ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

যেখানে ব্রিজ আছে, রাস্তা নেই

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৫২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০১৫
যেখানে ব্রিজ আছে, রাস্তা নেই ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

সোনাদিয়া, মহেশখালী (কক্সবাজার) ঘুরে এসে: রাস্তার উন্নয়নের আগেই চার কিলোমিটার পথে নির্মিত হয়েছিল দু’টি বেইলি ব্রিজ। আরও একটি নির্মাণের প্রক্রিয়া চলছিল।

এরইমধ্যে সব কাজ বন্ধ হয়ে যায়। এমনকি চলাচলের রাস্তা উঁচুকরণের কাজও হচ্ছে না।

ফলে জোয়ারের পানিতে নিচু রাস্তা ডুবে গেলে দূর থেকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় ব্রিজ দুইটিকে। এ অবস্থায় প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ চরম দুর্ভোগে যাতায়াত করছেন এ পথে।

কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলা সদর থেকে সোনাদিয়া দ্বীপে যেতে ঘটিভাঙা এলাকায় গেলেই চোখে পড়ে এই চিত্র। উপজেলা সদর থেকে ঘটিভাঙা পর্যন্ত পৌঁছাতে ভাঙাচোরা রাস্তায় প্রায় ৬ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হয়।

কিন্তু ঘটিভাঙা থেকে সোনাদিয়া দ্বীপ পর্যন্ত ৪ কিলোমিটার পথের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। এইটকু পথ পায়ে হেঁটে যাওয়া সম্ভব নয় বলে বনের ভেতর দিয়ে নৌপথে যেতে আগ্রহ অনেকেরই।

ঘটিভাঙা এলাকার এই ব্রিজের কাছে খানিকক্ষণ দাঁড়ালেই মানুষের দুর্ভোগের চিত্র দেখা যায়। নারী-পুরুষ ও শিশু ছুঁটছে গন্তব্যে। কারো মাথায় বোঝা, কারও হাতে। কেউবা কাঁধে বোঝা নিয়ে চলছেন কিলোমিটারের পর কিলোমিটার। কাদা পানি অতিক্রম করে কিছু মানুষ নৌকায় উঠছেন। অনেকে আবার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রায় দশ ফুট উঁচু ব্রিজে উঠছেন নদী পারাপারের জন্য।

উপজেলার কুতুবজোম ইউনিয়নের ঘটিভাঙা থেকে সোনাদিয়া দ্বীপ পর্যন্ত যেতে দু’টো বেইলি ব্রিজ আছে; তবে এর সঙ্গে থাকা মাটির রাস্তার অনেক স্থানের মাটি সরে গেছে। এই পথে যাওয়ার সময় স্থানীয় বাসিন্দাদের কখনো কোমর সমান পানি অতিক্রম করতে দেখা যায়। একটি রয়েছে নড়বড়ে সাঁকো।

আবুল কালাম আজাদ, যাচ্ছিলেন ঘটিভাঙা থেকে সোনাদিয়া। নৌকায় নয়, পায়ে হেঁটেই যাওয়ার প্রস্তুতি তার। মাথায় ভারি বোঝা। এই নিয়ে মাটির বিধ্বস্ত রাস্তায় তো হাঁটবেনই, ইট আর বালুর বস্তার ওপর দিয়ে দশ ফুট উঁচু ব্রিজেও উঠবেন। উঠেও গেলেন নির্বিঘ্নে।

কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখা গেল আরও কয়েকজন একইভাবে উঠে গেলেন ব্রিজে। নিয়মিত এই ঝুঁকিপূর্ণ যাতায়াতটাও এদের কাছে একেবারেই গা সওয়া হয়ে গেছে।

আবুল কালাম আজাদ বলেন, সরকারের টাকা খরচ করে এই ব্রিজটা বানানোর দরকার ছিল কেন বুঝতে পারি না। নিচ থেকে ব্রিজে উঠতে হয় ঝুঁকি নিয়ে। মাটি ফেলে জায়গাটা ভরাট করে দিলে মানুষজন অন্তত সহজে ব্রিজে উঠতে পারতো।

ঘটিভাঙা বাজারে আলাপ হল কুতুবজোম ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান নূরুল আমিনের সঙ্গে। তিনি জানালেন, ২০০১ সালে সোনাদিয়া যাতায়াতের জন্য দু’টো ব্রিজ নির্মাণ করা হয়েছিল। একই পথে আরও একটি ব্রিজ নির্মাণের টেন্ডার হয়েছিল। কিন্তু এক পর্যায়ে টেন্ডার বাতিল হয়ে যায়।

