উপকূলের সিডর বিপন্ন জনপদ ঘুরে : ঝড়ের ঝাপটায় পড়ে যাওয়া গাছে আটকা পড়লো কিশোরীর হাত। বাড়তে থাকলো পানি।
এটা বাগেরহাটের সাউথখালী গ্রামে সিডর রাতের এক হৃদয়বিদারক গল্প। বিধ্বস্ত রাস্তা দিয়ে দুই মেয়েকে নিয়ে আশ্রয়ের খোঁজে যাচ্ছিলেন মা শেফালি বেগম। পথেই ঘটে দুর্ঘটনা। মায়ের আহাজারি থামে না কিছুতেই। সিডরের সেই ভয়াল রাতের সাত বছর পরেও গুমরে কাঁদেন এই নারী।
এই দলে শেফালি একা নন। হাজারো গল্পের সাক্ষী সাউথখালী। বহু মানুষ সব হারিয়ে এখন পথে বসেছে। অনেকে এলাকা ছেড়ে চলে গেছে অন্যত্র। বহু ছেলেমেয়ের বন্ধ হয়ে গেছে লেখাপড়া। জীবিকার ধরন বদলে গেছে। অনেকে নিজের বাড়ি হারিয়ে থাকছেন অন্যের বাড়িতে। সিডরের পর ব্যাপক সাহায্য-সহযোগিতা এলেও ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি মানুষগুলো। সিডর বিপন্ন অঞ্চল ঘুরে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার খোঁজ নিয়ে বাংলানিউজ এসব তথ্য পেয়েছে।
২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর রাতে এই সাউথখালী গ্রামে আঘাত হেনেছিল ঘূর্ণিঝড় সিডর। গোটা এলাকা পরিণত হয়েছিল ধ্বংসস্তূপে। খাবার আর পরিধানের এক টুকরো কাপড়ের সন্ধানে বিপন্ন মানুষেরা ছুটেছে এখানে সেখানে। ২-৩ দিন অনাহারে থাকার পর মিলেছে সামান্য খাবার। শুধু সাউথখালী নয়, বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলাসহ পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে প্রচণ্ড আঘাতে তছনছ করে দেয় সিডর।
সিডরের প্রায় সাত বছর পূর্ণ হলেও বিপন্ন মানুষেরা মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। এলাকায় প্রচুর পরিমাণে সাহায্য এলেও দিন আনা দিন খাওয়া মানুষের অবস্থা সেই আগের মতোই। সিডর সহায়তার অধিকাংশই জরুরি খাদ্য সহায়তা হওয়ায় বিপন্ন মানুষদের ঘুরে দাঁড়ানোর ব্যবস্থা খুব একটা হয়নি। সাহায্য হিসেবে পাওয়া ঘরে থাকার পরিবেশ নেই। সিডরের প্রলয়ে সারা জীবনের জমানো সম্পদ হারিয়ে বহু মানুষ চরম সংকটে দিন কাটাচ্ছেন। দেনার বোঝা বয়ে তারা এখন ক্লান্ত।
বাগেরহাটের সর্বদক্ষিণে শরণখোলা উপজেলার সাউথখালী ইউনিয়ন। এ ইউনিয়নের সর্বদক্ষিণে বলেশ্বর নদী তীরবর্তী এলাকায় আঘাত হেনেছিল সিডর। ভয়াবহ এই প্রলয়ে মাটির সঙ্গে মিশে যাওয়া গ্রামগুলো ফিরে পেয়েছে প্রাণচাঞ্চল্য। বাড়িঘর উঠেছে, গাছপালা মাথা তুলেছে, জেলেরা আবার জালনৌকা নিয়ে আবার ফিরছে নদীতে। কিন্তু এই প্রাণচাঞ্চল্যে যেন কোনো ‘প্রাণ’ নেই। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, নিতান্তই বেঁচে থাকতে হয় বলে মানুষগুলো জীবন সংগ্রামে মনোযোগ দিয়েছে।
সিডরে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা সাউথখালী ইউনিয়নের গাবতলা, উত্তর ও দক্ষিণ সাউথখালী গ্রাম ঘুরে বাংলানিউজ বিপন্ন মানুষদের বোবা কান্না অনুভব করতে পেরেছে। একই সঙ্গে বাবা-মা-বোন হারানোর বেদনা, ছেলে কিংবা মেয়ে হারানোর বেদনা কী করে ভুলে যাবে এই এলাকার মানুষ। দুর্যোগ যেন এক একটি জীবনই বদলে দিয়েছে। হয়তো ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনি সবাই চলে গেছে, শুধু বেঁচে আছেন একজন বৃদ্ধা। ঘরসহ সাহায্য সহযোগিতার অনেক কিছুই বেঁচে থাকা এই বৃদ্ধার ভাগ্যে জোটেনি, কারণ তার নিজের নামে কিছুই ছিল না। এভাবে ভাসমান অনেক মানুষের কান্নায় এখনও ভারি হয়ে রয়েছে সাউথখালীর বাতাস।
