ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

উপকূল থেকে উপকূল

সংকুচিত কুতুবদিয়া, প্রসারিত কুতুবদিয়া পাড়া

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩০২ ঘণ্টা, মে ৬, ২০১৪
সংকুচিত কুতুবদিয়া, প্রসারিত কুতুবদিয়া পাড়া ছবি : বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

কুতুবদিয়াপাড়া, কক্সবাজার: কুতুবদিয়ার দক্ষিণে তাবালর চর থেকে দক্ষিণে তাকালে অনেক দূরে সমুদ্রের কিনারে একটি বাড়ি দেখা যায়। বসতি নেই, আছে মাত্র কয়েকটি গাছপালা।

এই বাড়িটাই কুদিয়ার চর নামক বিশাল গ্রামের শেষ চিহ্ন। মানুষগুলো সব হারিয়ে ছুটেছে দেশের বিভিন্ন এলাকায়। তবে অধিকাংশ মানুষের ঠাঁই হয়েছে কক্সবাজার জেলা সদরে কুতুবদিয়াপাড়ায়। ঠিক এভাবেই ছোট হচ্ছে কুতুবদিয়া, আর সম্প্রসারিত হচ্ছে কুতুবদিয়া পাড়া।

কুতুবদিয়ার সর্বদক্ষিণে ক্ষয়ে যাওয়া ইউনিয়ন আলী আকবর ডেইলের বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিনে গেলে এলাকাবাসী বাংলানিউজকে শোনাচ্ছিলেন কুদিয়ার টেকের গল্প। তাবালর চর বাজারের বয়সী ব্যক্তিরা জানালেন, কুদিয়ার টেকে প্রায় আট হাজার লোক ছিল। পর্যায়ক্রমে এরা বিভিন্ন এলাকায় ঠাঁই নিয়েছে।

সমুদ্রে বিলীন হয়ে যাওয়া কুদিয়ার টেকের শেষ বাড়ির কয়েকটি গাছপালা দেখার সুযোগ হলেও দেখা মেলেনি কোনো মানুষের। বাড়িঘর হারা মানুষেরা এই এলাকা থেকে চলে গেছে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানালেন, কক্সবাজারের কুতুবদিয়া পাড়ায় এদের দেখা মিলতে পারে।

তাবালর চর বাজারের দক্ষিণ পাশে মাওলানা জহিরুল ইসলাম বলেন, এই এলাকার বহু মানুষ ঘরবাড়ি হারিয়ে অন্যত্র চলে গেছে। সমুদ্র লাগোয়া ইউনিয়ন আলী আকবর ডেইলের অনেকটাই সমুদ্রে বিলীন হয়ে গেছে। প্রবল জোয়ারে বারবার বেড়িবাঁধ ভেঙে যায়। এখানে আর মানুষের বসবাস সম্ভব হচ্ছে না।

কক্সবাজার সদরে পৌরসভার এক নম্বর ওয়ার্ডে গড়ে ওঠা কুতুবদিয়াপাড়ায় বহু মানুষের সঙ্গে বাংলানিউজের দেখা মেলে, যাদের বাড়ি কুতুবদিয়ার কুদিয়ার টেকে। এছাড়া, কুতুবদিয়ার মাতারবাড়ি, ধলঘাটা, ধুরুংসহ বিভিন্ন এলাকার মানুষ সব হারিয়ে এই কুতুবদিয়াপাড়ায় ঠাঁই নিয়েছে। এদের মধ্যে কিছু মানুষ এসেছে ১৯৮৭ সালে, কিছু এসেছে ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের পরে। এরপর বিভিন্ন সময়ের দুর্যোগে কুতুবদিয়া পাড়ার লোকসংখ্যা দিনে দিনে বাড়ছে।

ভর দুপুরে কুতুবদিয়াপাড়ার সরু গলিতে বাংলানিউজের সঙ্গে দেখা মেলে মো. মোস্তাক আহমেদের। বয়স পঞ্চাশ পেরিয়েছে। ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের পর সব হারিয়ে ছেলেমেয়েসহ পরিবারের নয় জনকে নিয়ে এই পাড়ায় উঠেছেন। ছেলেদের নিয়ে নিজেই সমুদ্রে মাছ ধরতে যেতেন। মাছ ধরতে গিয়ে দুই ছেলে মো. বেলাল ও মো. রুবেল আর ফিরে আসেনি। এভাবেই একের পর এক দুর্যোগ জীবনকে বদলে দেয়।

