উপকূলের সিডর বিপন্ন জনপদ ঘুরে : সিডর বিধ্বস্ত জনপদে কোটি কোটি টাকা এলেও মানুষের টেকসই উন্নয়ন ঘটেনি। ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন কিংবা তাদের ঘুরে দাঁড়াতে গৃহিত প্রকল্পের সুফল মিলেছে সামান্যই।
ওদিকে দুর্যোগের ঝুঁকি কমাতে গৃহিত প্রকল্পেও ভুলভ্রান্তি ব্যাপক। সাইক্লোন শেলটার হয়েছে তো রাস্তা হয়নি। যেখানে সাইক্লোন শেলটার প্রয়োজন সেখানে হয়নি। আবার যেখানে প্রয়োজন নেই, সেখানে একাধিক শেলটার।
ঝুঁকি অনুপাতে বাঁধের উচ্চতা অনেক কম। আবার বাঁধের নির্মাণ কাজ সম্পর্কেও এলাকার মানুষের অভিযোগের অন্ত নেই। ঘূর্ণিঝড়ের সিগন্যাল সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করা হলেও আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে এখনও অনেক বাধা রয়েছে।
সিডর বিপন্ন এলাকায় সরেজমিনে তথ্য সংগ্রহে গেলে এসব কথাই একের পর এক বলতে থাকেন এলাকার মানুষ। সিডরের পর সাত বছরে বিপন্ন এলাকা কতোটা বদলাতে পেরেছে, তারই খোঁজে বাংলানিউজ ঘুরেছে উপকূলের বিভিন্ন এলাকায়। ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বরের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় সিডরের তাণ্ডবে বাগেরহাট, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলা সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়ে।
সরেজমিনে পাওয়া তথ্যসূত্র বলছে, সিডরের মত প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবের মুখে পড়ে শরণখোলার সাউথখালীসহ আশপাশের এলাকার মানুষ এখন দুর্যোগে অতিমাত্রায় সচেতন। এক সময় ৫ নম্বর সিগন্যালও যে মানুষগুলোকে ঘর থেকে বের করতে পারতো না, তারা এখন আকাশে মেঘ দেখলেই আশ্রয়ের সন্ধানে যাওয়ার প্রস্তুতি নেন। কিন্তু মানুষের এই সচেতনতার সঙ্গে তাল রেখে এলাকার অবকাঠামোগত উন্নয়ন ঘটেনি।
সরেজমিন ঘুরে জানা গেছে, সিডরের পর সাউথখালী ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় সাইক্লোন শেলটার হলেও এতে ধারণ ক্ষমতা অনেক কম। ঘূর্ণিঝড় সতর্ক সংকেত ঘোষণা হলে এই শেলটারগুলোতে তিল ধারণের ঠাঁই থাকে না। অনেকে শেলটারে জায়গাও পান না। একই স্থানে একাধিক শেলটার রয়েছে, আবার ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় শেলটার নেই। অনেকগুলো আবার রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ব্যবহার অনুপযোগী। অনেক স্থানে শেলটারে যাওয়ার রাস্তাঘাটের অবস্থা খারাপ।
সূত্র বলছে, সিডরের পর সাউথখালী ইউনিয়নে বেশকিছু সাইক্লোন শেলটার এবং স্কুল কাম সাইক্লোন শেলটার নির্মাণ করা হয়েছে। পুরানো শেলটার সংস্কারও হয়েছে। নির্মিত হয়েছে রাস্তাঘাট। কিন্তু এসব কার্যক্রম পরিচালনায় সমন্বয়ের যেমন অভাব ছিল, তেমনি মানুষের ঝুঁকির বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। আর এ কারণেই ইউনিয়নের ২৩টি স্থানে ২৯ সাইক্লোন শেলটার ও স্কুল কাম সাইক্লোন শেলটার নির্মিত হয়েছে। অনেক স্থানে রাস্তাঘাট খুবই খারাপ।
ধারণ ক্ষমতা বিবেচনায় এ এলাকায় আশ্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা খুবই কম। রায়েন্দা ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডে শেলটার আছে মাত্র একটি। এর ধারণ ক্ষমতা ৬০০। অথচ এই ওয়ার্ডে লোকসংখ্যা প্রায় ৬ হাজার। বাকি লোকের আশ্রয়ের সুযোগ নেই। গোটা শরণখোলা উপজেলায় বড় দুর্যোগ হলে মাত্র ১০ ভাগ মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে জায়গা পাবে। আশ্রয়কেন্দ্রে অন্যান্য সুযোগ সুবিধাও রয়েছে নামেমাত্র। দুর্যোগের সময় নিচু টয়লেট ব্যবহারের সুযোগ থাকে না। কিন্তু অধিকাংশ আশ্রয়কেন্দ্রে উঁচু টয়লেটের ব্যবস্থাই নেই।
