কুয়াকাটা, পটুয়াখালী ঘুরে এসে: উইহানে (ওখানে) মোগো (আমাদের) ঘর আল্হে (ছিল)। সাগর আল্হে আরও দূরে।
পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার সমুদ্র সৈকত কুয়াকাটা সংলগ্ন চাপলি গ্রামের আনোয়ার হোসেন এভাবেই বনহীন গ্রামে নিজের সমস্যা ব্যাখ্যা করছিলেন। তিনি জানালেন, আগে প্রচূর পরিমাণে প্রাকৃতিক বন ছিল। এখন নেই। ঝড়-বন্যায় নষ্ট হচ্ছে, আবার মানুষেরা ধ্বংস করে দিচ্ছে।
সরেজমিন তথ্য সূত্র বলছে, মানুষসৃষ্ট কারণে কলাপাড়ায় সাগরপাড়ের সংরক্ষিত বনাঞ্চল উজাড় হয়ে যাচ্ছে। সংরক্ষিত বনাঞ্চল ছাড়াও বেড়িবাঁধের বাইরের ছইলা-কেওড়া বাগান, বাঁধের ঢালে সামাজিক বনায়ন সব ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে। এরফলে সমুদ্র তীরবর্তী এই এলাকায় প্রাকৃতিক নিরাপত্তা বেষ্টনি আর থাকছে না। একইসঙ্গে এখানকার অন্তত ১০ লক্ষাধিক মানুষ ও তাদের সহায় সম্পদ নিয়ে দুর্যোগের শঙ্কায় বেঁচে আছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত দশ বছরে কলাপাড়ার বেড়িবাঁধের বাইরের অন্তত ২০০ কিলোমিটার বনাঞ্চল উজাড় করা হয়েছে। এসব বাগান উজাড় করে বাড়িঘর, মাছের ঘের, ব্যক্তিগত পুকুর পর্যন্ত করা হয়েছে। এমনকি বাগান উজাড় করে করা হচ্ছে ইটভাঁটা। এমনকি বন ও পরিবেশ আইনকে চরমভাবে উপেক্ষা করে যত্রতত্র বসানো হয়েছে অসংখ্য করাতকল। ফলে এই উপকূলীয় জনপদে দুর্যোগকালীন ঝুঁকি দিন দিন বাড়ছে। মানুষের আশঙ্কা ফের সিডর আইলার মতো বড় ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে এ জনপদ লন্ডভন্ড হয়ে যাবে। রক্ষা করা যাবে না মানুষের জীবন সম্পদ কোনটাই।
প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় সিডর ও আইলার অভিজ্ঞতা থেকে এলাবাসী বলেছেন, কলাপাড়ার ধুলাসার ইউনিয়নের গঙ্গামতি, কুয়াকাটা, ডালবুগঞ্জ, নিশানবাড়িয়া, মিঠাগঞ্জ, মধুখালী, চরধুলাসার, আশাখালি, হাজীপুর, পক্ষিয়াপাড়া, গোলবুনিয়া, ধানখালী, চাপলী বাজার, খাপড়াভাঙ্গা, পোনামাপাড়া, খাজুরা, খালগোড়া এলাকায় বেড়িবাঁধের বাইরে ছইলা ও কেওড়া বনাঞ্চল থাকায় জলোচ্ছ্বাসের ঝাপটা বনাঞ্চলে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। রক্ষা পেয়েছে বেড়িবাঁধ। মানুষের জীবন ও তাদের সম্পদ বাঁচানো সম্ভব হয়েছে।
