উপকূলের প্রান্তিক জনপদ ঘুরে : কখনো দুর্যোগের হানা, কখনো দস্যুদের অত্যাচার। এর ওপর দরিদ্রতা প্রতিনিয়ত তাড়িয়ে ফেরে।
সন্তান লালন-পালনের সঙ্গে সংসার চালানোর পুরো দায়িত্বটাই পড়ে নারীর ওপর। এ সবের ভেতর দিয়ে নারীরা এগোয় সমানতালে। দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে স্বপ্ন দেখে বেঁচে থাকার। বিপন্ন নারীরাও এগিয়ে যান স্বপ্ন পূরণের দিকে।
উপকূলের বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিন ঘুরে আত্মপ্রত্যয়ী বহু নারীর তথ্য মেলে। মাছ ধরতে গিয়ে নিখোঁজ হয়েছেন বহু জেলে। এদের পরিবারে সংকটের শেষ নেই। দুর্যোগ তাদের জীবনের গতিটাই বদলে দিয়েছে। অন্যদিকে স্ত্রীকে ফেলে বহু স্বামী নিরুদ্দেশ হওয়ায় অনেক নারীর জীবনে নেমে এসেছে কালো অন্ধকার। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জলদস্যুদের আক্রমণ আর দারিদ্র্যের সব বাধা পেছনে ফেলে উপকূলের নারীরা এগোয় সামনের দিকে।
দস্যুদের সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকা...
দ্বীপ ভোলার মনপুরার ঢালচরের বাসিন্দা ছকিনা বিবি চরে বসবাসে তার হাজারো সমস্যার কথা বলেন। এই দুর্গম জনপদে নারীরা যে কতটা নিগ্রহের মধ্যে বসবাস করতে বাধ্য হয়, তার বোঝা যায় মাত্র দশ মিনিটের আলাপে। জীবনের কোন নিরাপত্তা নেই এদের। একদিকে দস্যুদের ভয়, অন্যদিকে ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের তাণ্ডব। ছকিনার মত নারী প্রধান পরিবারের সংকট আরও বেশি।
‘ডাহাইতের (ডাকাতের) ভয়ে রাইতে যাইয়া উডি গাছে। দিন অইলে থাহি ডগিয়ে ডগিয়ে (বিলে)। অরে (ঘরে) একবেলা ভাত রান্দি খাইতে পারি না। আইয়ে (এসে) বেড়া পিডায়, দুয়ার পিডায়। দুগগা (দুই) ডাহাইতে আমাগো লাডাইয়া (পিষ্ট করে) হালাইতেছে (ফেলছে)। ’
আলাপে ছকিনা বলেন, ‘তিন মাসের মধ্যে বাগানের তন (থেকে) আইতে পারি নাই। থাকতাম খালের ভেতর, নালের ভেতর। ধান করতে গেছি। ধান উডাইছি। বুকের মধ্যে পিস্তল ধরি ধান লইয়া গ্যাছে। ৫০ কেজি বস্তার ১৩৫ বস্তা ধান লইয়া গ্যাছে। চাইলাম। আর দিল না। আমার মালিকের কাছে কাইছি। মালিক বলে ধৈর্য ধরতে। ধৈর্য ধরতে ধরতে এই পর্যন্ত আইছি। আর পারতেছি না। ’
ছকিনা জানালেন, সাহসী ভূমিকার কারণে তাকেও একটি গ্রুপের রোষানলে পড়তে হয়েছে কয়েকবার। এ নিয়ে আবার এলাকায় চলে নোংরা রাজনীতি।
ছকিনা বলেন, ‘ডাহাইত লাগাই (লাগিয়ে) দিছে আমারে কাডি (কেটে) হালাই (ফেলে) দেয়ার লাই (জন্য)। উত্তরের চরে ৪-৫ জন লিডার। হেগুলারে (সেগুলোকে) রাকছে (রেখেছে) চেয়ারম্যান। উগগার (একটার) কাছে দুগগা (দুইটা) তিনগা (তিনটা) পিস্তল। এগুলি ডাকাইতের কাছ থেকে উদ্ধার করি ওরা ব্যবহার করে। ’
দুর্গম চরের এক সংগ্রামী নারীর নাম ছকিনা। স্বামী ফেলে রেখে যাওয়ায় তার নাম মুখেও আনতে চান না। জন্মস্থান মনপুরাতেই বেড়ে উঠেছেন। বিয়ে সূত্রে এই বিভিন্ন চরে বসবাসের পর এসেছেন ঢালচরে। এরমধ্যে সন্তান না হওয়ায় ছকিনা এখন একাই থাকেন। চরের ডেমপিয়ার কৃষি ও ডেইরি ফার্মের ম্যনেজিং ডিরেক্টর কামাল উদ্দিন চৌধুরী তাকে ৫ একর জমি দিয়েছেন। এই জমিতে চাষাবাদ ও সবজি আবাদ করে ছকিনার জীবিকা চলে।