তিনি বলেন, ব্রিজটি না থাকায় এই এলাকার মানুষ চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। সমুদ্র থেকে আহরিত মাছ বাইরে পাঠাতে পারে না বলে ন্যায্য দাম মেলে না। যাতায়াত সংকট জীবনের সব ক্ষেত্রেই প্রভাব ফেলে।

‘মুমূর্ষু রোগীদের যথাসময়ে চিকিৎসকের কাছে নিতে মারাত্মক সমস্যা দেখা দেয়। অনেক সময় বিনা চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যুও হয়’ – বলেন তিনি।

সংকটের এই কথাগুলোর প্রতিধ্বনি শোনা যায় সোনাদিয়ার বাসিন্দাদের মুখে। সোনাদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক শচিরাম দাস বলেন, শুকনো মৌসুমে এই পথ দিয়ে অনেক কষ্ট করে চলাচলের সুযোগ থাকলেও বর্ষায় তা বন্ধ হয়ে যায়। যাতায়াতের কোনো সুযোগ থাকে না। তখন দ্বীপের সব মানুষ নৌকায় যাতায়াত করে। বলা যায় বর্ষাকালে এই দ্বীপ পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।  

সোনাদিয়া দ্বীপে কোনো হাটবাজার নেই। সে কারণে এখানকার বাসিন্দাদের হাটবাজার থেকে শুরু করে সব প্রয়োজনে ছুটতে হয় ঘটিভাঙা হয়ে মহেশখালীর পথে। চাল-ডাল-নুনসহ নিত্য প্রয়োজনীয় সব পণ্য কিনতে তাদের শহরে যেতে হয়। দুর্গম পথে মালা-মাল আনা নেওয়ায় তাদের ভোগান্তির শেষ থাকে না।

কুতুবজোম ইউনিয়নের সোনাদিয়া ওয়ার্ডের মেম্বার আবদুল গফুর (নাগু মেম্বার) বলেন, দ্বীপের প্রায় ২ হাজার মানুষের সব সমস্যার প্রধান কারণ এই দুর্গম যোগাযোগ। যাতায়াত সমস্যার কারণে এখানে চিকিৎসা সংকটও প্রকট আকার ধারণ করছে।

সোনাদিয়ার পর্যটন সম্ভাবনার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, সোনাদিয়া সমুদ্র সৈকতে পর্যটকদের যাতায়াতেও দেখা দেয় মারাত্মক সমস্যা। সোনাদিয়ার সার্বিক উন্নয়নের জন্য রাস্তা ও ব্রিজ নির্মাণের দাবি করছে এলাকাবাসী।  

এলাকার মানুষের জোরালো দাবি সত্ত্বেও দ্বীপ সোনাদিয়ার ভেতর দিয়ে যাওয়া এই রাস্তা ও ব্রিজ নির্মাণে নিরুৎসাহ দেখাচ্ছে প্রশাসন।

এমনটাই জানালেন মহেশখালী উপজেলা প্রকৌশলী মোশারেফ হোসেন। বাংলানিউজকে তিনি বলেন, যোগাযোগ উন্নয়নে মহেশখালীর অন্যান্য এলাকায় কাজ করছে প্রকৌশল বিভাগ। কিন্তু সোনাদিয়ার এই রাস্তা নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া যাচ্ছে না। কারণ এখানে কোনো উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। ফলে আমাদের কিছুই করার নেই।

প্রকৌশলী মোশারেফ হোসেন বলেন, সোনাদিয়া যাওয়ার পথে ঘটিভাঙায় পর পর দু’টো ব্রিজ নির্মাণের পর ব্রিজের দু’পাশে অ্যাপ্রোচ রাস্তাও করা হয়েছিল। কিন্তু জোয়ারের পানিতে সে রাস্তা ভেসে গেছে। একই পথে সোনাদিয়ার নিকটে আরও একটি ব্রিজ নির্মাণের জন্য এডিপি থেকে টেন্ডার হয়েছিল। পরে সে টেন্ডার স্থগিত করা হয়।

মহেশখালী উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) আনোয়ারুল নাসের বলেন, সোনাদিয়া পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা। এই দ্বীপকে পরিবেশবান্ধব করে গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিছু পরিবার দ্বীপ বসবাস করে বলে আগে ব্রিজ তৈরি হয়েছিল। কিন্তু এখন আর সেখানকার ব্রিজ কিংবা রাস্তা নির্মাণের কোনো পরিকল্পনা নেই।

অবাধ যাতায়াতের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হলে দ্বীপ সোনাদিয়ার জীববৈচিত্র্য রক্ষা করা যাবে না বলে মনে করেন তিনি।   
 
[ পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোন খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: [email protected] ]

বাংলাদেশ সময়: ১৮৫২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১২, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।