সিডরের পরে জীবন রক্ষায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী বনের ওপরই যেন চলছে নিধনযজ্ঞ। মাইলের পর মাইল বনাঞ্চল উজাড়ের কারণে এখন বেড়িবাঁধও ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। জীবন বিপন্নের শঙ্কায় পড়েছেন বাঁধের ভেতরের লাখ লাখ মানুষ। শুধু তাই নয়, বাঁধ ভেঙ্গে ভেতরের কৃষিজমি লোনা পানিতে প্লাবিত হলে চাষাবাদ পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যাবে। দৃষ্টান্ত তুলে ধরে স্থানীয় বাসিন্দারা বললেন, কচুপাত্রা গ্রামের বেড়িবাঁধসহ ক্লোজার সিডরে বিধ্বস্ত হলে চাকামইয়া ও কড়ইবাড়িয়া ইউনিয়নের ১৭টি গ্রামের কৃষক চারটি বছর কোন ধরনের ফসল ফলাতে পারেনি।
উপকূলীয় বনবিভাগের দেওয়া তথ্য বলছে, কলাপাড়ায় বনবিভাগের রেঞ্জের মোট আয়তন ১০ হাজার ১৭৭ একর ১১ শতক। যার মধ্যে সংরক্ষিত বনভূমির পরিমান তিন হাজার নয় শ’ ৭৮ একর ৩৩ শতক। এর মধ্যে কুয়াকাটায় ১৯৩ একর। কুয়াকাটা ক্যাম্পে এক হাজার আট শ’ ১৮ একর ৯৩ শতক। গঙ্গামতি ক্যাম্পের অধীন এক হাজার এক শ’ ২৮ একর। খাজুরা ক্যাম্পের তিন শ’ ৪৬ একর ৮৭ শতক ও ধুলাসার ক্যাম্পে চার শ’ ৬১ একর ৫৩ শতক। সংরক্ষিত বনাঞ্চল ছাড়াও ফুলবুনিয়ায় ১৭০ একর, বালিয়াতলী এক হাজার ১৪ একর ৭৪ শতক ও লালুয়ায় ৯৫৬ একর জমিতে বাগান কেন্দ্র রয়েছে।
একইভাবে সেগুন বাগান ১৮ দশমিক ৭৫ হেক্টর, নারিকেল বাগান ৮৫ হেক্টর, গোলপাতা এক হাজার এক শ’ ৩১ দশমিক ৪৬ হেক্টর, ম্যানগ্রোভ বাগান সাত শ’ ৮০ দশমিক ৯৭ হেক্টর, নন-ম্যানগ্রোভ বাগান এক শ’ ২৬ দশমিক ৫৮ হেক্টর, বাবলা বাগান চার শ’ ৪০ দশমিক ৮৯ হেক্টর, কড়ই বাগান দুই শ’ ৫৩ দশমিক ৮৫ হেক্টর, গড়ান/গেওয়া বাগান এক শ’ ২৯ দশমিক ৫৫, হোগলা ১৬ দশমিক ১৯, সুন্দরী/পশুর/কেওড়া ৪২ দশমিক ৪৮ হেক্টর, স্ট্রিপ সংযোগ সড়ক বাগান ১৮ কিমি, স্ট্রিপ বাঁধ বাগান ৯৬ দশমিক ৫ কিমি এবং বিবিধ দুই শ’ ২৩ দশমিক ৪৮ হেক্টর বনায়ন করা হয়।
২০০৫ সাল পর্যন্ত এসব বনায়ন করা হয় বলে বনবিভাগের দাবি। এছাড়াও ২০০১ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সংযোগ সড়কে আরও ১০৬ কিলোমিটার বাঁধ সংযোগ বাগান করে এ বিভাগ। তবে এসব হিসাব এখন শুধুই কাগজপত্রে।
সরেজমিনে মাঠে না এলে বোঝার উপায় নেই, মানুষ সৃষ্ট বিপর্যয় কতোটা ভয়াবহ দুর্যোগের কবলে ঠেলে দিচ্ছে গোটা জনপদের মানুষের জীবন ও তাদের সম্পদকে। রামনাবাদ নদীর তান্ডবে প্রায় আট কিলোমিটার বেড়িবাঁধ বিধ্বস্ত হওয়ায় সেখানকার ১৩ গ্রামের তিন সহস্রারাধিক কৃষক বছর আমনসহ কোন ফসল ফলাতে পারছেন না। একই শঙ্কায় ধানখালী ও চম্পাপুরের চাষীরা।
মহিপুর ইউনিয়নের নিজামপুরম কমরপুর গ্রামের চাষীদের দুরাবস্থার যেন শেষ নেই। এসব মানুষের বসবাস এবং চাষাবাদের জমি রক্ষার জন্য একমাত্র অবলম্বন বেড়িবাঁধ। আর এই বেড়িবাঁধ রক্ষায় বাঁধের রিভার সাইটের ঢালে রয়েছে ছইলা, কেওড়া ও গোলবাগান। অথচ গত দুই যুগ ধরে এসব বাঁধের বাইরের গাছপালা কেটে উজাড় প্রক্রিয়া শুরু হয়। একশ্রেণীর বনদস্যুরা এসব গাছ কেটে উজাড় করছে। শুধু গাছ কেটেই থামছেনা এরা, বনাঞ্চলের গাছ কেটে সেখানে বাড়িঘর, পুকুর ও মাছের ঘের করছে। কলাপাড়া ভূমি অফিস আবার বনজঙ্গলকে চাষযোগ্য কৃষি জমি দেখিয়ে বন্দোবস্ত দিচ্ছে। মধুখালীতে দেখা গেছে এমন ঘটনা।
