কমলনগর, লক্ষ্মীপুর ঘুরে এসে: আশা-নিরাশার দোলাচলে ১৯৮ কোটি টাকা! মেঘনার ভাঙন প্রতিরোধে এই বরাদ্দ নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষেরা আশায় বুক বাঁধছেন। তাদের প্রত্যাশা, মেঘনা আর বিক্ষুব্ধ হবে না।
ভাঙন প্রতিরোধে বরাদ্দের খবর পেয়ে মেঘনাতীরের লক্ষ্মীপুরের কমলনগরের হাজারো মানুষ এভাবেই স্বপ্ন আঁকছেন। এ এলাকার সর্বত্রই এখন ১৯৮ কোটি টাকার আলোচনা। বিগত কয়েক বছর ধরে মেঘনার গ্রাসে ক্ষয়ে যাওয়া এই জনপদের মানুষেরা ভাঙনকেই সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসেবে দেখছেন। আর সে কারণে এ খাতে বরাদ্দের খবরটাই তাদের কাছে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।
কিন্তু এ বরাদ্দ কতোটা রক্ষা করতে পারবে ওই এলাকার মানুষদের, সে হিসেব মিলছে না। কমলনগর চরম ঝুঁকিতে থাকলেও এই বরাদ্দের বড় অংশ রামগতি অংশে ব্যয় হচ্ছে। এ বরাদ্দের মধ্যে কমলনগরের মাতব্বরনগরে মাত্র এক কিলোমিটারে ব্লক ফেলে তীর সংরক্ষণের কাজের জন্য ৪৬ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। মাত্র এটুকু সংরক্ষণ করা হলে কমলনগরের নবনির্মিত উপজেলা পরিষদ ভবন, উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র, উপকূল কলেজ, থানা, প্রাণিসম্পদ ভবন, এমনকি হাজীরহাট বাজার হুমকির মুখেই থেকে যাবে।
চর ফলকনের ঐতিহ্যবাহী লুধুয়া বাজার রক্ষায় বাজেটে কোনো বরাদ্দ নেই। অথচ এখানে বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। একটি মাছের ঘাট রয়েছে। ভাঙন আধা কিলোমিটারের চেয়েও কাছে চলে এসেছে। ভাঙন ঠেকানো সম্ভব না হলে আগামী বর্ষার আগেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো অন্যত্র সরিয়ে নিতে হবে। বাজারটি মুখ থুবড়ে পড়বে।
সূত্র বলছে, মেঘনার ভাঙন থেকে কমলনগর ও রামগতি উপজেলাকে রক্ষার লক্ষ্যে ১৩০০ কোটি টাকার প্রকল্পের অংশ হিসেবে এবার ১৯৮ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। জুলাই’২০১৪ থেকে জুলাই’২০১৭ সময়কালে তিন বছর মেয়াদে এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হবে। মোট বরাদ্দ থেকে প্রায় ১৫ কোটি টাকা খরচ হবে প্রকল্প ব্যবস্থাপনায়।
ভাঙন রোধের এ প্রকল্পের আওতায় রামগতি বাজার ও মতিরহাট রক্ষণাবেক্ষণ কাজে ৩ কোটি টাকা, মেঘনার বুকে জেগে ওঠা চর ড্রেজিংয়ে ৫ কোটি ৪ লাখ টাকা, রামগতির আলেকজান্ডার থেকে রামদয়াল পর্যন্ত ব্লক ফেলে নদীর তীর সংরক্ষণে ১০৪ কোটি টাকা, রামগতি বাজার রক্ষায় এক কিলোমিটারে ব্লক ফেলে নদীর তীর সংরক্ষণে ২৯ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে।
কমলনগর রক্ষা করতে মাতব্বরনগর থেকে লুধুয়া পর্যন্ত প্রায় দশ কিলোমিটার এলাকায় একসঙ্গে তীর সংরক্ষণের দাবি তুলেছেন এলাকাবাসী। তারা বলেছেন, এ এলাকাটি কমলনগরের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। লুধুয়া বাজার এলাকার ভাঙন ঠেকাতে না পারলে ক্রমান্বয়ে এ ভাঙন উপজেলা সদরে এসে পৌঁছাবে। ফলে কমলনগরের অস্তিত্ব হারিয়ে যাবে।
