উপকূলের প্রান্তিক জনপদ ঘুরে: দেশের চলমান রাজনৈতিক সংকটের ঢেউ উপকূলের প্রান্তিক জনপদে। কর্মহীন মৌসুমে কাজের সন্ধানে শহরে ছুটেও মিলছে না কাজ।
ভোলা সদরের চর সামাইয়া গ্রাম, দ্বীপ উপজেলা মনপুরার হাজীরহাট, নোয়াখালীর হাতিয়ার তমরুদ্দি লঞ্চঘাট, লক্ষ্মীপুরের কমলনগরের লুধুয়া বাজারসহ বিভিন্ন স্থানে মানুষের একই কথা। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা-আতংক এসব এলাকার মানুষের। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, ঘাট শ্রমিক, জেলে, দিনমজুর থেকে শুরু করে উপকূলের সব শ্রেণীর মানুষের মধ্যে অস্থিরতা।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, বহু মানুষের অলস সময় কাটছে গ্রামের হাট-বাজারে চায়ের দোকানে। নিজেদের নানামুখী আলোচনার পাশাপাশি সবার চোখ থাকে টেলিভিশনের খবরে। কেউবা অনলাইনে সর্বশেষ খবরটা জেনে নেন। সন্ধ্যায় কোথাও কোথাও আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম বিবিসি শোনার জন্য মানুষের ভিড় জমে হোটেল-রেস্টুরেন্টের সামনে। উৎকণ্ঠিত মানুষেরা একটি শান্তিপূর্ণ সমাধানের প্রতীক্ষায় থাকেন সারাক্ষণ।
মনপুরার হাজীরহাটে পল্টুন ঘাটে মো. বাবুলের চায়ের দোকান। শেষ বিকেলে অলস সময় কাটাচ্ছেন বেশকিছু মানুষ। কেউ জেলে, কেউবা মজুর, আবার কেউ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। পাশের আরেক দোকানে শ্রমজীবী মানুষেরা সময় কাটাচ্ছেন তাস খেলে। দোকানে তেমন বেচাকেনা নেই। মানুষের হাতে টাকা পয়সা নেই।
হাজীরহাটের বাসিন্দারা জানান, মনপুরার অন্তত ২০ হাজার মানুষ কাজের সন্ধানে বাইরে চলে গেছে। এদের মধ্যে শহরমুখীদের অনেকে কাজ না পেয়ে আবার গ্রামে এসেছে। হাজীরহাট ও আশপাশের এলাকার নূরুল ইসলাম মাঝি, নূর হোসেন মাঝি, সামসুদ্দিন মাঝি, জহিরুদ্দিন মাঝি, জয়নাল মাঝি, শাহ আলম মাঝি, বাবুল মিয়া, ইউসুফ আলী, জাহাঙ্গীর হোসেন, আবুল কাশেমসহ আরও অনেকে কাজের সন্ধানে বাইরে গিয়েছিলেন। কিন্তু কাজ না পেয়ে আবার গ্রামে ফিরেছেন।
নূরুল ইসলাম বলেন, শহরে গিয়েছিলাম কাজে। মালিক বিল্ডিং বানানোর মালামাল আনতে পারছে না। তাই আবার গ্রামে ফিরে এলাম। হাতে কোনো কাজ নেই। সংসার চলছে অতিকষ্টে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দামও বেড়ে গেছে অস্বাভাবিক।
ঘাটের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মো. বাবুল জানান, রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে বেচাকেনা কমে গেছে অস্বাভাবিক। দৈনিক যেখানে এক হাজার থেকে ১২শ’ টাকা বেচাকেনা হতো, সেখানে এখন বেচাকেনা মাত্র ৪-৫শ’ টাকা। প্রতিদিন লোকসান হচ্ছে ২-৩শ’ টাকা। বেচাকেনা কমে যাওয়ায় গত পাঁচ মাসে দেনা করেছেন প্রায় ৩০ হাজার টাকা।
রাজনৈতিক সংকটের কারণে মালামাল পরিবহনে সমস্যা দেখা দেওয়ায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে গেছে বলে জানান স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। কেরোসিন প্রতি লিটারে ৩ টাকা, পিঁয়াজ কেজিতে ১০ টাকা, আলু প্রতি কেজিতে ৩ টাকা, ছোলা প্রতিকেজিতে ৩ টাকা, চা-পাতা কেজিতে ২০ টাকা, ময়দা কেজিতে ৩ টাকা, চিনি কেজিতে ৩ টাকা, স্টারশিপ দুধের কৌটা প্রতি ২ টাকা বেড়েছে গত দু’সপ্তাহের ব্যবধানে। চাহিদা অনুযায়ী মালামাল না পাওয়া এর অন্যতম কারণ বলে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানান।
নোয়াখালীর দ্বীপ হাতিয়ার তমুরদ্দি লঞ্চঘাট। প্রতিদিন সকালে এই ঘাটে ঢাকা থেকে আসা দোতলা লঞ্চ ভেড়ে। কিন্তু মালামাল পরিবহনের পরিমাণ কমে গেছে। ঘাটে নেই আগের মতো প্রাণচাঞ্চল্য। কমে গেছে বেচাকেনা। ঘাটে কয়েকটি দোকানপাট থাকলেও সেগুলোর অধিকাংশই বন্ধ। ঘাটের দোকানদার মো. বেলাল জানান, বেচাকেনার আশায় ভোরবেলা দোকান খুলে বসেন; কিন্তু বেচাকেনা তেমন হয় না।
তমুরদ্দি ঘাটের ইজারাদার মো. রিপন বলেন, রাজনৈতিক সংকটের কারণে এই ঘাটের মালামাল পরিবহন অর্ধেকে নেমে এসেছে। এর ফলে ঘাটের অনেক শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছেন। আর এদের রোজগারের সংকট পড়েছে সংসারে।
কীভাবে শান্তি ফিরবে- এমন প্রশ্নে উপকূলের প্রান্তিক জনপদের মানুষের দাবি প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের সমঝোতা। তারা বলেন, দু’দল বসে ঠিক করুক দেশ কীভাবে চলবে। দু’দলের ক্ষমতার রশি টানাটানিতে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বেড়েছে। এথেকে আমরা মুক্তি চাই।
একজন বলেন, একদল অবরোধে ডেকে বসে আছে, আরেকদল ক্ষমতায়। তাদের তো কোনো সমস্যা নেই। আমরা সাধারণ মানুষ মরি। যে মানুষটাকে পুডিয়ে মারা হচ্ছে, সে মানুষটার অপরাধ কী। আমরা গরিব মানুষ। আমরা শান্তি চাই।
আরেকজন বলেন, দু’দলের গুতাগুতিতে দেশে শান্তি নেই। দেশের এই অবস্থায় সবারই ক্ষতি হচ্ছে। চলাফেরায় সমস্যা হচ্ছে। মালামাল আনা নেওয়ায়ও সমস্যা। ভয়ে শহরে যেতে পারি না। দু’দল বসে একটি সমাধান বের করতে পারলে দেশের মানুষের মাঝে শান্তি ফিরে আসত।
[ পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোন খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: [email protected] ]
বাংলাদেশ সময়: ০১৫০ ঘণ্টা, মার্চ ১৪, ২০১৫