সাউথখালী ইউনিয়ন পরিষদ ভবন থেকে খানিক দূরে পুরনো লঞ্চঘাট। এক সময় এখানে জমজমাট ঘাট ছিল। লঞ্চ আসতো বিভিন্ন এলাকা থেকে। সেই ঘাটটি বহু আগে বলেশ্বরের স্রোতে হারিয়ে গেলেও এখনও এলাকাটিকে সবাই লঞ্চঘাট হিসেবেই চেনে। সিডরের পানির তোড়ে এ এলাকার বাড়িঘর ভেসে গিয়েছিল। ভেসে যাওয়া মানুষেরা সিডরের পরের ভোরে এসে নিজের বাড়ি চিনতে পারেন নি। সেই মানুষগুলো এখনও সেখানেই বসবাস করছেন। সেই আগের পেশা, আগের মতই ধুঁকে চলা।
নদী তীরে নতুন বেড়ি বাঁধের গা ঘেঁষে আবদুল মালেক মৃধার ছোট্ট ঘর। সিডরের পর ত্রাণ হিসেবে একটা ঘর পেয়েছিলেন। কিন্তু এ ঘরটা এতই ছোট ছিল যে, চারদিকে বারান্দা দিয়ে ঘরটি বড় করতে হয়েছে। দুই কক্ষের যে ঘর পেয়েছিলেন, তাতে বসবাস করা সম্ভব ছিল না। মালেক পুরনো পেশায় ফিরতে আবার জালনৌকা তৈরিতে মনোযোগ দিয়েছেন। সিডরের আগে একটা বড় ট্রলার থাকলেও এখন বানিয়েছেন ছোট্ট ট্রলার। ত্রাণ হিসেবে ১০ কেজি মাছধরার জাল পেয়েছিলেন। কিন্তু এর সঙ্গে আরও কিনতে হয়েছে। এসব করতে গিয়ে তিনটি এনজিওতে দেনা আছেন প্রায় এক লাখ টাকা। অন্তত বছর খানেক এই দেনা বইতে হবে তাকে।
আরেকজন আবদুল কাদের। পুরনো লঞ্চঘাটের কাছে নতুন বেড়ি বাঁধ থেকে খানিক দূরে রাস্তার পাশে ছোট্ট ঘর। একখানা ত্রাণের ঘর তার ভাগ্যেও জুটেছে। কিন্তু একই অবস্থা। ঘরটি খুবই ছোট হওয়ায় আশপাশে বারান্দা দিয়ে ঘর বড় করতে হয়েছে। তিনিও প্রায় এক লাখ টাকা দেনা আছেন।
আব্দুল কাদের বাংলানিউজকে বলছিলেন, সিডরের পর প্রায় তিন মাস আমরা কাজ না করেই খাবার পেয়েছি। কিন্তু একপর্যায়ে তো আমাদের কাজে নামতে হয়েছে। মাথা তোলার মতো সহায়তা খুব সামান্যই মিলেছে।
সরেজমিনে বলেশ্বর তীর ও সুন্দরবন লাগোয়া গ্রাম ঘুরে দেখা গেলো, সিডরে পথে বসে যাওয়া মানুষেরা পুনরায় বেঁচে থাকার চেষ্টায় নানা উদ্যোগ নিয়েছে। কেউ দোকান করেছে, কেউ নৌকা মেরামত করে আবার নদীতে মাছ ধরতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে, কেউবা মাছের পোনা ব্যবসায় নেমেছেন। আলাপে অনেকেই অভিযোগ করলেন, ক্ষতিগ্রস্তদের ঘুরে দাঁড়াতে যে সহায়তা এসেছে, তা যথাযথভাবে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের কাছে পৌঁছেনি। আর সে কারণেই বহু মানুষ দেনার ভারে ন্যুয়ে পড়েছে।
সিডর পরবর্তী উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নকারী স্থানীয় বেসরকারি সংস্থা অগ্রদূত ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক আইউব আলী আকন বাংলানিউজকে বলেন, সাহায্যের জন্য হাত বাড়িয়ে দেওয়ার অভ্যাস গড়ে ওঠায় এই এলাকার বিপন্ন মানুষেরা ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। সিডরের পর বিভিন্ন ধরনের কাজের সুযোগ হয়েছে এ এলাকায়, এখনও হচ্ছে। কিন্তু এ কাজে স্থানীয় মানুষদের পাওয়া যায় না। একমাত্র অলসতাই তাদের পিছিয়ে রেখেছে।
[পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোন খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: [email protected] ]
বাংলাদেশ সময়: ০০২৯ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৫, ২০১৪