চর মদনপুর, ভোলা ঘুরে এসে : বছর ঘুরলেও বদলায়নি দ্বীপ মদনপুর। এক বছর আগের চিত্রের সঙ্গে এখনকার চিত্রের কোন পার্থক্য নেই।
এক বছর আগে বাংলানিউজের সরেজমিন ঘুরে দেখা উপকূলের দ্বীপ জেলা ভোলার চর মদনপুরের এখনকার অবস্থা এমনই। সেই অভাবী মানুষ, সেই বিপন্ন রাস্তাঘাট, সেই ভাঙণ কিনারের খেয়াঘাট। জোয়ারে পানি বাড়লে মানুষদের এখনও গন্তব্যে ফিরতে হয় সাঁতরে। নারী-পুরুষ এমনকি শিশুরাও একইভাবে পারাপারের দৃশ্য চোখে পড়ে। চাষিরা অনেক আশা নিয়ে তাকিয়ে থাকেন সবুজ ধানক্ষেতের দিকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ফসল ঘরে উঠবে কীনা, তা জানে না তারা। কারণ দুর্যোগ এদের পিছু ছাড়ে না।
ঠিক গত বছরের মত এবারও এখানকার মানুষের অসুখে পথ্য মেলে না। মুমুর্ষু রোগী নিয়ে নদীর তীরে দাঁড়িয়ে সৃষ্টিকর্তাকে ডাকা ছাড়া আর কোন পথই থাকে না। চরের পাটোয়ারী বাজারে একটিমাত্র কমিউনিটি ক্লিনিক এবারও গিয়ে বন্ধ পাওয়া গেছে। ক্লিনিকের ডাক্তার আসেন মেঘনার ওপার থেকে। তার আসা-যাওয়া নির্ভর করে নদীর অবস্থা ও আবহাওয়ার ওপর। আর এর ভোগান্তি চরের মানুষের ওপর। কোনমতে অষুধের নাম জানা কয়েকজন গ্রাম ডাক্তার এই চরের মানুষদের ভরসা।
চরের এক প্রান্ত চর পদ্মা। মদনপুর ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ড। এখানে দাঁড়িয়ে কথা বলার সময় ছুটে এলেন অনেকজন নারী-পুরুষ। তাদের অনেক অভিযোগ। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তারা চরম সংকটে রয়েছেন। কথা বলতে বলতে অভিযোগকারীদের দল ভারি হয়, তালিকা লম্বা হতে থাকে অভিযোগের। শফিকুল ইসলাম, আবুল কালাম, হাবিবুল্লাহ, নূরু মহাজন, আনিসুল হক মাঝি, মনসুরা বেগম। প্রত্যেকেরই পৃথক সমস্যা।
এই মানুষেরা সব হারিয়ে নি:স্ব হয়ে এই চরে এসে ঠাঁই নিয়েছেন। কেউ নিজের জমিতে, কেউবা থাকেন অন্যের জমিতে। মেঘনার দিকে তর্জনী উঁচু করে কয়েকজন বললেন, এই নদী সব শেষ করেছে। এখন আবার এই চরও গ্রাস করছে। এরপর আমরা কোথায় যাব? তথ্য প্রদানকারী চরবাসীর মধ্যে কয়েকজন আবার ভাঙণের কারণে এরইমধ্যে কয়েকবার বাড়ি বদল করেছেন।
চরের মূল কেন্দ্র পাটোয়ারী বাজারে পৌঁছানোর আগেই বহু মানুষের ভিড়। নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের মধ্যেও কয়েকজন আছেন। বাজারের সবচেয়ে বড় হোটেলে বসে আলাপের সময় বাসিন্দাদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল এখানকার প্রধান সমস্যা কোনটি। সবার এক উত্তর-আবহাওয়াজনিত সমস্যা। এখানকার মানুষেরা প্রতিনিয়ত ঝড়ের সঙ্গে লড়াই করে টিকে আছেন। বাতাসের ঝাপাটায় বাড়িঘর ভাঙে, জোয়ারে ডুবে মাঠঘাট। গত এক বছরে এখানে বড় কোন ঝড় না হলেও জোয়ারের পানিতে ডুবেছে কয়েকবার।
শিক্ষাকে দ্বিতীয় সমস্যা হিসাবেই দেখালেন এলাকার মানুষেরা। সরকার প্রায় শতভাগ শিশুর স্কুলে উপস্থিতির তথ্য দিলেও এই চরের ৬০ ভাগ শিশু এখনও স্কুলে যেতে পারে না বলে জানালেন চরের বাসিন্দারা। দারিদ্র্যের কারণে স্কুল গমনোপযোগী শিশুদের বড় অংশ নদীতে মাছ ধরে। চরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত হেঁটে এমন অনেক শিশুর দেখা মেলে। এক বছরে অবস্থার খুব একটা বদল হয়েছে বলে দৃষ্টান্ত তুলতে পারলেন না এলাকাবাসী।
