সোনাদিয়া, মহেশখালী, কক্সবাজার থেকে: এখানে এখনও সেই আদিম সেকেলে জীবন। চরিদিকে ধূ ধূ বালুরাশির মাঝে ছোট ছোট বসতি।
অসুখে পথ্য নেই, ডাক্তারের দেখা পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। মুমূর্ষু রোগীর জীবন বাঁচানো পুরেপুরি নিয়তিনির্ভর। সমুদ্রের গা ঘেঁষে এই জনপদ ঝড়ে বিধ্বস্ত হয় বার বার, আবার মাথা তোলে। বিদ্যুতহীন পুরো এলাকা রাতে ডুবে থাকে গভীর অন্ধকারে।
এর নাম সোনাদিয়া। যে দ্বীপের সৌন্দর্যের খ্যাতি দেশের সীমানা পেরিয়ে পৌঁছে গেছে বিদেশে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এই ছোট্ট ভূখণ্ড উন্নয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে সামান্যই।
কক্সবাজার জেলার মহেশখালী উপজেলার কুতুবজোম ইউনিয়নের ক্ষুদ্রতম ইউনিট একটি ওয়ার্ড রয়েছে এখানে। তবে কোনো নাগরিক সুবিধাই এখানে পৌঁছেনি।
সরেজমিনে তথ্য সংগ্রহকালে নানামূখী সঙ্কটের কথাই জানালেন দ্বীপের বাসিন্দারা।
দ্বীপ সোনাদিয়ায় পা ফেলতেই মানুষের ভিড়। তাদের অভিযোগের অন্ত নেই। ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে বাঁচতে বেড়িবাঁধ আর রাস্তাঘাটের দাবিটাই তাদের কাছে বড়। এর পরের তালিকায় চিকিৎসার জন্য একজন ডাক্তার আর নিয়মিত ওষুধপত্র পাওয়ার ব্যবস্থা। দ্বীপের পশ্চিমপাড়ায় ভিড় জমানো মানুষেরা একে একে বলতে থাকেন নানা সমস্যার কথা। এভাবে অভিযোগ শোনার মানুষ দ্বীপবাসীর সামনে আসেন না। কারণ, এখানে বিভিন্ন সময়ে পর্যটকেরা বেড়াতে গেলেও দ্বীপের সমস্যায় তাদের নজর থাকে সামান্যই।
পশ্চিমপাড়ার বাসিন্দা জালাল মিয়া (৫০)। বহু বছর ধরে এখানে আছেন। দ্বীপে পা ফেলামাত্রই এগিয়ে এসে জানালেন সমস্যার কথা। বললেন, জোয়ারের পানি বাড়লেই বাড়ি-ঘর তলিয়ে যায়। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে দ্বীপ ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে হয়। দূরে কোথাও আশ্রয় নিতেও অনেক সমস্যা। যোগাযোগ ব্যবস্থা খারাপ থাকায় সহজেই বাইরে কোথাও যেতে পারেন না। এ পাড়ায় কোনো সাইক্লোন শেলটারও নেই। এখান থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে দ্বীপের পূর্বপাড়ায় একটিমাত্র সাইক্লোন শেলটার রয়েছে।
এ পাড়ার আরেকজন ইউনুস মিয়া। বয়স ৬৫ পেরিয়েছে। ছোটবেলা থেকেই এখানে বসবাস করছেন। ১১ জনের সংসার চালাতে এখনও তাকে অধিক খাটুনি দিতে হয়।
তিনি জানালেন, এ দ্বীপবাসীর সমস্যা দেখার কেউ নেই। নির্বাচন এলে এখানকার মানুষেরা ভোট দিলেও নাগরিক সুবিধার বিষয়ে সরকারের কোনো নজর নেই। ফলে এখানকার মানুষগুলো ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে আছেন।
