ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

‘মোরা খামু কী! মোগো ক্ষতিপূরণ দ্যান...!’

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭২৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ৮, ২০১৪
‘মোরা খামু কী! মোগো ক্ষতিপূরণ দ্যান...!’ ছবি : বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

চর নিশানবাড়িয়া, কলাপাড়া, পটুয়াখালী: কেউ নিজের এক টুকরো জমি আবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন, কেউবা মাছ ধরে চালাতেন সংসার।

জমির ফসলে মিলতো চাষীর সারা বছরের খাবারের সংস্থান।

জমিহারা মানুষেরা গ্রামের পাশের নদীতে মাছ ধরে পরিবারের সদস্যদের মুখে তুলে দিতেন খাবার। কিন্তু যুগ যুগ ধরে চলতে থাকা জীবিকার এই অবলম্বন আর থাকছে না। সরকারের বড় প্রকল্প হাজারও মানুষকে কর্মহীন করছে।

তবে দেশের স্বার্থে সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পের বিরোধিতা করছেন না এলাকাবাসী। তারা জনস্বার্থের বিষয়টি বিবেচনার জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানিয়েছেন। নিয়ম অনুযায়ী, পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণের টাকা যাতে সহজেই পাওয়া যায়, সে দাবিটাই এলাকাবাসীর কাছে প্রধান। সরকারের উদ্দেশে তারা বলেন, ‘মোরা খামু কী! মাগো ক্ষতিপূরণ দ্যান!’   

পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার ধানখালী ইউনিয়নে চাষী আর জেলেরা এখন দিশেহারা। বাপ-দাদার পুরনো সেই ভিটের সঙ্গে তাদের এবার হারাতে হবে দীর্ঘদিনের পেশাটিও। জীবিকার জন্য খুঁজতে হবে নতুন কোনো কাজ। বাড়িঘর আর কাজের সন্ধান না থাকলে অনেককে হয়ত এলাকা ছেড়ে শহরের দিকে ছুঁটতে হবে। চর নিশানবাড়িয়া গ্রামে সরেজমিন আলাপে এমনটাই জানালেন গ্রামবাসী।

কলাপাড়ার রামনাবাদ নদীর তীরে ‘আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল টেকনোলজি’ (Ultra-super Critical Technology) ব্যবহারের মাধ্যমে কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মিত হচ্ছে। এ জন্য এক হাজার একর ভূমি অধিগ্রহণ ও ভূমি উন্নয়নের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে, ৭৮২ কোটি ৬২ লাখ টাকা। এরই মধ্যে এ অর্থ একনেক অনুমোদন করেছে।

প্রকল্প অনুমোদনের পর এলাকার মানুষের মধ্যে শঙ্কা আরো বেড়েছে। গ্রামবাসীর সঙ্গে কথা বলার সময় পাওয়া গেল তাদের ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ। বাড়ি ছাড়ার ‘নোটিস আসছে’ খবর শুনে এরই মধ্যে গ্রামের চারজন হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেছেন। সব বয়সের নারী-পুরুষেরা বিষয়টি নিয়ে এখন চিন্তিত।

মাছুয়াখালী গ্রামের বাসিন্দা আবদুর রহিম। বাপ-দাদার পৈত্রিক সম্পত্তি হিসেবে নিজের আছে ৯ একর জমি। এতে ধান ছাড়াও খেসারি ডাল আর তরমুজ আবাদ করেন। তার শুধু বাড়িটা বাদে পুরো ফসলি জমি প্রকল্প এলাকার ভেতরে যাচ্ছে। এর ফলে তার উপার্জনের পথ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এ জন্য তাকে বিকল্প পথ খুঁজতে হবে। অথচ পূর্বপুরুষেরা ১৯১০ সাল থেকে এই জমিতেই বসবাস করছিলেন।

চর নিশানবাড়িয়ার তৈয়ব আলীর বাবার ছিল পাঁচ একর জমি। এর মধ্যে এক একর চলে গেছে বেড়িবাঁধে। বাকি চার একর থেকে এক একর জমি পেয়েছেন তৈয়ব আলী। এই প্রকল্পে তার এই শেষ অবলম্বনটুকুও চলে যাচ্ছে। সামান্য জমিতে আবাদ আর নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহকারী এই পরিবারটি জীবিকার অন্য পথ খুঁজতে বাধ্য হবে।

মধুপাড়া গ্রামের ইসমাইল তালুকদার ৩৬ একর জমির মালিক। বাড়িসহ প্রায় সব জমি প্রকল্পে চলে যাচ্ছে। অবশিষ্ট থাকছে মাত্র এক একর ৩২ শতাংশ জমি। বাপ-দাদার আমল থেকে এই জমিতে থেকে তিনি নিজের জমিতে আবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন।