এলাকাবাসীর দাবি, ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নদীর মাঝখানে ডুবোচর খনন করে নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে হবে। এর ফলে একদিকে যেমন ঢাকা-চট্টগ্রাম নৌ-রুট সচল হবে, তেমনি রক্ষা পাবে লক্ষ্মীপুরের কমলনগর। অন্যদিকে ভোলা সদর ও রামদাসপুর রক্ষা পাবে। এর পাশাপাশি মেঘনায় ইলিশের বিচরণ নির্বিঘ্ন হবে। ড্রেজিংয়ে ওঠা বালু জিও ব্যাগ ভর্তি করে নদী তীরে দেওয়া হলে কমলনগরের ভাঙন কমে যাবে। নদী খনন ও তীর সংরক্ষণের কাজটি একই সঙ্গে করতে হবে।
কমলনগরের বাসিন্দারা বলেছেন, পূর্ব অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, মেঘনার এক স্থানে ভাঙন প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেওয়া হলে এর প্রভাবে স্রোতের ধারা অন্য এলাকায় গিয়ে আঘাত করে। চাঁদপুরের হাইমচরের ভাঙন ঠেকানো হয়েছে ঠিকই, কিন্তু এর প্রভাবে নিচের এলাকায় ভাঙন দেখা দিয়েছে। আবার ভোলা সদর ও দৌলতখানে ভাঙন প্রতিরোধের যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তাতে কমলনগরে ভাঙনের তীব্রতা বেড়েছে।
স্থানীয় সূত্র বলছে, কমলনগরে ভাঙন প্রতিরোধের ব্যবস্থা নেওয়া হলে এর প্রভাবে কোনো জনপদ ভাঙার সম্ভাবনা কম। কমলনগরকে রক্ষা করা হলে এর নিচের দিকে রামগতিকে রক্ষার জন্য যে ১৩৫ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে, তার প্রয়োজন ছিল না।
ভাঙন প্রতিরোধ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন চর ফলকন ইউপি চেয়ারম্যান আশরাফ উদ্দিন। স্থানীয় উদ্যোগে নদীতে জিওব্যাগ ফেলে ভাঙন রোধের চেষ্টাও করেছেন তিনি। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কমলনগর রামগতিতে মেঘনার ভাঙনের উৎসস্থল বাত্তিরখাল থেকে লুধুয়া পর্যন্ত দশ কিলোমিটার। এ অংশে তীর সংরক্ষণের কাজ করা হলে পরের স্থানগুলোর ভাঙন প্রাকৃতিকভাবেই বন্ধ হয়ে যাবে। ভাঙনের উৎস্যস্থলে কাজ না করে নিচের অংশে কাজ করলে তা টেকসই হবে না। বরং কমলনগরের মতো জনপদ বিলীন হয়ে যাবে।
তিনি বলেন, কাজ শুরুর আগে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় ও ভূমি মন্ত্রণালয়কে সরেজমিন পরিদর্শন করে প্রকল্প বাস্তবায়নের অগ্রাধিকার এলাকা চিহ্নিত করতে হবে। এর ফলে এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের অভিমতও উঠে আসবে। ভাঙন রোধ সহজ হবে।
কমলনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ আব্দুল আওয়াল বলেন, ভাঙন রোধে সরকার বড় ধরনের একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এর ফলে কমলনগর রামগতির ভাঙন রোধ হবে বলে আশা করা যায়।
সূত্র বলছে, লক্ষ্মীপুর জেলার রামগতি ও কমলনগর উপজেলা ও তৎসংলগ্ন এলাকা মেঘনা নদীর অব্যাহত ভাঙন প্রতিরোধ প্রকল্প গ্রহণ করেছে সরকার। পাঁচ বছরে বাস্তবায়নযোগ্য এ প্রকল্পে বরাদ্দ রাখা হয়েছে প্রায় ১৩০০ কোটি টাকা। এরই প্রথম পর্যায়ের কাজের জন্য ১৯৮ কোটি টাকা একনেক অনুমোদন করেছে।
[পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোনো খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: [email protected] ]
বাংলাদেশ সময়: ০৮৫২ ঘণ্টা, অক্টোবর ১০, ২০১৪