কমলনগর, লক্ষ্মীপুর ঘুরে এসে: নদীর গতিপথ বদলে বাড়ছে ভাঙন। নদীর গতিপথ বদলের অন্যতম কারণ ডুবোচর।
ডুবোচর নদীর প্রধান স্রোতধারা সরিয়ে নেয় এক স্থান থেকে অন্য স্থানে। প্রবল স্রোতধারা লোকালয়ে আঘাত হেনে হাজারো মানুষকে নিঃস্ব করছে।
ফলে ভাঙনরোধে সমন্বিত পরিকল্পনা প্রণয়নের দাবি তুলেছেন ভাঙনকবলিত নদীতীরের মানুষেরা।
লক্ষ্মীপুর ও ভোলার মধ্যবর্তী মেঘনার পরিবর্তনটা এমনই। এই পরিবর্তনে সবচেয়ে ক্ষতির মুখে লক্ষ্মীপুরের কমলনগর। এভাবেই বছরে বছরে ছোট হচ্ছে মেঘনা তীরের এই জনপদ। এ ভাঙন এখন স্থানীয় মানুষের কাছে মূর্তিমান আতংক। তাদের আশংকা কমলনগর নামের জনপদ তৃতীয়বারের মতো বিলীন হয়ে যায় কি না, তা নিয়ে।
যারা যুগ যুগ ধরে ভাঙনের এ চিরায়ত রূপ ও মেঘনার বিক্ষুব্ধতা দেখে এসেছেন, সেই স্থানীয় মানুষদের কাছে ভাঙনের কারণ শুনতে আসেনি কেউ। সমাধানে তাদের কাছে কেউ সুপারিশও চায়নি। অথচ এই মানুষেরাই প্রত্যক্ষদর্শী বিশেষজ্ঞ। ভাঙনরোধ পরিকল্পনায় এদের মতামত বিশেষ সহায়ক হতে পারে।
সরেজমিনে তথ্য সংগ্রহকালে বাংলানিউজ স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে জানতে চেয়েছিল কী কারণে এই ভাঙনের তীব্রতা? ভাঙনরোধের সমাধানই বা কী? জবাবে স্থানীয়রা তুলে ধরেন তাদের মতামত।
স্থানীয় সূত্র বলছে, কমলনগর ঘেঁষা মেঘনায় বিগত ১০ বছরে ভাঙনের গতি একই রকম। তিন বছরে এই ভাঙন আরো তীব্র আকার ধারণ করেছে। এরআগে চরাঞ্চল ভেঙেছে। এখন বাড়িঘর, স্থাপনা, ফসলি জমি ভাসিয়ে নিচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বহু মানুষ। ঘরবাড়ি সরিয়ে তারা ছুটছে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে।
সূত্র বলছে, লক্ষ্মীপুরের মজু চৌধুরী থেকে ভোলার ইলিশা ফেরি রুট ডুবোচরের কারণে বন্ধ হয়ে গেছে। বিগত ৫ বছর আগে কমলনগরের মতিরহাটের দক্ষিণে এসে ড্রেজিং করায় নদীর মূল প্রবাহ উত্তর-দক্ষিণ স্থানান্তরিত হয়ে পূর্ব-পশ্চিমে সরে গেছে। যে কারণে স্রোতের আঘাতে কমলনগর উপকূল ভাঙছে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, মেঘনার মাঝখানে ডুবোচরের কারণে পানি চলাচলের পথ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। নদীর মাঝখান থেকে মূল স্রোত কিনারে চলে এসেছে। আর এই পথে জাহাজ চলাচল করার কারণে কমলনগরের তীর ভেঙে চলছে অবিরাম। ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটের জাহাজগুলোও চলছে এই পথ ধরেই।
হাজীগঞ্জ বিশ্বরোড়ের মাথায় কালকিনি ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডে দাঁড়িয়ে এই জাহাজ চলাচলের দৃশ্য চোখে পড়ে। কিনার থেকে অল্পকিছু দূরে নদীতে চলে জাহাজ। আর এই জাহাজ চলাচলের ঢেউ ভেঙে নিয়ে যায় জনপদ।
গত এক বছরে এই এলাকার সোয়া কিলোমিটার জনপদ নদীতে হারিয়েছে। ইউনিয়ন থেকে এ পর্যন্ত ৫ হাজারের বেশি মানুষ স্থানান্তরিত হয়ে অন্যত্র চলে গেছেন বলে ইউনিয়ন পরিষদ সূত্র জানিয়েছে।
ভাঙনের তীরে বাড়িঘরের শেষ চিহ্ন। সুপারি গাছ, নারিকেল গাছ, সাজানো গোছানো ঘরের ভিটেমাটি, উঠান, সবই পড়ে আছে। শুধু ঘরটা নেই। বাড়ির লোকজন মাঝে-মধ্যে যত্নে গড়া বাড়ির গাছগাছালি দেখতে আসেন। বাড়িটির আশা হয়তো তারা ছেড়েই দিয়েছেন, তারপরও স্বপ্ন দেখেন ভাঙন থেমে গেলে কিনারে এসে বাড়িটি রক্ষা পেতে পারে। যারা এতটুকু আশাও করতে পারছেন না, তারা অনেক কষ্টে নারিকেল-সুপারি গাছে কুঠারের ঘা বসাচ্ছেন। নারিকেল-সুপারি না পাওয়া যাক, অন্তত গাছগুলো বিক্রি করে তো কিছু টাকা পাওয়া যাবে!