মদনপুরার তৃতীয় সমস্যা স্বাস্থ্য-চিকিৎসা বলে অভিমত দেন এলাকাবাসী। এক্ষেত্রেও গত এক বছরে বিশেষ কোন পরিবর্তন হয়নি। গতবছরও এখানে কমিউনিটি ক্লিনিক ছিল। তবে সেটি গত বছরের মত এবারও তালাবদ্ধ দেখা গেছে। চরের পল্লী চিকিৎসক তপন মজুমদার বলেন, এখানে প্রসবকালীন সমস্যাটাই সবচেয়ে মারাত্মক। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দাই নেই। জরুরি ভিত্তিতে ভোলায় যাওয়া অত্যন্ত কঠিন। ডায়রিয়া মৌসুমে পর্যাপ্ত পরিমাণে স্যালাইন পাওয়া যায় না। চরের শিশুদের নিউমোনিয়া দেখা দেয়।
চরবাসীর তালিকায় চতুর্থ নম্বরের সমস্যাটি স্যানিটেশন। যে পানিতে গোসল, সেই পানিতেই থালা-বাসন ধোয়ার কাজ সারতে হয়। খাবার পানি আনতে হয় অনেক দূরে গিয়ে। গোটা চরে ৫০টি গভীর নলকূপ থাকলেও এর কিছু আবার সবসময় বিকল থাকে। এরফলে চরের মানুষ পানিবাহিত নানান রোগবালাইয়ে আক্রান্ত হয়। পাকা লেট্রিন ব্যবহারে দেশ অনেক সফল বলে জাতীয় পর্যায়ে প্রচার থাকলেও এই চরে পাকা লেট্রিন নেই বললেই চলে।
চরের বাসিন্দাদের দেওয়া তথ্য বলছে, এখানে যোগাযোগ, যাতায়াত, দুর্যোগকালীন নিরাপত্তায় অনেক সমস্যা এখনও রয়েছে। সম্প্রতি দুটো সাইক্লোন শেলটারের কাজ শেষ হয়েছে। এতে মানুষের মাঝে কিছুটা আশা জাগলেও বেড়িবাঁধ না থাকায় এখানকার মানুষের মাঝে শংকা থেকেই যায়। এলাকাবাসী বহুবার বেড়িবাঁধের দাবি তুললেও এ বিষয়ে কোন কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। চরের পশ্চিম প্রান্ত থেকে পূর্ব প্রান্ত পর্যন্ত যেতে তিনটি খাল সাঁতরাতে হয়। পায়ে হাঁটা ছাড়া বিকল্প কোন ব্যবস্থা এখানে নেই।
ভোলার দৌলতখান উপজেলার আওতাধীন এই চরটি ভোলা-২ আসনের অন্তর্ভূক্ত। লোকসংখ্যা ১১ হাজারের ওপরে। এই মানুষগুলো নির্বাচনের আগে অনেক প্রতিশ্রুতির কথা শোনে। কিন্তু নির্বাচনের পরে কেউ প্রতিশ্রুতি রাখের রাখেন না। বিশেষ কোন উপলক্ষ ছাড়া এই চরে মন্ত্রী-এমপিদের দেখা যায় না।
চরের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি লুৎফর রহমান পাটোয়ারী বাংলানিউজকে বলেন, গত পাঁচ-দশ বছরে এ চরের বিশেষ কোন উন্নয়ন ঘটেনি। পশ্চিম দিকে মেঘনার ভাঙণ ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদ নতুন ভবনের কিনারে চলে এসেছে ভাঙণ। বহু মানুষ বাড়িঘর বদল করে চরের ভেতরের দিকে এসে ঠাঁই নিয়েছে। অবিলম্বে ভাঙণ রোধের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
ওয়ার্ড মেম্বার মো. ফারুক দৌলত বলেন, ঝুঁকি অনুযায়ী এখানকার মানুষের জন্য বরাদ্দ তূলনামূলক খুবই কম। ফলে চরের বিশেষ কোন পরিবর্তন ঘটেনি। চরের চারিদিকে বেড়িবাঁধ দিয়ে মেঘনার ভাঙণ ও ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে চরের মানুষকে রক্ষার উদ্যোগ নিতে হবে।
[ পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোন খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: [email protected] ]
বাংলাদেশ সময় : ০২১৪ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৪, ২০১৪