ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

সিডরে ধুঁকছে কর্মহীন মানুষের জীবন!

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫৪৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৮, ২০১৪
সিডরে ধুঁকছে কর্মহীন মানুষের জীবন! ছবি : বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

উপকূলের সিডর-বিপন্ন জনপদ ঘুরে: সব হারানো জেলে হাবিবুর রহমান মলিন মুখ। তার অপলক দৃষ্টি সমুদ্রের দিকে; যেখানে ঢেউয়ের সঙ্গে যুদ্ধ করে চলতো তার ছোট্ট নৌকা।



সমুদ্রে জাল ফেলে কোনোমতে চালিয়ে নিচ্ছিলেন পাঁচজনের সংসার। সাত বছর আগে সিডর তার সব কেড়ে নিয়েছে। ধারদেনা করে আবারও মাছ ধরতে নেমেছিলেন। ঝড়ে তাও শেষ হয়ে গেছে। ছোটবেলা থেকে মাছধরে জীবিকা নির্বাহকারী এই জেলে অবশেষে এই পেশাটাই ছেড়ে দিয়েছেন!

পটুয়াখালীর কুয়াকাটায় হোসেন পাড়ায় সমুদ্র সৈকতে এক চায়ের দোকানে তার সঙ্গে দেখা হলে জীবনের গল্পটা শোনালেন বাংলানিউজকে।

তিনি বললেন, সিডর সব শেষ করে দিয়েছে গো! শুধু জাল-নৌকা নয়, বাঁধের পাশে ঘরটাও উড়িয়ে নিয়েছিল। দেনার ভার আর সইতে পারছি না! এখন মজুরের কাজ করে সংসার চলে।   

এমন হাজারও মানুষের গল্প গুমরে কাঁদে উপকূলের পথে-প্রান্তরে। জেলে, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে বিভিন্নভাবে জীবিকা নির্বাহকারী মানুষেরা দীর্ঘদিনের কর্মসংস্থানের সুযোগটাও হারিয়েছেন। এদের অনেকেই আজ নিঃস্ব হয়ে পথে বসেছেন। প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় সিডরের সাত বছরেও বিপন্ন মানুষেরা মাথা তুলতে পারেননি।

এলাকায় প্রচুর পরিমাণে সাহায্য এলেও দিন-আনা দিন-খাওয়া মানুষের অবস্থা সেই আগের মতোই রয়ে গেছে। সিডরের প্রলয়ে সারা জীবনের জমানো সম্পদ হারিয়ে বহু মানুষ দেনার বোঝা বয়ে ক্লান্ত।

এই সব সিডর বিপন্ন মানুষদের খবর খুঁজতে বাংলানিউজ ঘুরেছে উপকূলের বিভিন্ন এলাকা। পটুয়াখালী, ভোলা, বাগেরহাটের সিডর বিপন্ন এলাকায় যেন হাহাকার বইছে। খেয়ে-পড়ে যারা মোটামুটি ভালো ছিলেন, তাদের মেরুদণ্ড ভেঙে গেছে। এক সময় নিজের জমিতে আবাদ করে জীবিকা নির্বাহকারী চাষীরাও এখন মজুরের কাজ খোঁজেন।

বাগেরহাটের সর্বদক্ষিণে শরণখোলা উপজেলার সাউথখালী ইউনিয়ন। এই ইউনিয়নের সর্বদক্ষিণে বলেশ্বর নদী তীরবর্তী এলাকায় আঘাত হেনেছিল সিডর। ভয়াবহ এই প্রলয়ে মাটির সঙ্গে মিশে যাওয়া গ্রামগুলো ফিরে পেয়েছে প্রাণচাঞ্চল্য। বাড়িঘর উঠেছে। গাছপালা মাথা তুলেছে। জেলেরা আবার জাল-নৌকা নিয়ে আবার ফিরছে নদীতে। কিন্তু এই প্রাণচাঞ্চল্যে যেন কোনো ‘প্রাণ’ নেই! অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, নিতান্তই বেঁচে থাকতে হয় বলেই মানুষগুলো জীবন সংগ্রামে মনোযোগ দিয়েছেন।

সিডরে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা সাউথখালী ইউনিয়নের গাবতলা, উত্তর ও দক্ষিণ সাউথখালী গ্রাম ঘুরে বাংলানিউজ বিপন্ন মানুষদের বোবাকান্না অনুভব করতে পেরেছে। একই সঙ্গে বাবা-মা-বোন হারানোর বেদনা, ছেলে কিংবা মেয়ে হারানোর বেদনা কী করে ভুলে যাবে, এই এলাকার মানুষ! দুর্যোগ যেন এক একটি জীবনই বদলে দিয়েছে। হয়ত ছেলেমেয়ে, নাতিনাতনি সবাই চলে গেছে। শুধু বেঁচে আছেন একজন বৃদ্ধা। ঘরসহ সাহায্য সহযোগিতার অনেক কিছুই বেঁচে থাকা এই বৃদ্ধার ভাগ্যে জোটেনি। কারণ, তার নিজের নামে কিছুই ছিল না। এভাবে ভাসমান অনেক মানুষের কান্নায় এখনও ভারী হয়ে আছে সাউথখালীর বাতাস।