পশ্চিমপাড়া থেকে পূর্বপাড়ায় পায়ে হেঁটে যাওয়ার পথেই অপরূপ সৌন্দর্যমণ্ডিত সোনাদিয়া দ্বীপের অন্যরূপটা চোখে পড়ে। উন্নয়নের কোনো ছোঁয়া এখানে একেবারেই পড়েনি। পথে মাঠে কিছু চাষির সঙ্গে দেখা হল। তারা তরমুজ আবাদের জন্য খেত তৈরি করছিলেন। জমি বর্গা নিয়ে তারা ধানসহ নানান রবি ফসল আবাদ করেন। এখানকার জমি অত্যন্ত উর্বর হলেও চাষাবাদের আধুনিক জ্ঞান পৌঁছেনি তাদের কাছে।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, দ্বীপের বালুরাশির মাঝে কখনো বন, কখনো ফসলি মাঠ, কখনো চিংড়ি ঘের। এরই মাঝে ছোট ছোট নিচু বাড়ি-ঘর। কালো পলিথিনে মোড়ানো ছাউনি, বাঁশের বেড়া দিয়ে বানানো এইসব ঘর। শুধুমাত্র ইউপি মেম্বার আবদুল গফুর (নাগু মেম্বার) সাহেবের বাড়িটাই পাকা। এ দ্বীপের হাতে গোনা কিছু বাড়িতে সৌরবিদ্যুৎ থাকলেও সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে অধিকাংশ বাড়ি অন্ধকারে ডুবে থাকে।
পশ্চিমপাড়ার বাসিন্দাদের অভিযোগ, দ্বীপের পূর্বপাড়ায় ওয়ার্ড মেম্বারের বাড়ি বলে উন্নয়নের সবটুকু সেখানে আসছে। পশ্চিমপাড়ায় কিছুই দেওয়া হচ্ছে না। কিন্তু দু’টি পাড়াই ঘুরে পাওয়া গেল একই চিত্র। পূর্বপাড়ায় বাড়তি উন্নয়ন বলতে একটিমাত্র সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। আর সে বিদ্যালয়টি চলছে একটি সাইক্লোন শেলটারে। অন্যসব সমস্যার সঙ্গে দুই পাড়ার কোনো পার্থক্য চোখে পড়লো না।
ইউপি মেম্বার আবদুল গফুর বললেন, এ দ্বীপের উন্নয়নে সরকারের কোনো নজর নেই। দ্বীপ থেকে বাইরে যাওয়াটা এখানকার মানুষের কাছে অত্যন্ত দু:সাধ্য। সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থার কিছুই এখানে পৌঁছেনি। এখানকার মানুষের নিরাপত্তার জন্য একটা পুলিশ ফাঁড়ি নেই। বেড়িবাঁধ না থাকায় বর্ষায় জোয়ারের পানি বাড়লে মানুষের বাড়ি-ঘর পানিতে ডুবে যায়। এসব সমস্যার সমাধান হলে সোনাদিয়ার সম্ভাবনা আরও বিকশিত হতে পারে।
সূত্র বলছে, অন্তত ৩০০ বছরের পুরোনো এই সোনাদিয়া দ্বীপ। দ্বীপের ৩৪৫টি বাড়িতে লোকসংখ্যা প্রায় ২ হাজার। প্রায় ৭ হাজার একর জমির মধ্যে ৩৫০ একর রেকর্ডীয় বলে দাবি এলাকাবাসীর। মহেশখালী উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরের এই জনপদে একটি মাত্র সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। পাশাপাশি দু’টি বেসরকারি স্কুল রয়েছে। বেসরকারি পর্যায়ে বিশেষ কোনো কর্মকাণ্ড এখানে নেই।
মহেশখালী সদর গোরকঘাটা থেকে দ্বীপে যেতে প্রথমে ছয় কিলোমিটার পথ স্কুটারে যাওয়ার সুযোগ থাকলেও বাকি ৪ কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে কিংবা নৌকায় যেতে হয়।
সোনাদিয়া দ্বীপের অধিকাংশ মানুষের জীবিকা মৎস্য নির্ভর। সমুদ্রে মাছ ধরা, শীতে মাছ শুকানো, চিংড়ির পোনা ধরা, ঝিনুক কুড়ানোসহ বিভিন্ন কাজে জীবিকা নির্বাহ করছেন এখানকার মানুষ। প্রকৃতিক বিপর্যয়ে জীবিকার সব পথই যেন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এর ওপর সব সমস্যা আষ্টেপিষ্ঠে বেঁধে রেখেছে সোনাদিয়াবাসীকে।
[পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরা-খবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোনো খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: [email protected] ]
বাংলাদেশ সময়: ০৩০০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৯, ২০১৪