আলাপ হলো অনেকের সঙ্গে। ইউপি সদস্য তোফাজ্জেল হোসেন, কিংবা মাছ ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম। চা দোকানের বেঞ্চে বসে কথা বলার সময় ভিড় জমে গেল। ভাঙনরোধে যথাযথ পরিকল্পনা না নেওয়ায় ক্ষোভ তাদের সবার।
অথচ কমলনগরের দক্ষিণ কালকিনি হাজীগঞ্জ বিশ্বরোডের মাথা থেকে চর ফলকন গ্রামের দক্ষিণ প্রান্ত পর্যন্ত প্রায় ১০ কিলোমিটার নদী তীর অব্যাহত গতিতে ভাঙছে। চর জগবন্ধু ও লুধুয়া এলাকা ভাঙনের ফলে ১৯ কোটি টাকা নবনির্মিত কমলনগর উপজেলা কমপ্লেক্স, কমলনগর থানা, প্রাণিসম্পদ দপ্তর, উপকূল কলেজ, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এমনকি হাজীরহাট বাজারও হুমকির মুখে রয়েছে।
স্থানীয়রা জানালেন, ইতোপূর্বে এই এলাকার ভাঙনরোধে কোনো উদ্যোগ তারা দেখেননি। জনপ্রতিনিধিরা স্থানীয় উদ্যোগে জিও ব্যাগ ফেলে ভাঙনরোধে চেষ্টা করলেও রাজনৈতিক বিতর্কে সে উদ্যোগ অব্যাহত রাখা সম্ভব হয়নি। এই এলাকায় ভাঙন এখন একটি রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হয়েছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, রাজনৈতিক নেতা, পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলী ও ঠিকাদারের উদাসীনতায় ভাঙনরোধে ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। রাজনৈতিক নেতারা ক্ষমতার পালাবদলের ইস্যু হিসাবে নদীভাঙন সমস্যা জিইয়ে রাখতে চান। পানি উন্নয়ন বোর্ড ও ঠিকাদারদের প্রত্যাশা হচ্ছে নদী যত ভাঙবে, তত বেশি টাকা উপার্জনের পথ তৈরি হবে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, নদীভাঙন রোধের পরিকল্পনায় মাঠের তথ্য স্থান পাচ্ছে না। পরিকল্পনায় উঠে আসছে না বাস্তব চিত্র। নদীভাঙন সমস্যা সমাধানে পানি উন্নয়ন বোর্ড, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়, ভূমি মন্ত্রণালয় ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়কে সমন্বিত পরিকল্পনা নিতে হবে। মাঠের তথ্যের ভিত্তিতে সঠিকভাবে সমীক্ষা করতে হবে। ড্রেজিং করে পানি নিষ্কাশনের পথ ঘুরিয়ে দিতে হবে। কমলনগরের পুরো ১০ কিলোমিটার এলাকা ব্লক দিয়ে সংরক্ষণ করতে হবে।
তারা বলেন, নদীর এপার-ওপারে একসঙ্গে ভাঙন প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিতে হবে। কমলনগরের ঠিক ওপারে ভোলা সদর ও দৌলতখানে ভাঙনরোধে অনেক কাজ হলেও এপারে কোনো কাজ হয়নি। ওপারে ভাঙনরোধ হয়ে প্রবল চাপ পড়ছে এপারে।
কমলনগরের মতিরহাটের ভাঙনরোধের দৃষ্টান্ত তুলে স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, ওই এলাকায় ১৯৮৮ সালে ৩ কোটি টাকা ব্যয়ে তীর সংরক্ষণ কাজ হয়েছে। ১৯৯৬ সালে ১ কোটি টাকা ব্যয়ে সংস্কার কাজ হয়েছে।
২০০৩ সালে আবারও ৯৬ লাখ টাকার কাজ হয়েছে। সংস্কারে ২০০৭ সালে ব্যয় হয়েছে ১ কোটি টাকা। নিয়মিত কাজ হয়েছে বলে সেখানে ভাঙনরোধ করা গেছে। গোটা কমলনগর রক্ষায় ওই দৃষ্টান্ত কাজে লাগানোর সুপারিশ এলাকাবাসীর।
[ পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোন খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: [email protected] ]
বাংলাদেশ সময়: ০৮২১ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৯, ২০১৪