ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

কুয়াকাটার খুঁটা জালের জীবন!

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১৩৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৩, ২০১৪
কুয়াকাটার খুঁটা জালের জীবন! ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

কুয়াকাটা, পটুয়াখালী : খুঁটা জালে বাঁধা তাদের জীবন। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে দাদনে বন্দি।

যুগের পর যুগ আড়তে মাছ দিয়েও শোধ হয় না এই দাদন।

দেনার দায় থেকেই যায়। তবুও বদলায় না ভাগ্য। বাবার রেখে যাওয়া ছোট্ট ঝুপড়ি কিছুতেই বড় করা সম্ভব হয় না।

দারিদ্র্যের কষাঘাত স্কুলগামী কিশোরদের টেনে নেয় সমুদ্রের নোনাজলের জগতে। ওরাও পোড়খাওয়া অগ্রজের পথ ধরে।

সমুদ্র সৈকত কুয়াকাটার খুঁটা জালের জীবনের গল্পটা এমনই। সৈকতের ১৮ কিলোমিটার তটরেখায় সহস্রাধিক জেলে নৌকা জীবিকার খোঁজে সমুদ্রের পথে যাত্রা করে। সমুদ্রের গভীরে ফেলে রাখা খুঁটা জালে মাছের সন্ধানে যায়। ৎ

কিন্তু এই মাছ বিক্রির টাকা থেকে ১৫ শতাংশ কমিশন দিতে হয় আড়তে। বাইরে মাছ বিক্রির সুযোগ নেই। কারণ আড়তদার তাকে সমুদ্রের মাছ ধরতে যাওয়ার জন্য দাদন দিয়েছেন।

সমুদ্র সৈকতের জিরো পয়েন্ট, হোসেন পাড়া, কাউয়ার চর, গঙ্গামতি এলাকার জেলেরা বলেছেন, ইলিশের ছয় মাসে জেলেদের কাছ থেকে পাওয়া মাছে আড়তদারেরা যে পরিমাণ কমিশন কেটে রাখে, তা দাদনের টাকার পরিমাণের চেয়ে কম নয়। আড়তে ১০০ টাকার মাছ বিক্রি হলে আড়তদার ১৫ টাকা কেটে রাখবে। কমিশনের পরিমাণ কোথাও ২০ টাকা পর্যন্ত।

হোসেন পাড়ার জেলে হাবিব হাওলাদার বলছিলেন, এটাই জেলেদের ঘুরে দাঁড়াতে না পারার অন্যতম কারণ। মৌসুমে সব মাছ আড়তে দিলেও দাদনের টাকা শোধ হয় না। এরফলে জেলেরা তাদের অবস্থা বদলাতে পারে না। বাবা আড়তের দেনা শোধ করতে না পারলে তা ছেলের কাঁধে ওঠে।

সরেজমিন পাওয়া তথ্যসূত্র বলছে, কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত এলাকায় মাছ ধরার কৌশল কিছুটা ভিন্ন। এই এলাকায় প্রায় সব জেলে ইঞ্জিনচালিত ছোট্ট নৌকায় খুঁটা জালে মাছ ধরে। প্রায় দু’ঘণ্টা নৌকা চালিয়ে প্রায় ২০ ফুট গভীর এলাকায় ইলিশের জাল পেতে রাখা হয়। জাল পাতা অবস্থায় জেলেরা সেখান থেকে মাছ তুলে নিয়ে আসে। এভাবেই চলে পুরো মৌসুম। কোনভাবে জাল নষ্ট হলে নতুন জাল প্রতিস্থাপন করা হয়। কুয়াকাটা সৈকতে মাছধরার বড় ট্রলার নেই।

সমুদ্র সৈকতের পথ ধরে হাঁটলে চোখে পড়ে অসংখ্য মাছ ধরার নৌকা। কোনটি সমুদ্রে ভাসছে, আবার কোনটি সৈকতের কিনারে উঠিয়ে রাখা হয়েছে। সারাদিন মাছধরার পর শেষ বেলায় শুরু হয় সমুদ্র থেকে নৌকা উঠানোর পালা। ২৪ ঘন্টায় জেলেরা জাল থেকে দু’বার মাছ তোলেন।

