্তি গাজী, আপতের হাওলাদার ও হেমায়েত জোমাদ্দার।
চরমোন্তাজের যেখানেই বাংলানিউজের সঙ্গে স্থানীয় মানুষের আলাপ হয়েছে, সবার একই দাবি। কৃষিজমি প্রভাবশালীদের কবল থেকে মুক্ত করতে চান তারা। চাষিরা আবার ফিরতে চান মাঠে। ফসলের ক্ষেত আবার সবুজে ভরে উঠবে, এটাই প্রত্যাশা তাদের।
স্লুইজগেট আটকে লবণ পানি ঢোকানোর অভিযোগ যার বিরুদ্ধে, সেই স্থানীয় ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু মিয়াও চান জমিতে কৃষি আবাদ হোক। এলাকাটি কৃষি এলাকা হিসাবেই পরিচিতি পাক।
বাংলানিউজের সঙ্গে এলাকার সার্বিক অবস্থা নিয়ে আলাপকালে তিনি বলেন, এলাকায় পুরোটাই এক ফসলি জমি। লবণ পানির জন্য চাষিদের চাষাবাদে কিছু সমস্যা হয়। সরকার কৃষি জমি থেকে মাছের ঘের উচ্ছেদের পরিকল্পনা নিয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ০৫১৬ ঘণ্টা, মার্চ ২৫, ২০১৪