সাউথখালী ইউনিয়ন পরিষদ ভবন থেকে খানিকটা দূরে পুরনো লঞ্চঘাট। এক সময় এখানে জমজমাট ঘাট ছিল। লঞ্চ আসতো বিভিন্ন এলাকা থেকে। সেই ঘাটটি বহু আগেই বলেশ্বর নদীতে হারিয়ে গেলেও এখনো এলাকাটিকে সবাই লঞ্চঘাট হিসেবেই চেনেন। সিডরের পানির তোড়ে এই এলাকার বাড়িঘর ভেসে গিয়েছিল। ভেসে যাওয়া মানুষেরা সিডরের পরের ভোরে এসে নিজের বাড়ি চিনতে পারেননি। সেই মানুষগুলো এখনও সেখানেই বসবাস করছেন। সেই আগের পেশা, আগের মতোই ধুঁকে ধুঁকে চলা!

নদীতীরে নতুন বেড়িবাঁধের গা ঘেঁষে আবদুল মালেক মৃধার ছোট্ট ঘর। সিডরের পর ত্রাণ হিসেবে একটা ঘর পেয়েছিলেন। কিন্তু এ ঘরটা এতই ছোট ছিল যে, চারদিকে বারান্দা দিয়ে ঘরটি বড় করতে হয়েছে। দুই কক্ষের যে ঘর পেয়েছিলেন, তাতে বসবাস করা সম্ভব ছিল না।

মালেক পুরনো পেশায় ফিরতে আবার জাল-নৌকা তৈরিতে মনোযোগ দিয়েছেন। সিডরের আগে একটা বড় ট্রলার থাকলেও এখন বানিয়েছেন ছোট্ট ট্রলার। ত্রাণ হিসেবে ১০ কেজি মাছধরার জাল পেয়েছিলেন। কিন্তু এর সঙ্গে আরো কিনতে হয়েছে। এসব করতে গিয়ে তিনটি এনজিওতে দেনা আছেন প্রায় এক লাখ টাকা। অন্তত বছরখানেক এই দেনা বইতে হবে তাকে।

আরেকজন আবদুল কাদের। পুরনো লঞ্চঘাটের কাছে নতুন বেড়িবাঁধ থেকে খানিকটা দূরে রাস্তার পাশে ছোট্ট ঘর। একখানা ত্রাণের ঘর তার ভাগ্যেও জুটেছে।
কিন্তু অবস্থা সেই একই! ঘরটি খুবই ছোট হওয়ায় আশপাশে বারান্দা দিয়ে ঘর বড় করতে হয়েছে। তিনিও প্রায় এক লাখ টাকা দেনা আছেন।

আব্দুল কাদের বাংলানিউজকে বলছিলেন, সিডরের পর প্রায় তিন মাস আমরা কাজ না করেই খাবার পেয়েছি। কিন্তু এক পর্যায়ে তো আমাদের কাজে নামতে হয়েছে। মাথা তোলার মতো সহায়তা খুব সামান্যই মিলেছে।

সরেজমিন বলেশ্বর তীর ও সুন্দরবন লাগোয়া গ্রাম ঘুরে দেখা গেল, সিডরে পথে বসে যাওয়া মানুষেরা ফের বেঁচে থাকার চেষ্টায় নানা উদ্যোগ নিয়েছেন। কেউ দোকান করেছেন। কেউ নৌকা মেরামত করে আবার নদীতে মাছ ধরতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কেউবা মাছের পোনার ব্যবসায় নেমেছেন।

আলাপে অনেকেই অভিযোগ করলেন, ক্ষতিগ্রস্তদের ঘুরে দাঁড়াতে যে সহায়তা এসেছে, তা যথাযথভাবে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের কাছে পৌঁছেনি। আর সে কারণেই বহু মানুষ দেনার ভারে ন্যূয়ে পড়েছেন।

সিডরের পর ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পুনর্বাসনে এত সাহায্য-সহযোগিতা গেল কোথায়! এই বিপুল পরিমাণ অর্থে কাদের পুনর্বাসন হলো! বছর বছর সিডর বিধ্বস্ত জনপদে এই প্রশ্নগুলোই ঘুরপাক খায় শুধু!

[পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামে বিশেষ বিভাগে।

আপনি উপকূলের কোনো খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: [email protected] ]

বাংলাদেশ সময়: ০৫৩৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৮, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।