চর নিজাম, মনপুরা, ভোলা ঘুরে এসে : খেটে খাওয়া মানুষেরা ভালো নেই। সমুদ্র-নদীতে মাছ ধরা পড়লে দুবেলা খাবার জোটে, মাছ না পড়লে দিন পার করতে হয় অতিকষ্টে।
বাংলাদেশের ভূখন্ড হলেও দেশের অন্য জনপদ থেকে এখানকার জীবনযাপন সম্পূর্ণ আলাদা। চরবাসীর স্বাভাবিক জীবনযাত্রাই যেন ‘অস্বাভাবিক’।
অথচ এই চরের সম্ভাবনা কাজে লাগিয়ে এখানকার মানুষের ঘরে ফিরতে পারে শান্তি। দস্যু হটিয়েও শান্তি ফেরেনি সমুদ্র মোহনায় জেগে থাকা চর নিজামে।
দ্বীপ জেলা ভোলার দ্বীপ উপজেলা মনপুরার ছোট্ট দ্বীপ চর নিজাম ঘুরে জানা গেলো, এককালে এখানে ছিল দস্যুদের অভয়ারণ্য।
সমুদ্রে মাছধরা থেকে ছোট্ট কুটিরে বসবাসের নিশ্চয়তা নির্ভর করত দস্যুদের ওপর। অস্ত্রের ঝনঝনানিতে প্রকম্পিত হতো গোটা চর। সাধারণ মানুষ সারাক্ষণই জিম্মি থাকত এদের কাছে। মাছের আড়তে কী বেচাকেনা হচ্ছে, ব্যবসা-বাণিজ্য করে কার পকেটে কতটাকা জমেছে, সব হিসাব থাকত দস্যু বাহিনীর কাছে।
বার বার দস্যু বাহিনীর রোষানলে পড়া চরবাসী আবুল কাসেম মাস্টার জানালেন, ২০০১ সাল থেকে এই এলাকায় দস্যুদের শাসন ছিল ব্যাপক আকারে। সাধারণ মানুষ ওদের কাছে জিম্মি ছিল। একই সঙ্গে পুলিশ আর দস্যুদের নির্যাতন সইতে হয়েছে চরবাসীকে। কামাল ও ফারুক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ ছিল এ চরে। একসময় চরবাসী অতিষ্ট হয়ে দস্যুদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
চরবাসীর অনেক সংগ্রামে সে অবস্থা থেকে মুক্ত চর নিজামের মানুষেরা। ২০১০ সালের দিকে দস্যুদের সঙ্গে চরবাসীর এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়। একজন চরবাসীর জীবনের বিনিময়ে ১০ দস্যু প্রাণ হারায়। পিছু হটে দস্যু বাহিনী। চর নিজাম ‘স্বাধীন’ হয়। চর নিজামে সর্বত্রই আলাপকালে দস্যু হটানোর ঘটনা উঠে এসেছে বার বার। চরবাসী তাদের বীরত্বকে সামনে তুলে ধরে এগিয়ে যেতে চান অনেক দূর।
স্থানীয় বাসিন্দাদের দেয়া তথ্য মতে, এই চরে বিপুল সম্ভাবনা থাকলেও তা বিকাশের কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। ১৯৭৬ সালে এই চরে জমি ছিল প্রায় সাড়ে চার হাজার একর। তখন ওই জমিতে ধান হতো একলাখ মনের বেশি। এর বর্তমান মূল্য দাঁড়ায় দশ কোটি টাকার মত। ওই জমির একটা বড় অংশে রবিশস্য আবাদ হতো। এতে বর্তমান বাজারমূল্যের হিসেবে আয় হতো আরও প্রায় ১৫ কোটি টাকা।
কিন্তু আবাদি জমিতে বনায়ন করার ফলে গত ৩৮ বছরে চরে সে আয়ের অকেটাই কমে গেছে। ১৯৭৬ সালে স্থানীয় চাষিদের আবাদ বন্ধ করে দিয়ে বনায়ন শুরু হয়। বন যা আছে, তার সর্বোচ্চ মূল্য হবে ২-৩ লাখ টাকা। বনে সবই হচ্ছে গেওয়া কাঠ। স্থানীয় বাসিন্দারা হিসাব দেখিয়ে বললেন, ১০ শতাংশ বসতি এলাকায় এক লাখ টাকার গাছপালা থাকলে একই পরিমাণ জমির বন এলাকায় গাছপালা আছে মাত্র ৪-৫শ’ টাকার।
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, চর নিজামের বনে এখন অনেক কিছুই নেই। শুধু গেওয়া গাছে ভর্তি। বনের কিছু অংশ সরেজমিন ঘুরে এর প্রমাণও পাওয়া গেছে। অথচ এখানে বাবলা বাগান ছিল। কড়ই বাগান ছিল। সাড়ে চার হাজার একরের বাবলা বাগানের চিহ্ন পর্যন্ত নেই।
তবে বন বিভাগের কর্তারা এ বিষয়ে বলছেন, আগে যে বন ছিল তার অধিকাংশই নদীভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে। এখানে নতুন বনায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পুরানো বন সংরক্ষণেরও পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
চর নিজামের গোড়াপত্তন আর সম্ভাবনা নিয়ে আলাপ হচ্ছিল এখানকার সাবেক ইউপি সদস্য মো. ইউসুফ সরকারের সঙ্গে। তিনি বলেন, এই চরে প্রাকৃতিকভাবেই অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। এটাকে কাজে লাগানো যাচ্ছে না। এখানকার মানুষের জীবিকার একমাত্র অবলম্বন সমুদ্র ও নদীতে মাছধরা। মাছ পাওয়া না গেলে জীবিকার পথ বন্ধ হয়ে যায়। চরবাসী শান্তির জন্য দস্যু হটিয়েছে। কিন্তু প্রকৃত শান্তিটা এখনও ফেরেনি।
স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে পাওয়া ১৯৯৭ সালের জরিপ সূত্র বলছে, চর নিজামের সামনের দিকে সমুদ্রে ৯২ বর্গকিলোমিটার জুড়ে চর জাগছে। এরমধ্যে প্রথম ৩৬ বর্গকিলোমিটারে ৪-৫ ফুট এবং পরের ৫৬ বর্গকিলোমিটারে ৮-৯ ফুট পানি রয়েছে। বর্তমানে এই এলাকায় গভীরতা আরও কমে গেছে বলে স্থানীয়দের ধারণা। এরফলে ধারণা করা হচ্ছে, চর নিজাম নিকট ভবিষ্যতে আরও বড় চরে রূপান্তরিত হবে। চরের এই সম্ভাবনা কাজে লাগানোর দাবি এলাকাবাসীর।
বন বিভাগের সঙ্গে সব দ্বন্দ্ব-সংঘাতের অবসান চান চর নিজামের বাসিন্দারা। তারা বলেন, জমির বন্দোবস্ত নিয়ে এখানকার বাসিন্দাদের সঙ্গে বন বিভাগের বিরোধ রয়েছে। এই বিরোধ নিস্পত্তির মধ্যদিয়ে স্থানীয়দের জমি আবাদের সুযোগ দেয়া হলে চর নিজাম আবার ভরে উঠবে সোনালী ফসলে।
[ পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোন খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: [email protected] ]
বাংলাদেশ সময়: ০৩৩৮ ঘণ্টা, আগস্ট ২২, ২০১৪