বেড়িবাঁধের ঢালের পাশের জঙ্গল কেটে সাফ করে সেখানে ইটভাটা করার দৃষ্টান্তও আছে কলাপাড়ায়। লতাচাপলী ইউনিয়নের পুনামাপাড়া গ্রামে দেখা গেছে এমন দৃশ্য। সেখানকার পানিউন্নয়ন বোর্ডের অধিগ্রহণ করা জমির মাটি কেটে বিরাট জলাশয় করা হচ্ছে। বাঁধের কিছুটা দূরে সরকারি খাস জমি চারজন ভূমিহীনকে পুনর্বাসনের জন্য বন্দোবস্ত দেওয়া হয়। কিন্তু ওই কৃষি জমি ভূমিহীনদের কাছ থেকে কিনে সেখানে এখন ইটভাটা করার প্রক্রিয়া চলছে।
মিঠাগঞ্জ ইউনিয়নের মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে মধুখালী লেক। লেকটির দু’দিকে রয়েছে বিরাট এলাকা নিয়ে সংরক্ষিত বনাঞ্চল। প্রাচীন হাজার হাজার গাছ দাড়িয়ে আছে। দুচোখে প্রাকৃতিক এই সম্পদ দেখলে প্রাণ জুড়ায়। এ গাছগুলোর কারণে জলোচ্ছ্বাসের ঝাপটায় সিডরে বাঁধের তেমন কোনো ক্ষতি করতে পারেনি। বিগত দশ বছর ধরে এ গাছগুলো কাটা চলছে। প্রায় ১২ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে বাগানটির এখন অবশিষ্ট আছে মাত্র চার-পাঁচ কিলোমিটার। এর মধ্যেও এখন বাড়িঘর তোলা হচ্ছে। অন্তত ২০টি বাড়িঘর এরইমধ্যে উঠে গেছে।
কলাপাড়া উপজেলা বন ও পরিবেশ কমিটির সদস্য সৈয়দ হাবিবুর রহমান জানান, বন পরিবেশ কমিটির সঠিকভাবে কোন মিটিং হয় না। বনাঞ্চল রক্ষা করতে না পারলে উপকূলীয় অঞ্চল মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখে পতিত হবে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা বলেছেন, পাউবোর বাঁধের বাইরের বাগান কিংবা জমি যারা দখল করছে তাদের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
আর উপকূলীয় বনের রক্ষক হিসাবে পরিচিত বন বিভাগের তো একই কথা। একাধিক রেঞ্জ কর্মকর্তা বললেন, অবৈধভাবে বসানো করাতকল শনাক্ত করে তা বন্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। আর বেড়িবাঁধের বাইরের গাছ নিধনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট বিট কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বন রক্ষায় আমরা সচেষ্ট আছি।
[ পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোন খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: [email protected] ]
বাংলাদেশ সময়: ০০১২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৮, ২০১৪