ছকিনা জানালেন, নিজের জমিতে নিজেই আবাদ করেন। এবার আমন ধান আবাদ করেছেন। ১০০ থেকে ১২০ মন ধান পাওয়ার আশা করেন। এটাই তার সারা বছরের জীবিকার অবলম্বন। কিন্তু ধান ঘরে তুলতে না পারলে সে স্বপ্ন ভেঙ্গে যাবে। জমির পাশে ছকিনার ছোট্ট ঘর। এখানেই থাকেন। বিকল্প আয়ের লক্ষ্যে ঘরের পাশে সবজি চাষ করেন আর হাঁস-মুরগি পালন করেন।
স্বামী ফেলে রেখে চলে যাওয়ায় ছকিনার কোনো আক্ষেপ নেই। নিজের একখণ্ড জমিতে আবাদ করে নিজে ভালো চলতে পারেন। কারও কাছে হাত বাড়াতে হয় না। তবে নিরাপত্তার দাবিটাই তার কাছে প্রধান। ঢালচরে কোস্টগার্ডের ‘কোস্টাল ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট সেন্টার (সিসিএমসি)’ স্থাপনের খবরে সব চরবাসীর মত ছকিনাও অনেক আশা নিয়ে দিন গুনছে। হয়তো এই চর মুক্ত হবে দস্যুদের হামলা থেকে। ফিরে আসবে শান্তি।
ছকিনাসহ দুর্গম চরের আরও অনেক নারীর জীবনের গল্প শেষ হয় না। একের পর এক সংগ্রাম। দস্যু আর ঝড়- দুই ভয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জীবিকার লড়াইও করতে হয় সমান তালে। কখনো মাছধরা, কখনো হালচাষ করা, আবার কখনো কলাকচু বিক্রির জন্য হাটে যাওয়া। দুর্যোগ এলে কিংবা দস্যুদের হামলা হলে সব হারাতে হয়। তারপর আবার ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা। এভাবেই ঢালচরে টিকে আছেন ছকিনারা!
জেলে বধূদের জীবনে নতুন যুদ্ধ...
দুর্যোগে পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটিকে হারিয়ে জেলে বধূর জীবনে শুরু হয় নতুন যুদ্ধ। সব বাধা সরিয়ে এগিয়ে যায় নারী। ভোলার দৌলতখান, চর চন্দ্র প্রসাদ, লক্ষ্মীপুরের রামগতি, কমলনগর, নোয়াখালীর হাতিয়া, কোম্পানিগঞ্জে বহু স্বজনহারা পরিবারের দেখা মেলে। জীবিকার টানে সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়ে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে হারিয়ে যাওয়া জেলের তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ হতে থাকে। প্রিয় স্বজনের মরদেহ পাওয়া তো দূরের কথা, খবরটি পর্যন্ত পাওয়াও অনেক সময় দুরূহ হয়ে পড়ে।
সরেজমিন ঘুরে এ প্রতিবেদক জানতে পারে, এসব জেলে পরিবারগুলোতে নেমে এসেছে অন্ধকার। পারিবারিক স্থিতিশীলতা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে। বিধবা জেলেবধূ কখনো শ্বশুরের সংসারের বোঝা, আবার কখনো বাবার বাড়ি গিয়ে বাবার সংসারের বোঝা হয়। অনেকে আবার জীবিকার কোন পথ না পেয়ে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখতে দ্বিতীয় স্বামী গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়। অতিকষ্টে ধার-দেনা করে, কিংবা আশাপাশের স্বচ্ছল পরিবারের কাছে চেয়ে কোনমতে বেঁচে থাকতে হয় এদের।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দুর্ঘটনার পর ট্রলার মালিকের কাছ থেকে কোন ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা নেই এইসব জেলে পরিবারের জন্য। কেউ কেউ হয়তো আশ্বাস দেয়, কিন্তু সেই আশ্বাস আর পূরণ হয় না।
প্রতিনিয়ত সংকটে পথচলা...