জেলেরা জানান, খুঁটা জালে ইলিশ পাওয়া যায়। এই মৌসুমটা বছরের ছ’মাস। বাকি সময়টা অধিকাংশ জেলে অন্য কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। তবে কিছু জেলে জাল বদল করে অন্য মাছ ধরার চেষ্টা করেন। ইলিশ জালের বদলে ওই সময় তারা ব্যবহার করে ডাডি জাল। এতে বিভিন্ন ধরনের মাছ পাওয়া যায়।

কুয়াকাটা এলাকা জেলেদের আষ্টেপিষ্টে বেঁধে রেখেছে দারিদ্র। অধিকাংশ জেলে বেড়িবাঁধের পাশে ঝুঁপড়ি ঘরে বসবাস করে। কিছু জেলে একখণ্ড জমি নিয়ে বাঁধের ভেতরে আশ্রয় নিলেও তাদের জীবনও চলে ধুঁকে ধুঁকে।

এক সময় বেড়িবাঁধের বাইরে প্রায় তিন কিলোমিটার জমি ছিল। এখন ভাঙণ চলে এসেছে বাঁধের কাছে। বসবাসের স্থান কমে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে নানামুখী সংকট। ২০০৭ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে সমুদ্র পাড়ের জেলে বাড়িগুলো লণ্ডভণ্ড হয়ে গিয়েছিল। অনেকে এলাকা থেকে অন্যত্র চলে গেছেন।

এই এলাকার অধিকাংশ জেলে এক সময় জমি আবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছিলেন। জমিতে আবাদ শেষ করে তারা মাছ ধরতে নামতেন। কিন্তু এখন জমি আবাদের সুযোগ হারিয়ে গেছে। সবাইকেই নামতে হচ্ছে মাছ ধরতে। কিন্তু নানামুখী প্রতিবন্ধকতায় মাছ ধরাও অনেকের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না।   ফলে মাছ ধরার পাশাপাশি অনেকে পর্যটন কেন্দ্রিক কাজ খুঁজছেন, কিংবা ক্ষুদ্র ব্যবসা করার চেষ্টা করছেন।

জেলে মো. মনির জানালেন, আট বছর বয়স থেকে মাছ ধরা শুরু করেছেন তিনি। এখনও একই অবস্থায়। নিজের অর্থনৈতিক অবস্থার কোন পরিবর্তন করতে পারেননি। এ কারণে ইলিশের সময় ইলিশের জাল আর অন্য সময় অন্য জাল দিয়ে মাছ ধরে।

তিনি বলেন, দাদনের কারণে এ অবস্থা হয়েছে। দাদন দিয়ে জেলেদের কিনে নেওয়া হয়। জেলেরা দাদনদারের কাছে বন্দি থাকে।

সূত্র বলছে, কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত এলাকায় ছোট মাছধরা নৌকায় চারজন লোকের প্রয়োজন হয়। আর একটি নৌকা নিয়ে মাছ ধরতে নামতে দরকার দুই লাখ টাকা। এই পুরো টাকাটাই আসে দাদনদারের কাছ থেকে। এই টাকার বিনিময়ে জেলেরা দাদনদারের আড়তে মাছ দিতে চুক্তিবদ্ধ হয়। সারা মৌসুম মাছ দিলেও দাদনের টাকা শোধ হবে না। প্রত্যেকবার মাছ বিক্রি থেকে কমিশন নেবে দাদনদার। অনেক পরিশ্রমের বিনিময়ে পাওয়া মাছের কমিশন নেওয়া না হলে জেলেরা মাছের ন্যায্য মূল্যটা হাতে পেত। তাদের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটতো।

তবে দাদনদারেরা বলেছেন ভিন্ন কথা। তারা বলেন, জেলেকে মাছ বিক্রির সুযোগ করে দিতেই আড়তের কমিশন নেওয়া হয়। আর দাদন দিয়ে জেলেদের মাছ ধরতে সহায়তা করা হচ্ছে। এতে তারা উপকৃত হচ্ছে।        

[ পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোন খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: [email protected] ]

বাংলাদেশ সময়: ০১১৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৩, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।