গরাৎখাঁ গ্রামের আবদুর রাজ্জাক মোল্লার ২৫ একর জমির মধ্যে ২২ একর হারাচ্ছেন প্রকল্পে। অবশিষ্ট থাকছে ৩ একর। চর নিশানবাড়িয়া গ্রামের নূরুল ইসলামের জমি ছিল ৫ একর। বাবার কাছ থেকে পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া এই জমিতে আবাদ করে চলতো সংসার। কিন্তু এখন তিনি নিঃস্ব হয়ে পড়ছেন। জীবিকার বিকল্প পথ খুঁজতে হবে।

এগুলো ক্ষতিগ্রস্ত বহু পরিবারের মধ্যে কয়েকটি মাত্র। সরেজমিন তথ্য সংগ্রহকালে জড়ো হওয়া গ্রামবাসীদের সবাই নানান অভিযোগ জানাতে আসেন। তাদের প্রত্যেকেরই বাড়ি, জমি, পুকুরসহ সহায়-সম্পদ হারানোর ভয়।

অনেক ভিড়ের মধ্যে একজন বলে উঠলেন, ‘বাপ-দাদার কবরে বালু চাপা পড়বে; সারাজীবন আগুন জ্বলবে; এর চেয়ে আমাদের মরে যাওয়া অনেক ভালো! বাড়ি থেকে নামিয়ে দেওয়ার চেয়ে আমাদের মেরে ফেলেন। ’

চর নিশানবাড়িয়ার বাসিন্দারা জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে দেওয়া আবেদনে বলেছেন, এই এলাকার বেশকিছু মানুষ মেঘনা নদীর ভাঙনে জমিজমা হারিয়ে কলাপাড়ার বিভিন্ন এলাকায় বসবাস করে আসছিল। এদের দুরাবস্থা দেখে তৎকালীন তাদের ২৪০ একর জমি নিয়ে চর নিশানবাড়িয়া নামে পৃথক মৌজা গঠন করে। প্রত্যেক ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে এই মৌজা থেকে ৫ একর করে জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়।

আবেদনে বলা হয়, ১৯৬০-৬৫ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে এই গ্রামের ব্যাপক ক্ষতি হয়। তখন ১৯২ জন লোকের প্রাণহানি ঘটে। এই ক্ষতি থেকে এলাকার মানুষদের বাঁচাতে ১৯৬৭-৬৮ সালে ওয়াপদা বেড়িবাঁধ তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়। ওই বেড়িবাঁধেও এই এলাকার মানুষের জমি অধিগ্রহণ করা হয়।

ওই সময় সরকার এই এলাকার মানুষদের অন্যখানে পুনর্বাসনের আশ্বাস দিলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। বেড়িবাঁধে জমি দিয়ে এই পরিবারগুলো আরও বেশি নিঃস্ব হয়ে পড়ে। প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে থাকা সেই মানুষগুলো এবার চিরতরে উচ্ছেদ হতে চলেছে।

অপরদিকে, এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বরাবরে পাঠানো স্মারকলিপিতে বলা হয়েছে, তাপ বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য ধানখালী ইউনিয়নের মধুপাড়া মৌজায় ৮০০ দশমিক ৩০ একর, চর নিশানবাড়িয়া মৌজায় ১৫ দশমিক ৫০ একর, নিশানবাড়িয়া মৌজায় ১৮৭ দশমিক ৩০ একর জমি অধিগ্রহণের প্রস্তুতি চলছে। এই জমি অধিগ্রহণ করা হলে এলাকায় মানুষের বসবাসের মতো কোনো পরিবেশ থাকবে না। জীবিকার কোনো অবলম্বন থাকবে না। এমনকি প্রকল্পের বাইরেও অন্তত এক হাজার বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

স্মারকলিপিতে আরো বলা হয়, এত বড় প্রকল্প গ্রহণের আগে এলাকার মানুষদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেওয়া উচিত ছিল। সরেজমিন তথ্য সংগ্রহে গেলে এলাকার বাসিন্দারাও একই দাবি তোলেন।

এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত মানুষেরা বলেছেন, প্রকল্প বাস্তবায়নে জনস্বার্থের বিষয়টি সরকারের বিবেচনায় নেওয়া উচিত। অধিগ্রহণ করা জমির অর্থ পেতে সাধারণত বছরের পর বছর সরকারি অফিসে ধর্ণা দিতে হয়। সরকারি দফতরের দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় ভেতর দিয়ে এই টাকা পেতে সাধারণ নাগরিকেরা চরম ভোগান্তিতে পড়েন।

তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের অধিগ্রহণ করার জমির টাকা প্রদানের ক্ষেত্রে এই ভোগান্তি যেন না থাকে, সে বিষয়টিও বিবেচনার দাবি এলাকাবাসীর।     

[পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূবে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামে বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোনো খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়- [email protected]]

বাংলাদেশ সময়: ০৭২৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৮, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।