ভোলা জেলা সদর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে ভেলুমিয়া ইউনিয়নের চর চন্দ্রপ্রসাদ গ্রাম। স্বামী হারিয়ে বিধবা এই গ্রামের মনোয়ারা বেগম (৪০)। স্বামী বজলু ৫ মেয়ে রেখে গেছেন। ২০০৭ সালে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় সিডরের তাণ্ডবের কবলে পড়ে আর ফিরে আসেনি। সেই থেকে মনোয়ারার জীবনে নেমে আসে চরম অনিশ্চয়তা। স্বামীর ফিরে আসার কোন সম্ভাবনা না থাকলেও এখনও অপেক্ষা শেষ হয়নি অসহায় এই নারীর।
স্বামী হারানোর পর জীবনের পুরো পরিকল্পনা এলোমেলো হয়ে যাওয়ার গল্প জানাচ্ছিলেন মনোয়ারা। তিনি জানান, তার সব মেয়েরাই স্কুলে যাচ্ছিল। কিন্তু স্বামী হারানোর পর আর্থিক সংকট বেড়ে যাওয়ায় তিন মেয়ের লেখাপড়া বন্ধ করে দিয়ে কাজে পাঠাতে হয়েছে। স্বামীর রেখে যাওয়া ঋণের বোঝা এখনও বয়ে বেড়াচ্ছেন।
একই গ্রামের জসিম উদ্দিনের স্ত্রী জেসমিন আক্তার, নূর উদ্দিনের স্ত্রী রাবেয়া খাতুন, আল আমীনের স্ত্রী জান্নাত বেগম, শহিদুল চৌকিদারের স্ত্রী আকলিমা আকতারসহ আরও কয়েকজন চরম সংকটে দিন কাটাচ্ছেন । প্রাকৃতিক দুর্যোগ তাদের জীবন ওলটপালট করে দিয়েছে। মাছধরা ট্রলারের মাঝি জসিম উদ্দিনসহ ট্রলারে থাকা ১৫জন জেলের কেউই ফিরে আসতে পারেনি। তাদের খবরটি পর্যন্ত আসেনি পরিবারের কাছে। তবুও নারী থেমে থাকে না। তাকে এগোতে হয়। মোকাবেলা করতে হয় হাজারো সমস্যা।
ভোলার দৌলতখানের ভবানীপুরের পঁচিশ বছর বয়সী জেলে হান্নান মিয়া মাছ ধরতে গিয়ে আর ফিরে আসেনি। স্ত্রী আর দুটো ছোট সন্তান রয়েছে তার। বাবার সংসার থেকে মাত্র দু’সপ্তাহ আগে আলাদা সংসার করেছিল হান্নান। স্ত্রী মুক্তা আক্তারের সব স্বপ্ন ভেঙে চুরমার। পৃথক সংসার থেকে তিনি আবার শ্বশুরের সংসারে।
দারিদ্র্য পিছু ছাড়ে না...
আট বছর আগে স্বামী হারিয়ে বিপাকে লক্ষ্মীপুরের কমলনগরের জেলেবধূঁ নাজমা বেগম। বাড়ি সাহেবের হাট ইউনিয়নের জগবন্ধু গ্রামের ৯ নম্বর ওয়ার্ডে। সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়ে স্বামী মো. হারিছ আর ফেরেননি। তিন ছেলে এক মেয়েকে নিয়ে বিপাকে পড়েন নাজমা। স্বামী কোন সহায় সম্পদ রেখে যাননি। ফলে নাজমাকে উঠতে হয়েছে তার দরিদ্র বাবার ঘরে। স্বামীর ঘরে গিয়েও চার সন্তান নিয়ে বাবার ঘরে বোঝা হন তিনি। তবুও বেঁচে থাকার স্বপ্ন নাজমার চোখে মুখে।
অনেক ইচ্ছা থাকা সত্বেও স্বামীর মৃত্যুর পর তিন ছেলেকে লেখাপড়া করাতে পারেননি নাজমা। নিজে ধরেছেন সংসারের হাল আর ছেলেদের দিয়েছেন কাজে। কিন্তু মেয়ে সুমাইয়াকে লেখাপড়া করানোর স্বপ্ন এখনও ভেঙে যায়নি নাজমার। অনেক কষ্টে বাবার বাড়িতে থেকে অন্যের বাড়িতে কাজ করে এগিয়ে যাচ্ছেন স্বপ্ন পূরণের দিকে।
চোখের জল মুছতে মুছতে নাজমা বেগম বলেন, ‘জীবনে কত কষ্ট করেছি, সে কথা বলে শেষ করতে পারব না। ছেলেদের লেখাপড়া করাতে পারিনি। ছেলেরা বাইরে কাজ করে কিছু টাকা-পয়সা রোজগার করে। নিজেও অন্যের বাড়িতে কাজ করছি। কষ্ট হচ্ছে, তবুও জীবনযুদ্ধে হারতে চাই না। ’
দুর্যোগ-দুর্বিপাকে স্বামী হারিয়ে জেলে বধূরা অনেক সমস্যায় পড়েন। পরিবারের বোঝা চাপে নারীর কাঁধে। কিন্তু এক্ষেত্রে ট্রলার মালিকেরা কতটুকু সহায়তা করছেন? এমন প্রশ্নের জবাবে রামগতির ট্রলার মালিক শরিফ উদ্দিন বলেন, সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়ে জেলেরা যেমন ঝুঁকিতে থাকে, ট্রলারের মালিকদের ঝুঁকিও কোন অংশে কম নয়। দুর্ঘটনার কবলে পড়ে ট্রলারটি হারিয়ে গেলে ট্রলার মালিকের তো বিরাট ক্ষতি হয়ে যায়। এ অবস্থায় মালিকদের জেলেদের জন্য ক্ষতিপূরণ দেওয়া সম্ভব হয় না।
ভোলা কেন্দ্রীয় মৎস্যজীবী সমিতির সম্পাদক আবুল কাশেম বলেন, মাছধরা ট্রলারে জেলেদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা রাখাটা জরুরি। কারণ জেলেরা জীবনের ঝুঁকি নিয়েই মাছ ধরতে যায়। জেলে ফিরে আসতে না পারলেও তার পরিবার যাতে চলতে পারে সেরকম আর্থিক সহায়তার ব্যবস্থা থাকা উচিত।
[ পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোন খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: [email protected] ]
বাংলাদেশ সময়: ০৪০০ ঘণ্টা, মার্চ ০৮, ২০১৫