রায়েন্দা ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য শাহজাহান বাদল জোমাদ্দার বাংলানিউজকে বলেন, রাস্তাঘাটের সমস্যার কারণে সিডরের সময় এই এলাকার বহু মানুষ আশ্রয়ে ফিরতে পারেনি। কিন্তু এখনও রাস্তাঘাটের তেমন কোন উন্নয়ন ঘটেনি। তবে মানুষের সচেতনতা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে।
উত্তর সাউথখালী গ্রামের লোকমান হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, সিডরের পর সাইক্লোন শেলটার হলেও সেখানে যাওয়ার রাস্তাঘাটের উন্নয়ন হয়নি। শেলটারে গিয়ে দাঁড়ানোর জায়গাও পাওয়া যায় না। আমরা নদীর কূলে থাকি। এখানে যে নতুন বেড়িবাঁধ বানানো হয়েছে, তা ততোটা শক্ত হয়নি।
তবে সিডরের পর দুর্যোগ বিষয়ে মানুষের সচেতনতা যে বেড়েছে, তা বোঝা যায় এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বলে। কাউকে এখন আর সাইক্লোন শেলটারে যেতে বলতে হয় না। নিজের ইচ্ছায়ই তারা ছোটেন শেলটারে। তাফালবাড়ি বাজারের কাছে পুরাতন লঞ্চঘাটের বাসিন্দা আব্দুল মালেক মৃধার স্ত্রী রাহিমা বেগম অনেকটা মুখস্তই বলে ফেললেন, দুর্যোগে এক নম্বর পতাকা দেখা গেলে মানসিক প্রস্তুতি নিতে হবে, দুই নম্বর পতাকা দেখলে সব মালামাল গুছিয়ে নিতে হবে, তিন নম্বর পতাকা দেখলে আর ঘরে থাকা যাবে না।
দুর্যোগ সচেতনতা বৃদ্ধি কার্যক্রমে নিয়েজিত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও স্থানীয়দের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য সূত্র বলছে, সিডরের পরের দুর্যোগ আইলা ও মহাসেনের সময়ের সিগন্যালে মানুষের সচেতনতার মাত্রা বোঝা গেছে। শুকনো খাবার নিয়ে বাড়িঘর থেকে মানুষজন ছুটে এসেছে সাইক্লোন শেলটারে। শেলটারগুলোতে তিল ধারণের ঠাঁই থাকছে না। অথচ সিডরের তাণ্ডবের আগে মানুষদের বাড়ি বাড়ি গিয়েও সাইক্লোন শেলটারে আনা সম্ভব হয়নি।
দুর্যোগ বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি অবকাঠামোগত উন্নয়নের দাবি এলাকাবাসীর। তারা বলছেন, দুর্যোগের সময় শেলটারে যেতে রাস্তাঘাট নির্মাণ করতে হবে। সাইক্লোন শেলটার যথাযথভাবে রক্ষণাবেক্ষণের উদ্যোগ নিতে হবে। ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে আরও সাইক্লোন শেলটার নির্মাণ করতে হবে।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা অগ্রদূত ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক আইউব আলী আকন বাংলানিউজকে বলেন, সিডর বিধ্বস্ত শরণখোলায় প্রয়োজনের তূলনায় সাইক্লোন শেলটার এখনও অনেক কম। তবে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মধ্যদিয়ে এগুলোকে কার্যকর করা সম্ভব। সেজন্য সমন্বিত পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে।
দুর্যোগ সচেতনতা বিষয়ে কর্মরত সংস্থা জেজেএস এর কর্মকর্তা আবদুল মালেক বাংলানিউজকে বলেন, পরিবার পর্যায়ে এই এলাকার মানুষ অনেক বেশি সচেতন। বাড়িঘর উঁচুকরণ, সতর্ক সংকেত মেনে চলা, আশ্রয়ের জন্য যথাসময়ে কেন্দ্রে আসা, এসব বিষয়ে মানুষ বেশ সজাগ। অবকাঠামোর উন্নয়ন হলে পরিবার পর্যায়ের ওই সচেতনতা কাজে লাগবে।
এলাকার বহু মানুষ বললেন, মানুষের সাহায্য নির্ভরতার কথা। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে বিপুল পরিমাণে জরুরি ত্রাণ সহায়তা আসায় বহু ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার এক দেড় বছর শুধু ত্রাণের চাল-ডাল দিয়ে সংসার চালিয়েছে। এই সময়ে তারা বিকল্প কাজের খোঁজ করেনি। ঘরে আরও ত্রাণ সহায়তা জমানোর চেষ্টা ছিল তাদের। এভাবে ক্ষতিগ্রস্তদের একটি বড় অংশ সাহায্য নির্ভর হয়ে পড়েছে। এখনও এলাকায় বাইরের নতুন লোক দেখলে সাহায্যেও খোঁজটাই তারা আগে নেন।
[ পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোন খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: [email protected] ]
বাংলাদেশ সময়: ০২২৯ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৬, ২০১৪