চর কলাতলী, মনপুরা, ভোলা ঘুরে এসে : নিরাপত্তাহীনতা আর দারিদ্র্যতার কারণে শিশুবিয়ে দ্বীপের গ্রামে। ১৪-১৫ বছর পার হতে না হতেই মেয়েদের বিয়ে হচ্ছে।
এই চিত্র দ্বীপ জেলা ভোলার মনপুরা উপজেলার চর কলাতলীর। এ চরের একাধিক গ্রাম ঘুরে পাওয়া গেছে শিশু বিয়ের ভয়াবহ চিত্র। যে বয়সে ছেলেমেয়েদের স্কুল-কলেজে থাকার কথা, সে বয়সে তারা সন্তান নিয়ে সংসার সামলাচ্ছে। সংসারের কাজের ভারে কিশোরীদের শরীর ভেঙে পড়েছে। শরীরে বাসা বেঁধেছে নানান রোগবালাই। অল্প বয়সে আসা সন্তানও বেড়ে উঠছে অপুষ্টি নিয়ে। অন্যদিকে কিশোর বয়সে সংসারের দায়িত্ব নিয়ে ছেলেটির জীবনও যেন বিপন্ন।
চর কলাতলীর চার নম্বর আবাসন এলাকায় আঞ্জল হক ব্যাপারীর দোকানে চা-বিস্কুট খাচ্ছিল পাঁচ কিশোর। বয়স দেখে প্রথমে প্রশ্ন আসে তারা পড়াশুনা করছে কীনা। জানা গেল, কারও লেখাপড়াই তৃতীয় চতুর্থ শ্রেণীর বেশি এগোয়নি। এলাকায় শিশুবিয়ে নিয়ে আলাপ উঠতেই ওই কিশোরদের কাছে আবার এই প্রশ্ন। জানা গেল, পাঁচ কিশোরের মধ্যে চার কিশোরই বিবাহিত। দু’জনের আবার সন্তানও রয়েছে।
হেলাল উদ্দিন (২০)। পিতা আবদুল মান্নান। বিয়ে করেছে চার বছর আগে। বিয়ের সময় বয়স ছিল ১৬ বছর। স্ত্রী মিনারা বেগমের বয়স তখন ছিল ১৪ বছর। বিয়ের এক বছর যেতে না যেতেই এই দম্পত্তির ঘরে এক ছেলে সন্তান আসে। আরেকজন শরীফ (১৯)। বিয়ে করেছে দু’বছর আগে। স্ত্রী মর্জিয়া বেগমের বয়স ছিল তখন মাত্র ১৫ বছর। এই দম্পতির এই সন্তান রয়েছে। আরেকজন হোসেন (১৮)। মাত্র একমাস আগে বিয়ে করেছে। স্ত্রী ফারজানা বেগমের বয়স ১২ বছর। বিয়ের পর থেকে ফারজানা নানান অসুখে আক্রান্ত।
মর্জিয়া বেগমের মা রোকসানা বেগম বলেন, বাড়ি ছিল হাতিয়ায়। নদীভাঙণে সব হারিয়ে এই চরে এসেছি। আয়-রোজগারের লোক নেই। অসুস্থতার কারণে স্বামী আবদুল করিম কাজ করতে পারে না। দুই মেয়েকে ঘরে রাখার মত কোন ব্যবস্থা নেই। বড় মেয়ে ঘরে রাখায় নিরাপত্তা নাই। ধারকর্জ করে মেয়েদের বিয়ে দিয়েছি। ৩০ হাজার টাকার মত দেনা আছি। এই টাকা কীভাবে শোধ করবো জানিনা।
কিশোর হেলাল উদ্দিনের বাবা আবদুল মান্নান বলেন, বাড়ি ছিল মনপুরায়। সব হারিয়ে পাঁচ বছর আগে এখানে এসেছি। ছেলে বাইরে কাজকর্ম করে। ঘরের কাজ সামলাতে সমস্যা হয় বলে ছেলেকে বিয়ে করিয়েছি। ছেলের ব্যবসার জন্য মেয়ের বাবা কিছু টাকা দিয়েছে।
চর কলাতলীর শিক্ষক, জনপ্রতিনিধি, উন্নয়নকর্মী, ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন স্তরের মানুষের সঙ্গে আলাপে জানা যায়, এই চরের প্রায় সব বাড়িতেই অল্প বয়সে ছেলেমেয়েদের বিয়ে দেয়া হয়। অসচেতনতা, দারিদ্র্যতা আর নিরাপত্তাহীনতা এর অন্যতম কারণ। দরিদ্র অভিভাবক তার বয়সী মেয়েকে ঘরে রাখতে পারে না। কোনভাবে দুর্নাম রটে গেলে মেয়ের বিয়ে হবে না, এই ভেবে বিয়ের বয়স হওয়ার আগেই মেয়েদের বিয়ের কথা ভাবতে থাকেন অভিভাবকেরা।
চর কলাতলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি নাজমুল হুদা বাবুল বলেন, এলাকার লোকজন খুব একটা লেখাপড়ার সুযোগ পায়নি। সে কারণে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার ব্যাপারে অনেকেরই আগ্রহ কম। ভালো মেয়ে পাওয়া গেছে, কিছু টাকা পাওয়া যাবে, এই নিশ্চয়তায় বিয়ে হয়ে যায়। ছেলে কিংবা মেয়ের বিয়ের বয়স হয়েছে কীনা, সে ভাবনা অনেক অভিভাবকেরই নাই।
চর কলাতলীর খালেক নগরের বাসিন্দা আবদুল ওহাব বলেন, ছেলে ও মেয়ের বয়স বেশি দেখিয়ে সব কাগজপত্র ঠিক করেই বিয়ের কাজ সম্পন্ন হয়। বিয়েতে রেজিষ্ট্রিও হয়। কিন্তু সেগুলো একেবারেই নামেমাত্র। বিয়ের পর এইসব কিশোর-কিশোরী দম্পতিতে একের পর এক অঘটন ঘটতে থাকে। দু’একটি সন্তান জন্মের পর বিচ্ছেদের ঘটনাও ঘটে।
এলাকার ইউপি সদস্য মো. জাফর উল্লাহ বলেন, এক সময় এই চরে ঘরে ঘরে বাল্যবিয়ে ছিল। বিয়ের সময় ছেলে ও মেয়ের বয়স প্রমাণের কাগজপত্র প্রয়োজন হওয়ায় এখন বাল্যবিয়ে অনেক কমে এসেছে। তাছাড়া অভিভাবকেরাও আগের চেয়ে সচেতন হয়েছেন।
[ পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোন খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: [email protected] ]
বাংলাদশে সময়: ০৮১৩ ঘণ্টা, সপ্টেম্বের ০৫, ২০১৪