কুতুবদিয়ার কুদিয়ার টেক থেকে কুতুবদিয়া পাড়ায় এসেছেন নুরুন্নাহার বেগম। স্বামী রজব আলী। তিন মেয়ে আর দুই ছেলেকে নিয়ে এখানে বাসা বেঁধেছিলেন। মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে। আর দুই ছেলের মধ্যে এক ছেলে জাহাঙ্গীর আলম সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়ে আর ফিরে আসেনি। সে কারণে অপর ছেলে ফরিদুল আলম মাছধরা বাদ দিয়ে বাসার সঙ্গে ছোট্ট দোকান করেছেন জীবিকার প্রয়োজনে।

কুতুবদিয়াপাড়ার কিশোর নূর মোহাম্মদের মামা-খালার বাড়ি আছে কুতুবদিয়ার তাবালর চরে। বছরে দু’একবার সেখানে যাওয়া হয়। বড় হয়ে নূর মোহাম্মদ শুনেছেন তার জন্মের আগে তার বাবা-মা এখানে চলে এসেছেন। বাড়ি ছিল কুদিয়ার টেকে। তবে সেই গল্প নূর মোহাম্মদের কাছে এখন রূপকথা। কুতুবদিয়াপাড়ায় অনেক সংগ্রাম করে টিকে থাকতে হচ্ছে বলে নূর মোহাম্মদের স্কুলে যাওয়া হয়নি। তাইতো ১৯ বছরেই তিনি দক্ষ শুটকি ব্যবসায়ী।

একই বয়সী পাড়ার আরেক কিশোর সাদ্দাম হোসেন তার দাদির কাছে কুদিয়ার টেকের গল্প শুনেছে। জীবন সংগ্রামের লড়াইয়ে পাড়ার এই কিশোরদের অনেকেই স্কুলের চৌকাঠ পেরোতে পারে না। কুদিয়ার টেকে বসেও মানুষগুলোকে যে সংগ্রাম করতে হয়েছে, এখানেও তাই। লেখাপড়া চালিয়ে যেতে না পারা প্রসঙ্গে সাদ্দাম হোসেন বলছিল, লেখাপড়া চালালে আমাদের ঘর চালাবে কে?

কুতুবদিয়াপাড়ার কমিশনার আকতার কামাল আজাদ নিজেও কুতুবদিয়ার সব হারানো মানুষ। বাংলানিউজের কাছে সেই সময়ের গল্প বলতে গিয়ে তিনি জানাচ্ছিলেন, পরিবারের সঙ্গে যখন তিনি এখানে এসেছেন, তখন তার বয়স ১৮ বছর। এখানে এসে তার লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। এইচএসসি পর্যন্ত পড়েছেন। তার বাবা মাওলানা হামিদুর রহমান ১০০ বছর বয়সে এই কুতুবদিয়া পাড়ায়ই মৃত্যুবরণ করেছেন। এই অস্থায়ী নিবাসে নিজের একটা জগত তৈরি হয়েছে।

তিনি জানান, ভাঙন আর ঘূর্ণিঝড়ে যত মানুষ নিঃস্ব হচ্ছে, তার অধিকাংশই ছুটে আসছে কুতুবদিয়া পাড়ায়। এখানেও জীবনের ঝুঁকি আছে। তারপরও মানুষ এখানে ছুটে আসে, কারণ এখানে সমুদ্রে মাছধরে জীবিকা নির্বাহের সুযোগ রয়েছে। শুধু কুতুবদিয়া পাড়ায় নয়, এক নম্বর ওয়ার্ডের সমিতিপাড়া নামক স্থানেও কুতুবদিয়ার লোক রয়েছে।          

সূত্র বলছে, ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে দ্বীপ কুতুবদিয়া। ১৯৬০ সালে এ দ্বীপের আয়তন ছিল ৬০ বর্গকিলোমিটার। এখন কমে তা হয়েছে ২৫ বর্গকিলোমিটার। আর এখানেই এখন লক্ষাধিক মানুষের বসবাস।

বঙ্গোপসাগরের এ দ্বীপের মানুষের মূল পেশা সাগরে মাছ ধরা ও কৃষি কাজ। অনেকে আবার নিজের জমিতে কৃষিকাজের সুযোগ হারিয়ে ফেলে লবণ উৎপাদনে জীবিকা খুঁজছেন। সমুদ্রের ভাঙনের কবলে পড়ে অনেকেই পেশা বদল করতে বাধ্য হচ্ছেন। পুরানো পেশা হারানো এই মানুষদের মধ্যে একটি বড় অংশ জীবিকার প্রয়োজনে দিনমজুরের কাজ বেছে নিয়েছেন।

বাংলাদেশ সময়: ০২৫৮ ঘণ্টা, মে ০৬, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।