ঢালচর, মনপুরা, ভোলা ঘুরে এসে : ‘ডাহাইতের (ডাকাতের) ভয়ে রাইতে যাইয়া উডি গাছে। দিন অইলে থাহি ডগিয়ে ডগিয়ে (বিলে)।
দ্বীপ ভোলার মনপুরার ঢালচরের বাসিন্দা ছকিনা বিবি এভাবেই বাংলানিউজের কাছে বলছিলেন তার চরে বসবাসের সমস্যার কথা। এই দুর্গম জনপদে নারীরা যে কতটা নিগ্রহের মধ্যে বসবাস করতে বাধ্য হয়, তার পুরোটাই বোঝা যায় এই নারীর সঙ্গে মাত্র দশ মিনিটের আলাপে। জীবনের কোন নিরাপত্তা নেই এদের। একদিকে দস্যুদের ভয়, অন্যদিকে ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের তান্ডব। ছকিনার মত নারী প্রধান পরিবারের সংকট আরও বেশি।
আলাপে ছকিনা বলেন, ‘তিন মাসের মধ্যে বাগানের তন (থেকে) আইতে পারি নাই। থাকতাম খালের ভেতর, নালের ভেতর। ধান করতে গেছি। ধান উডাইছি। বুকের মধ্যে পিস্তল ধরি ধান লইয়া গ্যাছে। ৫০ কেজি বস্তার ১৩৫ বস্তা ধান লইয়া গ্যাছে। চাইলাম। আর দিল না। আমার মালিকের কাছে কাইছি। মালিক বলে ধৈর্য্য ধরতে। ধৈর্য্য ধরতে ধরতে এই পর্যন্ত আইছি। আর পারতেছি না। ’
চরের নারীরা সারাক্ষণ ভয়ের মধ্যে থাকেন। দস্যুদের দল শুধু বাড়িঘরের সম্পদ লুণ্ঠন করেনা, অসহায় নারীদের ইজ্জতও করে। সেটাই ফুটে ওঠে ছকিনা বিবির কণ্ঠে। ছকিনা বলেন, ‘কোস্টগার্ড আওয়ার পর ওরা আমাগো দূরে থাহি হামকি ধামকি দেয়। ঘাইসসার চর আর ঠ্যাংগার চরে আছে টিপু আর কৃষ্ণা। এই দুইডা মাইনসে মাইরা আমাগো লাইডাইয়া হালাইতাছে। এই দুগগার জ্বালায় রাইত অইলে ঘুমাইতাম পারি না। মোবাইলে জ্বালায়। ’
ছকিনা বলেন, ‘যদি কোস্টগার্ড ইয়ানে (এখানে) না আইতো তো কত মার (মায়ের) যে ইজ্জত যাইত, কত নারী যে ডাহাইতের আতে (হাতে) যাইত হিসাব থাকতো না। নারীদের ইজ্জত দেওন ছাড়া কোন উপায় নাই। চেয়ারম্যানের কাছে বিচার দিলে হে কয় তুই বেশি কতা কও। এহন যে আমরা নারীরা থাকতাম পারি না, হে কতা কইলে হেতার (তার) মাথা গরম অইয়া যায়। ’
এলাকার চেয়ারম্যান-মেম্বারসহ গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের কাছে গিয়ে বিচার না পাওয়ার অভিযোগ করেন ছকিনা বিবি। তার অভিযোগ তার মত অনেক নারীর কথা কেউ শোনে না। এইসব নারীদের জীবনের নিরাপত্তা দিতে কেউ এগিয়ে আসে না। একই সঙ্গে দস্যু আর দুর্যোগের সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে থাকতে হয় তাদের।
ছকিনা জানালেন, সাহসী ভূমিকার কারণে তাকেও একটি গ্রুপের রোষানলে পড়তে হয়েছে কয়েকবার। এ নিয়ে আবার এলাকায় চলে নোংরা রাজনীতি। ছকিনা বলেন, ‘ডাহাইত লাগাই (লাগিয়ে) দিছে আমারে কাডি (কেটে) হালাই (ফেলে) দেয়ার লাই (জন্য)। উত্তরের চরে ৪-৫জন লিডার। হেগুলারে (সেগুলোকে) রাকছে (রেখেছে) চেয়ারম্যান। উগগার (একটার) কাছে দুগগা (দুইটা) তিনগা (তিনটা) পিস্তল। এগুলি ডাকাইতের কাছ থেকে উদ্ধার করি ওরা ব্যবহার করে। ’
দুর্গম চরের এক সংগ্রামী নারীর নাম ছকিনা। স্বামী ফেলে রেখে যাওয়ায় তার নাম মুখেও আনতে চান না। জন্মস্থান মনপুরাতেই বেড়ে উঠেছেন। বিয়ে সূত্রে এই বিভিন্ন চরে বসবাসের পর এসেছেন ঢালচরে। এরমধ্যে সন্তান না হওয়ায় ছকিনা এখন একাই থাকেন। চরের ডেমপিয়ার কৃষি ও ডেইরি ফার্মের ম্যনেজিং ডিরেক্টর কামাল উদ্দিন চৌধুরী তাকে ৫ একর জমি দিয়েছেন। এই জমিতে চাষাবাদ ও সবজি আবাদ করে ছকিনার জীবিকা চলে।
ছকিনা জানালেন, নিজের জমিতে নিজেই আবাদ করেন। এবার আমন ধান আবাদ করেছেন। ১০০ থেকে ১২০ মন ধান পাওয়ার আশা করেন। এটাই তার সারা বছরের জীবিকার অবলম্বন। কিন্তু ধান ঘরে তুলতে না পারলে সে স্বপ্ন ভেঙ্গে যাবে। জমির পাশে ছকিনার ছোট্ট ঘর। এখানেই থাকেন। বিকল্প আয়ের লক্ষ্যে ঘরের পাশে সবজি চাষ করেন আর হাঁস-মুরগি পালন করেন।
স্বামী ফেলে রেখে চলে যাওয়ায় ছকিনার কোন আক্ষেপ নেই। নিজের একখন্ড জমিতে আবাদ করে নিজে ভালো চলতে পারেন। কারও কাছে হাত বাড়াতে হয় না। তবে নিরাপত্তার দাবিটাই তার কাছে প্রধান। ঢালচরে কোস্টগার্ডের ‘কোস্টাল ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট সেন্টার (সিসিএমসি)’ স্থাপনের খবরে সব চরবাসীর মত ছকিনাও অনেক আশা নিয়ে দিন গুনছে। হয়তো এই চর মুক্ত হবে দস্যুদের হামলা থেকে। ফিরে আসবে শান্তি।
ছকিনাসহ দুর্গম চরের আরও অনেক নারীর জীবনের গল্প শেষ হয় না। একের পর এক সংগ্রাম। দস্যু আর ঝড় দুই ভয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জীবিকার লড়াইও করতে হয় সমান তালে। কখনো মাছধরা, কখনো হালচাষ করা, আবার কখনো কলাকচু বিক্রির জন্য হাটে যাওয়া। দুর্যোগ এলে কিংবা দস্যুদের হামলা হলে সব হারাতে হয়। তারপর আবার ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা। এভাবেই ঢালচরে টিকে আছেন ছকিনারা!
[ পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোন খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: [email protected] ]
বাংলাদেশ সময়: ০২৫১ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৭, ২০১৪