চিরিংগা, চকরিয়া, কক্সবাজার থেকে: বৈশাখের তীব্র খরতাপে অতিষ্ট সারাদেশের মানুষ যখন একফোঁটা বৃষ্টির জলের অপেক্ষায়, তখন কক্সবাজার অঞ্চলের লবণ চাষিরা আরও কয়েকটা দিন তপ্ত রোদের প্রত্যাশা নিয়ে বসে আছেন। লবণ উৎপাদন বাড়াতে বৃষ্টির জল নয়, তাদের চাই কড়া রোদ।
কক্সবাজারের চরকরিয়ার লবণ মাঠ এলাকা ঘুরে এসব তথ্য মিলেছে। চাষিরা বলছেন, দাম পাওয়া যাবে কী-না সেটা পরের ব্যাপার। কিন্তু উৎপাদন বাড়াতে নিজের পুরো শ্রমটাই দিতে চাই। বৈশাখে আগাম বর্ষা এলে লবণ চাষিদের সর্বনাশ হয়। একদিকে লবণ নষ্ট হয়ে যায়, অন্যদিকে উৎপাদনও কমে যায় অস্বাভাবিক। তাইতো আরও কয়েকটা দিন তপ্ত রোদ চান লবণ চাষিরা।
চকরিয়া উপজেলা সদর চিরিংগা থেকে মহেশখালী সীমান্তের বদরখালী এলাকায় যেতে মাঠে মাঠে লবণ চাষিদের ব্যস্ততা চোখে পড়ে। রোদের তাপটা যেন তাদের গা সওয়া। কারণ এই সময়ই মাঠে চাষিদের বেশি কাজ। মাঠে পানি তোলা, পানি কমানো, পলিথিনগুলো সরিয়ে রাখাসহ নানা কাজে ব্যস্ত চাষি। চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক আর মালিক সবারই এক কাজ। কোথাও আবার মাঠেই স্তুপ করে রাখা হয়েছে সদ্য তৈরি হওয়া লবণ।
বদরখালী ইউনিয়ন সদরের ঐতিহ্যবাহী ব্যবসা কেন্দ্রটি থেকে আজমনগরপাড়ার দিকে যেতে লবণ মাঠের এই দৃশ্যগুলো আরও কাছ থেকে দেখা যায়। লবণের তেজে মানুষগুলো যেন কালো হয়ে গেছে। লবণ মাঠের পাশ ঘেঁসে সরু নালায় বহমান লবণ পানি। চাষিদের কাছে এটা কাঁচা পানি বলে পরিচিত। এই পানিই মাঠে উঠে কয়েকটি প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে ঝরঝরে লবণে পরিণত হয়। চাষি থেকে দালালের কাছে, সেখান থেকে আড়তদারের কাছে, অবশেষে বিভিন্ন কোম্পানির মিলে এবং বেশ অবধি প্যাকেটজাত হয়ে গ্রাহকের ঘরে।
আজমনগরপাড়ায় ইউসুফ নবীর ছোট্ট মুদি দোকানে আলাপকালে অনেকজনের ভিড় জমে গেল। এই গ্রামের প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ কোন না কোনভাবে লবণ চাষ ও ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। জহির উদ্দিন (৭১), নিজামউদ্দিনের (৬৫) মত গ্রামের বয়সী ব্যক্তিরা লবণ চাষ ছেড়ে দিলেও শামসুল আলম (৪৫), আবু সাদেক (৪০), আবু সৈয়দের (৩৮) মত দক্ষ চাষিরা এখনও লবণ মাঠে রয়েছেন। ভাল দাম পাওয়ার আশায় প্রতি বছরই লবণ চাষ করছেন। কিন্তু মাথার ঘাম পায়ে ফেলে লবণ আবাদ করলেও দাম পাওয়াটা যেন ভাগ্যের ব্যাপার।
বদরখালী ইউনিয়নের তিন নম্বর ওয়ার্ডের মাঠের মাঝখান দিয়ে চলে যাওয়া পিচঢালা রাস্তায় দাঁড়িয়ে বয়সী লবণ চাষি মোজাফফর আহমদ বলছিলেন, লবণ চাষ এখন আর আগের মত লাভজনক নয়। লবণ চাষের সব উপকরণের দাম বেড়ে গেছে। সেই সঙ্গে শ্রমিকের মজুরির বেড়েছে। কিন্তু লবণের দাম সে তুলনায় বাড়েনি। এর ফলে চাষিরা লোকসান গুনছেন বছরের পর বছর।
মাঠের ভেতর দিয়ে বয়েচলা সড়কের দুপাশেই লবণ চাষের আয়োজন। ক্ষেতের ভেতরে বিছানো কালো পলিথিনে জমেছে লবণের দানা। চাষিরা যখন দেখেন ক্ষেত্রে আর লবণের দানা জমার সম্ভাবনা নেই, তখনই জমির সব লবণ তুলে ফেলেন। কোথাও লবণ স্তুপ করে রাখা হয়েছে। কিন্তু লবণের এই মৌসুমে হাজার হাজার মন লবণ মাঠে থাকলেও ক্রেতা চোখে পড়ল না একজনও।
চাষিদের সঙ্গে আলাপ করে বোঝা গেলো, একমাত্র প্রকৃত মূল্য না পাওয়াতেই তারা লবণ চাষ করে চরম সংকটের মুখে রয়েছেন। প্রতিবছর নতুন দেনার বোঝা কাঁধে উঠছে। তবুও পরের মৌসুমে ভাল দামের আশায় আবার আবাদের আয়োজন চলে। চাষিরা জানান, প্যাকেট লবণের দাম বাড়লেও মাঠে চাষিদের লবণ কেউ মূল্য দিয়ে কিনে না। প্যাকেট লবণ যেখানে ২০ থেকে ৩৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়, তখন মাঠে চাষিরা লবণ বিক্রি করে মাত্র দেড় থেকে দুই টাকা কেজি দরে।
চাষিরা জানান, এক একর জমিতে লবণ চাষ করতে ছয় মাসে একজন শ্রমিক প্রয়োজন। তার বেতন ৩৫০০ থেকে ৪০০০ টাকা। এই পরিমাণ জমি আবাদের জন্য বর্গাচাষিদের দিতে হয় ছয় মাসে ২৫ হাজার টাকা। আরও অতিরিক্ত খরচ রয়েছে প্রায় ২০ হাজার টাকা। এই হিসাবে প্রতি একরে খরচ দাঁড়ায় প্রায় ৮০ হাজার টাকা। এই পরিমাণ জমিতে ৬০০ থেকে ৭০০ মন লবণ পাওয়া যায়। এর মূল্য দাঁড়ায় সর্বোচ্চ ৬০ হাজার টাকা। এভাবেই লোকসান গুনে লবণ চাষিরা।
লবণ চাষিরা জানান, হঠাৎ বৃষ্টি ছাড়া বিশেষ কোন ঝুঁকি নেই লবণ চাষে। বিশেষ করে চৈত্র-বৈশাখ মাসে অকাল বর্ষণ হলে লবণ চাষিরা খুবই সংকটে পড়ে। এছাড়া অন্য কোন সমস্যা নেই লবণ চাষে। লবণের মূল্য যেমন চাষিদের চাই, তেমনি উৎপাদনও বাড়ানোটাও জরুরি। আর তাইতো পুরো বৈশাখ জুড়ে তপ্ত রোদের অপেক্ষা তাদের।
বাংলাদেশ সময়: ০১৫০ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৭, ২০১৪